Wednesday, January 21, 2015

বাংলা অণুগল্প ৩৮ - মহাজন

মহাজন ।।


'অমাবস্যার রাতে হ'ল চাঁদের পোয়াবারো,
ধর ধর ত বলে সবাই, সাধ্য থাকলে ধরো!'
আরে না না, এটা মোটেও কোনও পাগলের প্রলাপ নয়। এ হল কেওটিয়া গ্রামের প্রচলিত স্থানীয় ছড়া, কোনও অজানা গ্রাম্য কবির রচনা। কেওটিয়া হল কেওট অর্থাৎ কৈবর্তপ্রধান গ্রাম, তাদের মধ্যেই শ্রীমান চন্দ্রবদন ধর ওরফে চাঁদ ধর কিভাবে জানিনা পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে নিশিকুটুম্বিতাকে নিজের পেশা হিসেবে বেছে তার জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তী পর্যায়ে উঠে গেছিল। রাতের, বিশেষ করে অমাবস্যার অন্ধকারে নেংটি পরা তেল চুপচুপে কালো শরীরটাকে দেখার ভাগ্য আশপাশের পাঁচটা গ্রামের লোকেদের খুব একটা না হয়ে উঠলেও তার হাতের কাজের প্রশংসা বা নিন্দা লুণ্ঠিত গৃহকর্তা থেকে শুরু করে পুলিশের বড়কর্তা পর্যন্ত করতে বাধ্য হতেন।
তা এই স্বনামধন্য চন্দ্রবদন একটি জায়গায় এখনও সুবিধে করে উঠতে পারেনি, সে হল কালবোসে গ্রামের বণিকপ্রধান অতুল্য সাহার বাসা। সাহামশায়ের মহাজনী কারবার, টাকার লেখাজোখা নেই। স্বামী-স্ত্রীর সংসার, শোনা যায় খাওয়ার মুখ বাড়বে বলে ছেলেপুলের ঝামেলাতেই যাননি অতুল্য সাহা। তাই আশেপাশের দশটা গ্রামে হাড়কঞ্জুষ আর অপয়া বলে তিনি বিখ্যাত, তবে বিচলিত নন একফোঁটাও। বলা বাহুল্য বাড়ীতে চাকর-বাকরের সংখ্যাও অপ্রতুল। তাই এক অমানিশার শুভলগ্ন দেখে কালবোসে গ্রামের সাহাবাড়িতে পড়ল চাঁদের পায়ের ধূলো। এ অঞ্চলের প্রাচীন প্রবাদ অনুযায়ী চাঁদের সিঁদকাঠি আলাদিনের জিনের থেকেও দ্রুত ও নিঃশব্দে কাজ করে। আধঘণ্টার মধ্যেই সে বাইরে থেকে সটান ঢুকে পড়ল সাহামশায়ের পালংকের তলায়। কিন্তু একি! সাহামশাই আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই জেগে, এত রাতে- এমনটাতো সে আশা করেনি। কি আর করা যায়, চুপচাপ সে গর্তের মধ্যে শরীরটা ঢুকিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে করতে তাদের কথা শুনতে লাগল।
- হ্যাঁগা, আমি বলচি তুমি আরেকটা বিয়ে কর। আমার আর কিচু হবেনা বুজতে পেরেচি, তোমার পরকালের তো একটা হিল্লে হোক। তাছাড়া এতো সম্পত্তি আমরা ম'লে আর কোন কাজে লাগবে? সাহা-গিন্নীর সকরুণ উক্তি শুনতে পায় চাঁদ। এরপরেই আসে সাহামশায়ের উত্তর।
- সে চেষ্টা কি আমি করিনি, তুমি মনখারাপ কোরনা গিন্নি। ডাক্তার দেখিয়েছি শহরে গিয়ে। দোষটা ত তোমার নয়, আমারই। কি লাভ, আরেকটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে?
- তাইলে একটা দত্তক নাও। তোমায় লোকে হাড়-কিপ্টে, অপয়া বলে, আমার মোটেও ভাল্লাগে না।
- তাহলে তোমাকে লোকে বাঁজ বলবে, গিন্নি। আর সেটা শুধু তোমার কেন, আমারও কি শুনতে ভাল লাগবে? মরদের দোষে ছেলেপুলে হচ্ছেনা, এ কথা গাঁয়ের লোকে বিশ্বাস করবে ভেবেছ বুঝি!
- কিন্তু এই বিষয়-আশয় আমরা গেলে আর কি কাজে আসবে শুনি, ও ত পাঁচ ভূতে লুটে খাবে!
- সম্পত্তি কি গো! একটু যেন কাষ্ঠহাসি হাসলেন সাহামশাই। কলকেতায় যে ডাক্তারের কাছে গিছলাম, বুঝলে গিন্নি, সে নাকি মস্ত রিসাচ করছে যাতে কিনা বাঁজা মাগ-ভাতারেরও ছেলেপুলে হবে। তার কাজটি আমার বড় ভাল লাগল, তবে এই রিসাচ না কি যেন- বড় খরচের কাজ। কাউকে বোলোনা তাকে আমি মাসে মাসে পাঁচশো টাকা বরাদ্দ করে এসেছি। আমাদের যা হয় হবে, আহা, ভবিষ্যতের বাঁজা বউদের একটা হিল্লে হোক।
ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে চাঁদ। সে তস্কর হয়েও মানব-চরিত্রের বৈচিত্র্য সম্বন্ধে আজ মহাজ্ঞানী। আর তার চোখে অতুল্য সাহা আজ সত্যিকারের মহাজন, মনে মনে তাঁকে প্রণাম জানাল চন্দ্রবদন। আজ আকাশে চাঁদও নেই, তাই এ ঘটনার কোনও সাক্ষী রইল না।


মুম্বাই, ১৪ই জানুয়ারি, ২০১৫।

No comments:

Post a Comment