Wednesday, January 21, 2015

বিশেষ রচনা - নীরস জীবন কিছুদিনের

।। নীরস জীবন কিছুদিনের ।।




(১)

যখনকার ঘটনা বলছি, তখন পশ্চিমবঙ্গে সূর্যটা একটু বাঁ দিকে হেলে উঠত। গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকার জন্ম হয়নি, পশ্চিমবঙ্গের আসল রাজধানী ছিল মস্কো আর দু’জন দাস ছিলেন বিখ্যাত, কেসি দাস আর ‘দাস কাপিটাল’। আমি বিহারের একটি সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ফাইনাল ইয়ারে উঠেছি, মাঝে মাঝেই টেস্ট আর ইন্টারভ্যু দিতে কলকাতা ছুটতে হয়। আর তখনও ছাত্রজীবন। বাবারও অত টাকা নেই কলকাতায় হোটেলে উঠতে দেবার। তবে হ্যাঁ, তখনকার দিনে আত্মীয়স্বজনরা ভাল ছিলেন। সবারই বড় সংসার, কে একজন এল না গেল, তাতে করো কিছু যায়-আসতো না। তাই মাসি-মামা-জ্যাঠা জিন্দাবাদ বলে কলকাতার ট্রেনে চেপে বসতাম।

একদিন এরকমই জম্মু-তাওই থেকে নামছি শেয়ালদায়, একটা বাস ধরে বেহালায় জ্যেঠুর বাড়ি যাব, হঠাৎ পিঠে কার একটা হাত পড়তেই তাকিয়ে দেখি আমার পিসতুত ভাই লাটাই।
লাটাই ওরফে বোধিসত্ব তখন নীল রতন মেডিক্যাল কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে। বাঁকুড়ার ক্রিশ্চান কলেজে পড়ার সময়ই মার্কামারা ছাত্রনেতা ছিল, আর এই বাঁদিক ঘেঁসে চলার অভ্যেস ওরা বংশপরম্পরায় পেয়েছে, বলতে গেলে ওদের রক্তে আছে। এদেরই এক জ্যেঠতুত ভাইয়ের কথা একবার বলেছিলাম, মানবাজারে ছাতে লাল পতাকা দেখে যাদের বাড়ি চিনেছিলাম, অবশ্য পরে জেনেছিলাম ওর ছাতে মেলা লুঙ্গিটা হাওয়ায় উড়ে অ্যান্টেনায় আটকে গেছিল।
‘কিরে, তুই এখানে? অবশ্য তোর তো কলেজ কাছেই, ষ্টেশনে বেড়াতে এসেছিলি বুঝি’, আমি শুধোই।
‘না রে, সন্ধ্যে হয়ে গেছিল, এসেছিলাম ক্লাসের একটা মেয়েকে কৃষ্ণনগর লোকালে তুলে দিতে’ অম্লানবদনে ও বলল। আমার থেকে বয়সে কিছুটা ছোট হলেও আমাদের মধ্যে ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। অবশ্য মেয়ে বন্ধুদের ব্যাপারে ওর সংকোচ কোনকালেই ছিল না। উদারপন্থী বাবা-মা, এ ব্য়াপারে যথেষ্ট ছাড় ছিল। কিন্তু লাটাই আর আমাকে ছাড়ল না, পরপর দু’দিন ছুটি, জোর করে হোস্টেল নিয়ে এল।

‘জাস্ট একটা কথা এখানে মনে রাখিস, আমি এখানে লাটাই নই, বোধিসত্ব ব্যানার্জি। যতীন চক্রবর্তী, বিমান বসু আমাকে ছোট ভাইএর মত দেখে, আমার বাবা বাঁকুড়া জেলা কমিটির সিনিয়ার মেম্বার- এগুলো সব আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর উটকো লোকের সাথে একদম কথা না।‘ নীলরতনে ঢোকার আগেই লাটাই আমাকে বেশ করে বুঝিয়ে দিল।
‘কিন্তু কেন বল তো, যদিও কথাগুলো অন্ততঃ পঞ্চাশ ভাগ সত্যি, সেটা আমি জানি।‘
‘হোস্টেলে যেতে যেতেই দেখতে পাবি’ ওর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
কলেজের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই একটা পোস্টার চোখে পড়ল। ‘বোধিসত্বকে মানছি না, মানব না’, ‘এস-এফ-আই-এর কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও’। হোস্টেলের বাইরের দেয়ালে আরেক চমক যেটার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না- ‘এস-এফ-আই’এর গুণ্ডা বোধিসত্ব ব্যানার্জির মাথা চাই।‘ এবং একটা নয় দু-পাশের দেয়ালে এই পোস্টার অজস্র।
আমি ততক্ষণে বেশ ভালরকম ঘাবড়ে গেছি। আমাদের ওখানেও আছে বামঘেঁসা ছাত্র ইউনিয়ন বি-এস-এ বা বিহার স্টুডেন্ট এ্যাসোসিয়েশন, আমি তার দু-একটা মীটিঙএও গেছি, কিন্তু তাতে কোনও ভয়াবহতা নেই, খুনখারাপির ধমকি তো নয়ই। কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাটাই হোস্টেলে না ঢুকে তার বাঁ-দিকে ল্যাবোরেটরি সংলগ্ন একটা ছোট রুমে তালা খুলে ঢুকল। কি আশ্চর্য! দেখি তালাবন্ধ ঘরের ভিতর একটি ছেলে একমনে পোস্টার এঁকে চলেছে। ‘একি রে, ওর দরকার পড়লে বাইরে যাবে কি করে?’ আমি জিগ্যেস করলাম। ‘বাথরুমের ভেতর দিয়ে দরজা আছে’, সংক্ষিপ্ত উত্তর পেলাম। পাঁচ মিনিট পরে ছেলেটি উঠে চলে গেল।

‘বাঃ, তোর রুম টা তো বেশ! তবে হোস্টেলের বাইরে কেন?’ আমার প্রশ্ন।
‘আসলে আমার সিংগল সীট পাওয়ার কথা নয় সেকেণ্ড ইয়ারে। এই রুমটা ছিল লাশকাটার স্পেশ্যাল টিউটরিয়াল ক্লাশ, সেটা এখন উঠে যাওয়ায়, এটা খালি তালামারা অবস্থায় পড়ে ছিল। আমার রুম কাম এস-এফ-আই গোপন অফিস করার জন্যে দাদারা জবরদখল করে দিয়েছে এটা আমার জন্যে। তোর চিন্তা নেই, খাটিয়াটা আমার হাইটের হিসেবে ছোট পড়ে বলে আমি ডিসেকশন টেবিলটাতেই শুই।‘ কি সাংঘাতিক কথা, আতঙ্কে আমার লোম খাড়া হয়ে উঠল, লাটাইএর কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নাই।
যাক, হোস্টেলেই খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা রুমে এসে বসলাম। লাটাই শুরু করল ওর ছাত্রনেতা হয়ে ওঠার বিস্তারিত কাহিনী। ছাত্র পরিষদ অধ্যুষিত কলেজে ঢুকেই কিভাবে প্রায় জোর করে বড় একজন বামপন্থী নেতাকে ধরে সংগঠনটাকে ঢেলে সাজানো হল। চে গুয়েভারা, হো-চি-মিন্‌হ্‌ আর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কবিতার আবৃত্তি ক্লাসে-ক্লাসে শোনাতে গিয়ে একটা বিশ্রী মারামারিতে জড়িয়ে পড়া, তারপর পুলিশ কাস্টডি ও সেখান থেকে অলৌকিকভাবে ছাড়া পাওয়ার পর সিপির ছেলেমেয়েরা ক্ষেপে যায়। তখনি ঐ ‘মুণ্ডু’ চাই এর পোস্টার পড়ে দেয়ালে দেয়ালে।
- তার পরেই বুঝলি, হঠাৎ করে আমি হিরো হয়ে গেলাম। এমনকি ফোর্থ ইয়ার ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রছাত্রীরাও দেখি বেশ সমীহ করতে লেগেছে।
- কিন্তু এসব করে পড়ার ক্ষতি হচ্ছে না?
- হয়, আবার পুষিয়েও নিতে হয়। তখন রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের পড়ার স্টাইলটা কাজে আসে। ভয় একটাই, যদি কোনও সিপির হাতে পরীক্ষার কোনও খাতা যায়। মার্কামারা হয়ে গেছি কিনা!
- সে কি? প্রফেসারদের স্টুডেন্ট ইউনিয়ানের সাথে কি সম্পর্ক? তাদের তো নিরপেক্ষ থাকার কথা।
- বিশাল। পক্ষপাতিত্বের বহরটা ক্লাস করার সময়ই টের পাওয়া যায়। যাক, এখন শুয়ে পড়, কাল তো তোর আবার ইন্টারভ্যু আছে।
- ইন্টারভ্যু না, রিটেন টেস্ট। ঠিক আছে, গুডনাইট।


(২)
পরদিন সকালে চা-জলখাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম মোয়রা স্ট্রিটে হিন্দী বয়েস হাই স্কুলে। ওখানেই হবে টেস্ট। সব শেষ হতে বিকেল চারটে। নীলরতনে ফিরতে পাঁচটা বাজল। ফিরে দেখি দরজা ভেজানো, আর আমার ভাই কমরেড লাটাই ডিসেক্‌শন টেবিলের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। আমার চেয়ে বয়েসে ছোট হলেও কলকাতার অলিগলি ওর চেনা, আর কম্যুনিজমের পাঠে আমার গুরু, যদিও জানি বঙ্গে না থাকলে এ শিক্ষা আমার কোনও কাজেই লাগবে না। আমার জ্ঞান ছিল দাস কাপিটালের সোসিও-ইকনোমিক ও সারপ্লাস ভ্যালু থিওরি থেকে কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টো পর্যন্ত, অর্থাৎ যেটুকু ইকোনমিক্স আর ফিলসফিতে পড়তে হয়েছিল। সেখনেও হেগেলের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (dialectic materialism) নিয়ে এমন জগাখিচুড়ি পাকানো হয়েছিল, যে পুরো ব্যাপারটার থেকে ইন্টারেস্টটাই চলে যায়। লাটাই ওদের গ্রাসরুট কর্মী হলেও দেখি তাত্বিক ব্যাপারগুলো বেশ বোঝে, এখনকার পশ্চিমবাংলার কম্যুনিস্টদের মত শুধু যেমন-তেমন ভাবে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মাতত না। বাঁকুড়ায় থাকতে ওদের সিনিয়ার ছাত্রনেতা কমঃ শ্যামলদা, শীলাদিদের সাথে পরিচয় হয়েছিল, খুব একটা ব্যবহারিক না হলেও বেশ কিছু উচ্চস্তরের কথাবার্তার চাষ হত সেখানে, বিশেষ কিছু না বুঝলেও ভালই লাগত।
- কিরে, এই সময় ঘুমোচ্ছিস, আমার প্রশ্ন।
- না, রাতে মীটিং আছে, অনেকক্ষণ জাগতে হতে পারে, তাই একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছি- ওর উত্তর।
- আমি তাহলে রাত্রের বম্বে মেল বা দুন ধরে বেরিয়ে পড়ি, ভোরের আগেই ধানবাদ পৌঁছে যাব।
- আরে তুই এখন যাবি কোথায়? ভাবলাম, দু-বছর পরে দেখা, কোথায় বেশ ভাল করে আড্ডা হবে......কলেজ নেই তো?
- না, একটা গোলমালে কলেজ এখন বন্ধ, ‘সাইনে ডাই’- জানিনা কবে খুলবে।
- তাহলে আর কি? মামুকে একটা টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি, থাক এখন কদিন।
- কিন্তু আমি তো বেশী টাকাও আনি নি।
- তাহলে তো আরো ভাল। লিমিটেড টাকা দিয়ে আমরা হোস্টেলের স্টুডেন্টরা কিভাবে মাসের শেষদিনগুলো চালাই, সেটাও তোর দেখা হয়ে যাবে।
- সেকি! পিসেমশাই তোকে এত কম টাকা দেন? আমার কথায় অবিশ্বাসের ঝলক।
- না তা নয়। তবে যতই দিক, ২৩-২৪ তারিখে পকেট অবধারিতভাবে গড়ের মাঠ। তারপরেই শুরু হয় কৃচ্ছ্রসাধনের পালা - কথাটা ঠিক বললাম তো? একবার ঠেকায় পড়ে একটা ট্যুশনও ধরেছিলাম, রাজাবাজারের কাছে একটা ক্লাশ নাইনের মেয়েকে। ভাল লাগত না, পড়ানোর সময়ে একটা ভোঁদাগোছের চাকর আগাগোড়া পাহারা দিত। কিন্তু পকেটে এক্সট্রা পয়সা আসামাত্র আমার খরচাও বেড়ে গেল। তাই দুম করে ওটা দিলাম ছেড়ে। আর এখন তো এমন ব্যস্ত ট্যুশনির কথা ভাবতেও পারিনা। চল আজকে পদ্মায় ইলিশ খেয়ে আসি।
- কলকাতায় পদ্মা? ঠাট্টা করছিস!
- আরে সে পদ্মা নয়। শেয়ালদার পদ্মা হোটেল। দারুণ বানায়। তবু আমাদের হোস্টেলের মেসের থেকে বেশী খরচ পড়েনা।
- মেসে তবু তো পয়সা দিতে হবে !
- আগের থেকে বলে রাখলে লাগে না। এখন থেকে জানুয়ারির বাকি কটা দিন বাইরে খাওয়া যাবে। আরে.........বলেই কিছুক্ষণ ‘পজ’ দিয়ে ওর মনে পড়ল-‘তুই যাবি কোথায়? আজ বইমেলা শুরু হয়েছে......থেকে যা দুটো দিন’।

এরপর তো আমার আর চলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কলকাতা সম্বন্ধে একটা ‘ফোবিয়া’ ছিল মনে মনে, কখনও থাকতে চাইতাম না। কিন্তু এখন লাটাই আছে, ভয় কি? ন’টা নাগাদ পদ্মা হোটেল থেকে গরম গরম ভাপা ইলিশ-ভাত খেয়ে এলাম। বাজারে এখন ইলিশ দুষ্প্রাপ্য, তবু ওরা কোত্থেকে জোটায় কে জানে! শেয়ালদা স্টেশন থেকে আচার্য জগদীশ বসু বা লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে ঘিঞ্জি বাজার, সেখানেই গঙ্গা-মেঘনা-পদ্মা-ইস্টবেঙ্গল-অশোক নানা নামের ছোট-বড় ভাতের হোটেল আর অজস্র সস্তার লজ ছিল, এখনও আছে। তখন রাজাবাজার-থেকে শেয়ালদা হয়ে পার্ক সার্কাসের ট্রামলাইন বন্ধ, অথচ ফ্লাইওভারটাও চালু হয় নি। বিশ্রী অবস্থা একেবারে। তবু ভাগ্যিস বর্ষাকাল ছিলনা।
ঠিক সাড়ে নটায় এস-এফ-আইএর মেম্বাররা আসতে শুরু করল লাটাইএর রুমে, বেশী নয়, কোর কমিটি (আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম পলিটব্যুরো)র ছ-সাতজন মোটে। দুরূহ কার্যপ্রণালী নিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় তুমূল তর্কবিতর্ক চলল ঘণ্টাদুয়েক ধরে। যেটুকু বোঝা গেল, লাটাইকে ওরা জি-এসের জন্যে দাঁড় করাতে চায়, আর নতুন যে ছাত্রছাত্রীর দলটা এসেছে তাদের ব্রেনওয়াশটা কিভাবে হবে তার প্ল্যানিং করতে হবে। উপায়ান্তর ছিল না, আমিও নির্লিপ্ত মুখ করে শুনে গেলাম।


(৩)

মেম্বারদের যেতে যেতে প্রায় বারোটা। ভাবলাম এবার ঘুমনো যাবে। হঠাৎ লাটাই বলল, তোর তো বাংলা হাতের লেখা ভালই, ছবিও আঁকতিস ছোটতে, টা পোস্টার আঁকতে পারবি না। হায়রে, হাতের লেখা ভাল হওয়ার শেষে কিনা এই পুরস্কার! কি আর করা যায়, পড়েছি মোগলের হাতে! রাত্রি বারোটায় এস-এফ-আইএর পোস্টার আঁকতে বসলাম দুজনে।। দেড়টা নাগাদ খুব ঘুম পেতে লাগল। লাটাই প্রস্তাব দিল, , চা খেয়ে আসি।


চা- রাত দেড়টায়? মেট্রো লাইফ কাকে বলে তখনও আমার ঠিক জানা ছিল না। গেটের বাইরে এসে দেখি, নীরসের কম্পাউণ্ড ওয়াল ঘেঁষে অজস্র চা-পাউঁরুটি-ফলের দোকান, খেয়াল পড়ল, আরে এটা তো বড় হাসপাতালও বটে। হস্টেলের ছাত্র, নাইট শিফ্‌টের হাউস-স্টাফ, রোগীদের আত্মীয়স্বজন, শেয়ালদার প্যাসেঞ্জার, হকার- কারা চা খাচ্ছে না।
তবু বেশীক্ষণ জাগা গেল না। আড়াইটে নাগাদ কাজ যেটুকু পারা গেল করে আমরা শুয়ে পড়লাম, সাথে সাথেই ঘুম।
পরদিন আটটায় ঘুম ভাঙল। খিদেও পেয়েছিল। একে গঙ্গার হাওয়া, তায় গোটাদিন টো-টো। গেটের সামনের হোটেল থেকে দুজনে চা-সিঙ্গাড়া-জিলিপি খেয়ে এলাম।
-
এখন তো এখানে কোনও কাজ নেই। চবইমেলা ঘুরে আসি।
-
কিন্তু কি বই কিনব, তাছাড়া টাকাও তো গোনাগুনতি।
-
আরে, বইমেলা যাওয়ার সাথে বইকেনার কি সম্বন্ধ। গতবছর থেকে জাস্ট শুরু হয়েছে, অল ইণ্ডিয়ায় এরকম আর কোথাও পাবিনা।
-
ঠিক আছে।
-
তাহলে চানটা সেরে নে, আমি পোস্টার যে কটা হয়েছে, ডিসপ্লের জন্যে দিয়ে আসি।
লাটাই পোস্টারগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল।


ময়দানের মেলায় সেবার বা সেদিনের জন্যেই বুঝি এন্ট্রি ফ্রী ছিল। রবিবার বলে বিশাল ভীড়। পেছন পেছন আসছে একটা মেয়েদের দঙ্গল। একটা চেনা গলা মনে হতেই পেছন ফিরে দেখি আমার আরেক কাজিন, পিসতুত বোন সুজয়া। লেডি ব্রাবোর্ণে বিএ পড়ে হোস্টেলে থেকে। ওর কথা আমার মাথাতেই ছিল না, হোস্টেলের বান্ধবীদের সাথে ছুটির দিনে বইমেলা বেড়াতে এসেছে, খুব খুশী আমাদের দেখতে পেয়ে। তখন শুধু আমার কেন, কলকাতারও বেশীরভাগ বাসিন্দার কাছেই বইমেলার ঠিক স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তবু ভীড় হয়েছিল দেখবার মত। যাঁরা বই লেখেন, তাঁরা যে রক্তমাংসের মানুষ এবং তাঁদেরও যে চর্মচক্ষে দেখা যায় এ ধারণাই তখনও হয়নি। এর আগে নামকরা সাহিত্যিকদের মধ্যে শুধু আশুতোষ আর শংকরকে দেখেছিলাম। এবার তো গীল্ডের টেন্টে গিয়ে দেখি চাঁদের হাট বসে গেছে। আশাপূর্ণা দেবীকে জ্ঞানপীঠ (যদিও সেটা উনি ৭৬এই পেয়েছিলেন) পাওয়া নিয়ে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে, সুনীল-বুদ্ধদেব গুহ আছেন, বোধহয় বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবি-সাহিত্যিক অন্নদাশংকর রায় ছিলেন সভাপতি। আমাদের হাতে অত সময় ছিলনা, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম কফি খাওয়ার জন্যে। একফাঁকে খাওয়া-দাওয়াটাও আমরা সেরে নিলাম বইমেলার ক্যাণ্টিন থেকে। গণশক্তির একজন সহ-সম্পাদকের সাথে লাটাই খুব জমে গেছে দেখলাম, তিনিই আমাদের দোসা খাইয়ে দিলেন নিজের পকেট থেকে খরচা করে। কিছু বইও কেনা হল, বিশেষ করে লিট্‌ল ম্যাগাজিন জিনিষটা আমার খুব ভাল লেগে গেছিল। বেশ উচ্চস্তরের লেখা, দামও কম, অথচ লোকে দেখে চলে যাচ্ছে, খুব একটা কিনছে না। বুঝলাম, নামী লোকেদের দামি বইই বাজারে কাটে, বাকি সব পোকায়।

সেখান থেকে আকাদেমি হলে নাটক। কি একটা লেফ্‌টি গ্রুপের করা ইবসেনের ডলস্‌ হাউসছিল বলে এন্ট্রি ফ্রী ছিল, অথচ তেমন ভীড় ছিল না। বুঝলাম বঙ্গে বামপন্থীদের পায়ের তলার জমি ক্রমশঃই শক্ত হচ্ছে।
রাত্রে ফেরার সময় আমরা ফতুর। একটা বাসে উঠে পড়লাম ও কণ্ডাক্টার ভাড়া চাইবার আগেই ধর্মতলা-ওয়েলিংটনে নেমে পড়লাম। বীফ খাস’, লাটাই জানতে চাইল। না রে, ওইটা এখনও অভ্যেস করিনি। তুই খাস নাকি?’ আমি বললাম।
-
এখনও শুরু করিনি। বাঁকুড়ায় সুযোগ ছিল না। কিন্তু বীফ না খেলে পাকা কম্যুনিস্ট হওয়া যায় না বলে শুনেছি, দেখি একদিন শুরু করব। যে কোনও মাংসের থেকে অনেকটা শস্তা পড়ে। চল আজ ফুটপাথের রুটি খাওয়া যাক।
মাত্র দেড় টাকায় ছটা রুটি, ডাল আর আলু-পেঁয়াজের তরকারি । তার পরেও বিহারি স্টল ওয়ালাটি নিজের লাভ রাখে, ভাবা যায়? আর ক্ষিধের মুখে অসাধারণ স্বাদ- মশলা বলতে তো শুধু একটুকরো হিং আর পাঁচফোড়ন।

অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরদিন সকালে ধানবাদ ফিরে গেলাম।


(৪)

আরেকটা পর্ব না লিখলে আমার নীরস অধ্যায় শেষ হয়না। সে বছর, অর্থাৎ ১৯৮১র গরমের ছুটিতে লাটাই এসেছিল আমাদের বাড়ি। আমাকে যাবার সময় বার বার করে বলে গেল কলকাতা গেলেই ওর হোস্টেলে যেন উঠি। এবার ও জি-এস হয়ে গেছে, আর পোস্টার লিখতে হবে না। আমার অবশ্য পোস্টারে নয়, ভয় ছিল ওর মড়া কাটা তক্তপোষটিতে, যদি একা ও ঘরে কখনও শুতে হয় তাহলেই গেছি!

তবে অদৃষ্টে যোগ একটা ছিল। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে একটা ইন্টারভিউ পড়ল কলকাতায়। লাটাইকে লিখতেই ও আগের দিনের জম্মু- তাওয়াইয়ে যেতে লিখে দিল। বলল, চলে অ্যায় একটা সারপ্রাইজ আছে।
পরদিন জানা গেল কি সেই সারপ্রাইজ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের আই-এফ-এ শীল্ডের ফাইনাল। ময়দানে মোহনবাগান-এরিয়ান্স মাঠে বিকেল সাড়ে চারটে থেকে। আমার ইন্তারভিউ ছিল ক্যামাক স্ট্রীটের ইন্ডাস্ট্রি হাউসে। ঠিক হল, ও তিনটে নাগাদ থিয়েটার রোডের মুখে চলে আসবে, সেখান থেকে আমরা একসাথে যাব।
সেটা বোধহয় ২৬শে সেপ্টেম্বর ছিল। আমার বেরোতে বেরোতে সাড়ে তিনটে হয়ে গেল। থিয়েটার রোডের মুখে লাটাইএর সাথে দেখা। ছোট, ছোট। খেলা সাড়ে চারটে থেকে আর এখন জাস্ট সাড়ে তিন। এত তাড়ার কি আছে? আমি যতদূর জানি পার্টিরই এক দাদা দুটো কমপ্লিমেন্টারি টিকিট দিয়ে গেছে ওকে, সুতরাং টিকিট কাটারও কোনও ঝামেলা নেই।
- বুঝতে পারছিস না, মোহনবাগান স্ট্যাণ্ড ভরে গেলেই বিপদ, তখন বসতে হবে ইষ্টবেঙ্গলের সাপোর্টারদের সাথে। এবং যেখানে বাঘের ভয় ঠিক সেখানেই সন্ধ্যেটা হল।

বিপদটা তখনও আমার মাথায় ঢোকেনি ঠিকমত। ঠিক আছে, আমরা দুজনেই নাহয় মোহনবাগানের সাপোর্টার, নাহয় ইস্টবেঙ্গলের লোকেদের সাথে বসলামই। খেলা দেখার কি অসুবিধে তাতে? তবে ব্যাপারটা টের পেলাম খেলা শুরু হতেই। মোহনবাগান একটা ভাল মুভ করছে- চেঁচাবার উপায় নেই! শ্যাম থাপা একটা বাইসাইকেল করেছে, কি প্রদীপ চৌধুরী একটা দারুণ শট নিয়েছে। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছি, পেছন থেকে এক ঠেলা। ‘করছিস কি, বসে পড়। মনে রাখ, তুই এখন ইস্টবেঙ্গল’, লাটাই আমাকে চুপি-চুপি জ্ঞান দিল।
ইতিমধ্যে মোহনবাগানের অরূপ দাস একটা গোল করল। দেখি মোহনবাগান গ্যালারিতে সবাই নাচানাচি করছে, কিন্তু আমাদের উপায় নেই- মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে হচ্ছে। কলকাতার ক্রিকেটের দর্শকদের স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের এত প্রশংসা করে সবাই, কিন্তু ফুটবলে, বিশেষ করে তিন প্রধানের খেলা থাকলে তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া যেত না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইস্টবেঙ্গলের সোমনাথ ব্যানার্জি গোল শোধ দিল, আর হাফ-টাইমের পরেই চন্দ্রবাহাদুর থাপা চমৎকার বানানা কিকে ওদেরকে এগিয়ে দিল। আমার খেয়াল ছিল না, লাটাই ইশারা করল, দেখছিস কি, নাচ। না নাচলেই ধাক্কা মেরে গ্যালারি থেকে ফেলে দেবে হয়ত। অগত্যা অনিচ্ছাসত্বেও ধেই ধেই করে কিছুক্ষণ লাফাতে হল। হঠাৎ দেখি সামনে দিয়ে একটি প্রৌঢ় ভদ্রলোককে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হল। একটি ছেলে কিছুক্ষণ আগেই নাচছিল, হঠাৎ ‘বাবা’ বলেই গ্যালারি থেকে নেমেই পড়ি কি মরি করে ছুটল ওদের পেছনে। ব্যাপারটা জানা গেল পরদিনের কাগজ পড়ে। নগেন দে নামে এক মধ্যবয়স্ক মোহনবাগান সাপোর্টার ইস্টবেঙ্গল এক গোলে এগিয়ে যাওয়া মাত্র শোকের ধাক্কায় করোনারি অ্যাটাকে মারা যান, ছেলে ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার তখন অন্য গ্যালারিতে নাচছে! এই ছিল কলকাতার ফুটবল। মফঃস্বলের মানুষ আমি, এ উন্মাদনা কোথায় পাব!
তবে আমাদিগকেও হতাশ হয়ে ফিরতে হয় নি । মোহনবাগানের ফ্রান্সিস ডিসুজা শেষ মুহূর্তের গোলে সমতা ফিরিয়ে আনেন ও টাই ব্রেকারের সিস্টেম না থাকায়, দু-দলকেই যুগ্ম বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বেচারা নগেনবাবু জেনে গেলেন না যে তাঁর মোহনবাগান হারে নি।


- কি রে আজ কোথায় খাবি, লাটাই যেতে যেতে শুধোয়। আমার তো মাসের শেষ সপ্তাহ, ধর্মতলা না শেয়ালদা?
- আজকে চাং হোয়া, আমার পকেট বোঝাই আজ। কয়েকমাস একটা ট্যুশনি করেছিলাম, বাবার হোটেলে খাই, প্রায় সব টাকাটাই জমেছে।
- হুররে, ডি লা গ্রাণ্ডি মেফিস্টোফিলিস......বলে একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিল লাটাই, না, টেনিদা ধারে কাছে নেই।
- ইয়াক ইয়াক। আমি বলে উঠলাম।
আমরা দুজনেই হঠাৎ ভুলে গেছি যে আমরা হাইস্কুলের নই, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র।


(শেষ)

No comments:

Post a Comment