নিতাই-গোরা।।
(গল্প)
(গল্প)
"ধূমপান করিনে আমি, গাঁজা খাই জয় বাবা বলে......"- হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে সিঁড়ি ওঠার মুখে বেসুরো গলায় শ্যামাসঙ্গীতের প্যারডি শুনে থমকে দাঁড়ালাম। "ভোলে বাবা কে চরণোঁ মেঁ সেবা লাগে" বলে ছিলিমে একটা লম্বা টান দিতেই ফটাস্ করে আওয়াজ, শিবনেত্র হয়ে পড়লেন সাধুবাবা। আমার পেছনে একজন মধ্যবয়সী সুদর্শন ভদ্রলোক আসছিলেন, একটু মুচকি হেসে একটা পাঁচ-টাকার কয়েন ঠং করে ফেলে দিলেন সামনে রাখা থালাটাতে।
আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি এগিয়ে এসে শুধোলেন- 'কতদূর?'
'কাটোয়া' আমি বললাম, 'আটটার লোক্যালে।'
- 'আমি অগ্রদ্বীপ।'
- 'হুঁ, তুলসী-মালা গলায় দেখেই বুঝেছি', মৃদু হাসলাম আমি, 'গোপীনাথের মেলায় বুঝি?'
- 'না, বাড়ি ওখানে। ভালই হল গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।'
- 'বাঃ, ভালই তো হল, চলুন।'
ভদ্রলোক ডাক্তার। নাম নিত্যানন্দ সরখেল। পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়সের আধুনিক শিক্ষিত মানুষের সাথে এমন নাম একেবারেই মানায় না। সেটা বলায় উনি হাসলেন।
- 'আমাদের নবদ্বীপ অঞ্চলে নিতাই-গোরার ছড়াছড়ি, কী করবেন? আর বয়স বা শিক্ষা-দীক্ষা অনুযায়ী নাম তো আর বদলানো যায় না। তবে আইডিয়াটা মন্দ দেন নি। রবি ঠাকুরের এক গল্পের নায়কও তো আধুনিকতার দোহাই দিয়ে অভয়াচরণ থেকে অভীককুমার হয়েছিলেন।...... এই যে দাদা, মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে যে দুটো সিগারেট মেরে দিলেন, জানেন এতে কার ক্ষতি হচ্ছে?'- শেষের কথাটা অন্য এক সহযাত্রীকে বলা।
- 'নিজের পয়সায় খাচ্ছি মশায়, কারো বাপের পকেট মারিনি।' পালটা উত্তর আসে।
- 'তামাকের নিকোটিনের ক্ষতিকর দিকের কথা নাহয় ছেড়ে দিলাম, আপনার স্বাস্থ্য আপনি বুঝবেন। কিন্তু অন্যকে নিজের এঁটো ধোঁয়া খেতে বাধ্য করছেন বলেই বলছি।'
- 'আমি তো কাউকে খাওয়াচ্ছি না, আপনারা ইনহেল না করলেই হল।'
ঝগড়া ক্রমেই জমে উঠছে!
ঝগড়া ক্রমেই জমে উঠছে!
- 'দাদা বুঝি ডাক্তার?' প্রশ্ন করলেন এক সহযাত্রী। আমি ওঁর হয়ে উত্তর দিলাম- 'হ্যাঁ, অগ্রদ্বীপে ডাক্তারি করেন'।
- 'না না, আমার চেম্বার সাঁত্রাগাছিতে, অগ্রদ্বীপে বাড়ি।'
- 'তা কী বলছিলেন ডাক্তারবাবু, ধূমপানের ক্ষতির কথা?' কৌতূহলী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন একজন যাত্রী।
- 'আসলে সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারে অনেকগুলো ভুল ধারণা আছে। যেমন আমার পয়সায় খাচ্ছি, কার বাপের কী! লোকে বোঝে না অ্যাক্টিভ থেকে পাসিভ স্মোকিং আরো বেশি ক্ষতিকর, বিশেষতঃ বাচ্চা, রোগী আর গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে।'
- 'কী সাঙ্ঘাতিক!'
- 'তবে আর বলছি কী! আমার এক বন্ধুর দু-বছরের বাচ্চার কাশি আর সারে না। ভয় হচ্ছিল, ব্রঙ্কাইটিস বা টিবির দিকে না টার্ন নেয়। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি বন্ধুটি বাচ্চা কোলে নিয়ে সিগারেট টানতে টানতে চলেছে। তাকে দাঁড় করিয়ে কড়া ধমক দিই।'
'তারপর?' এবার সেই চেন স্মোকার ভদ্রলোককেও দেখলাম শুনতে আগ্রহী। এদিকে দেখতে পাচ্ছি চারপাশের চোখগুলো বড়বড় হয়ে উঠেছে।
- 'ছেলের কাছে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করাতে এখন ওর কাশি সেরেছে, সম্পূর্ণ সুস্থ। তবে বউ পোয়াতি থাকতে ওর সামনে একটানা খেয়ে যেত, তার এফেক্ট কিছুটা রয়ে গেছে, বাচ্চাটার একটা অ্যাজমার টেন্ডেন্সি আছে।'
গল্প জমে উঠেছে। সিগারেট নেশা কিনা, গাঁজা আর সিগারেটে তফাৎ কী এবং কতটা, বিড়ি ভাল না সিগারেট, ধূমপানে সত্যিই ক্যানসার হয় কিনা, এধরণের নানা প্রশ্ন ছুটে আসতে থাকল চারপাশ থেকে। ফার্স্ট হ্যান্ড আর সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং-এর কথা জানতাম, আজ থার্ড হ্যান্ড স্মোকিং বলে একটা নতুন কথাও শুনলাম। প্রশ্ন আসতে লাগল আর নিত্যানন্দবাবু সাধ্যমত তাদের উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন।
- 'আচ্ছা, আপনি ওই গাঁজাখোর সাধুবাবাকে ভিক্ষে দিলেন কেন? ওর কোন নৈতিক দায়িত্ব নেই বুঝি সমাজের ওপর?' প্রশ্নটা আমার তরফ থেকে এবার।
'এর জবাব আমি আলাদা করে দেব আপনাকে', হেসে বললেন নিত্যানন্দ। 'তবে একটা কথা জানাই, নিকোটিন তো বিষ বটেই, তবে তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর জিনিষ হল 'টার' বা আলকাতরার মত একধরণের চ্যাটচেটে পদার্থ, যেটা ট্র্যাকিয়া বা ফুসফুসের বায়ুপথের ফিল্টার সিলিয়ার ক্ষতি করে লাংস ইনফেকশান এমনকি ক্যান্সারও ঘটায় আর রক্তে মিশে ধমনীর প্রবাহের পথটাকে সরু বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারে। এর ফলে হৃদয়ে অক্সিজেন কমে গিয়ে হার্ট-অ্যাটাক হয়, ব্রেনে অক্সিজেন না পৌঁছে সেরিব্রাল অ্যাটাক হতে পারে বা হয়ত অ্যাঞ্জিওপ্লাস্ট বা বাই-পাস সার্জারিও করতে হতে পারে। এই 'টার' বেশি থাকে তামাকে আর সিগারেটের কাগজেও। সাধুবাবার গাঁজা মস্তিষ্কের পক্ষে বেশি ক্ষতিকর হলেও, টার কম থাকে ওতে, তাতে শরীরের ক্ষতি একটু কম হয়। অবশ্য তার মানে এই নয় যে সিগারেট ছেড়ে আপনারা গাঁজা খান।'
আমাদের এই ডাক্তার বন্ধুর লেকচারের প্রভাবেই হোক বা গন্তব্যস্থল এসে গেল বলেই কিনা, চেন স্মোকার বন্ধুটি অম্বিকা কালনা আসতেই তড়িঘড়ি করে নেমে গেল। গাড়ি এখন প্রায় ফাঁকা। আমাদের ডাক্তার বন্ধুটি দরজার পাশের খালি জায়গায় গিয়ে এবার পকেট থেকে বের করলেন উইলস ফিল্টারের একটা প্যাকেট আর দেশলাই। আমাকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মত একটা হাসি দিলেন।
- 'কী করি মশায়, জ্ঞানপাপী। পুরনো অভ্যাস, কিছুতেই ছাড়তে পারি না। তাই সুযোগ পেলেই লোককে জ্ঞান দিই, যদি সেই সুযোগে নিজের কানেও কিছুটা যায়!'
গাড়ির স্পীড কমে আসছে। নিত্যানন্দ ডাক্তার বলে চলেছেন, 'সাধুবাবার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন না? তাহলে মশাই বলি। ওই সাধুবাবার নাম গৌরাঙ্গ দাস। আমার ছোটবেলাকার বন্ধু। ব্যাটা স্কুলে পড়তেই গাঁজা খেত, আমাকেও ধরায়। অনেক কষ্টে ছাড়তে পেরেছি, তাই আজ এই পার্থক্যটা দেখতে পাচ্ছেন। তবু তো ছেলেবেলার সঙ্গী বলে কথা!'
অগ্রদ্বীপ এসে পড়েছে। টুক করে নেমে গিয়ে ভদ্রলোক ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেলেন।
No comments:
Post a Comment