নানা রূপে ভ্যালেন্টাইন ।।
খৃস্টের আগে প্রাচীন রোমানরা মানতেন প্যাাগান(Pagan) ধর্ম যার মূল ভিত্তি ছিল প্রকৃতি আর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দেবদেবীর পুজা যেমন সূর্য, আগুন, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি। Lupercus ছিল তাদের বন্য পশু ও মেষদের দেবতা। এই দেবতার প্রতি ভালবাসা জানিয়ে যে উৎসব হত তা ‘লুপারক্যালিয়’ (Lupercalia) বা ফেব্রুয়া (Februa) নামে পরিচিত ছিল, যেখান থেকে February মাসের উৎপত্তি। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে ১৩, ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারিতে রোমানরা এই উৎসব পালন করতো। এই পুজার প্রধান আকর্ষণ ছিল লটারি। বিনোদন ও আনন্দের জন্য যুবকদের মাঝে যুবতীদের একবছরের জন্যে বণ্টন করে দেয়াই ছিল এ লটারির লক্ষ্য।
রোমান শাসকেরা একসময় তাদের প্যাগান ধর্ম পরিবর্তন করে খ্রিষ্টানধর্ম গ্রহন করে। কিন্তু তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জনগনের প্যাগান সংস্কৃতি ঠিক রেখে তা খ্রিস্টধর্মের ব্যানারে নিয়ে যায়। যেমনঃ Sunday তে রোমান প্যাগানরা তাদের সূর্যদেবতার পুজা করতো। খ্রিষ্টান হওয়ার পর তারা Sunday কেই তাদের খ্রিষ্টান ধর্মের উপাসনার দিন বানিয়ে নেয়। যাই হোক, জনগনের মাঝ থেকে প্যাগান ধর্মের চিহ্ন মুছে ফেলতে সেন্ট জেলাসিউও নামের পোপ এবার Lupercus এর বদলে খ্রিষ্টান ধর্মীয় সন্ন্যাসী সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর নামে ১৪ ফেব্রুয়ারীকে ভ্যালেন্টাইন ডে ঘোষণা করেন। তখন প্যাগান রোমানদের ‘লুপারক্যালিয়া ’ (Lupercalia) খ্রিস্টানদের ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ তে রূপান্তরিত হয়।
রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস-এর আমলের চিকিৎসক ও ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেনটাইন ছিলেন শিশুপ্রেমিক, সামাজিক, সদালাপী খৃষ্টধর্ম প্রচারক। পেগান রোম সম্রাটের পক্ষ থেকে তাঁকে দেব-দেবীর পূজা করতে বলা হলে ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করায় ও সম্রাটের বারবার খৃষ্টধর্ম ত্যাগের আজ্ঞা প্রত্যাখ্যান করায় রাষ্ট্রীয় আদেশ লঙ্ঘনের দায়ে ভ্যালেন্টাইনকে কারারুদ্ধ করা হয়। সেন্ট কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। তারা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক কথা বলে তাঁকে উদ্দীপ্ত রাখত। এক কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। অনেকক্ষণ ধরে তাঁরা দু’জন প্রাণ খুলে কথা বলতেন। এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যান। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসায় অন্ধ মেয়েটি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। ভ্যালেন্টাইনের ভালবাসা ও তাঁর প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালবাসার কথা সম্রাটের কানে গেলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ২৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। অতঃপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন'স স্মরণে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন' দিবস ঘোষণা করেন।
পাশ্চাত্য দেশে জন্মদিনের উৎসব, ধর্মোৎসব সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই গির্জা অভ্যন্তরেও মদ্যপানে তারা কসুর করে না। খৃস্টীয় এই ভ্যালেন্টাইন দিবসের চেতনা বিনষ্ট হওয়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেনটাইন উৎসব নিষিদ্ধ হয়। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন উৎসব পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিকভাবে এ দিবস উদযাপন করা থেকে বিরত থাকার জন্যে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবস প্রত্যাখ্যাত হয়।
ভালোবাসা দিবস বা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন'স ডে এখন একটি বার্ষিক উৎসবের দিন যা ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা এবং অনুরাগের মধ্যে উদযাপিত হয়। ভারতে এই উৎসব আধুনিক ও পাশ্চাত্যমনস্ক যুবক-যুবতীদের মধ্যে দ্বিধাহীনভাবে উদ্যাপিত হলেও এই ধরণের উৎসব যা বিবাহযোগ্য ছেলেমেয়েদের পরস্পরের সঙ্গী নির্বাচনের ছাড়পত্র দেয়, ভারতবর্ষের বহু স্থানে নানা নামে প্রচলিত আছে।
জীবনসাথী বেছে নেবার ডেটিং পদ্ধতি আমাদের সনাতন সমাজ মেনে নেয় না। তবে ইতিহাস ও পুরাণ সাক্ষী, একসময় প্রাপ্তবয়স্ক ও ইচ্ছুক নরনারীর মধ্যে প্রেমবিবাহ এদেশেও প্রচলিত ছিল আর তাতে কোনও সামাজিক নিষেধাজ্ঞা ছিল না। পরে মুসলমান রাজত্বকালে এ দেশের হিন্দুসমাজ অনেক রক্ষণশীল হয়ে পড়ে আর এধরণের অবাধ মেলামেশার সুযোগটি প্রত্যাহৃত হয়। তবে ইন্ধন যেখানে দুর্লভ নয়, সেখানে আগুন ছাইচাপা থাকলেও একদিন না একদিন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেই। তাই কালে কালে কয়েকটি বিশেষ উৎসবের দিন প্রেমিকদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে।
প্রথমে উল্লেখ করতে হয় গুজরাত ও মুম্বাই-মারাঠওয়াড়া অঞ্চলের নওরাত্রি উৎসব। দুর্গোতসবের মহালয়ার পরদিন থেকে মহানবমী পর্যন্ত ন'দিনের এই বিশাল উৎসবে দাণ্ডিয়া-নৃত্যের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরী পরস্পরে পরিচিত হয় ও মেলামেশার পটভূমি তৈরী করে। অনেকটা এধরণের উৎসব অসমের বিহু ও ঝারখণ্ডের করম, পঞ্জাবে বৈশাখী। তামিলনাডুর অতি-রক্ষণশীল সমাজেও এ বিষয়ে কিছুটা ছাড় মেলে পোঙ্গল উৎসবের চতুর্থ দিন- কাণা পোঙ্গলে। পশ্চিমবঙ্গে গ্রামাঞ্চলে মকর-সংক্রান্তিতে এ ধরণের একটা ছাড় পাওয়া যায় বটে, তবে শহরাঞ্চলে সরস্বতীপূজা বা বসন্ত-পঞ্চমীই এ দিনটিকে চিহ্নিত করে।
এ বছর দুটো দিন প্রায় পরপর এল। সুতরাং সদ্য-বয়ঃপ্রাপ্ত বন্ধুদের এবার পোয়াবারো। ব্যস আর কি? সামনের উচ্চ মাধ্যমিকের কথাটা মাথায় রেখে এগিয়ে চল।
No comments:
Post a Comment