Wednesday, November 26, 2014

কবিতা - সিলেটি রামায়ণ (সংগৃহীত)

সিলেটি রামায়ণ ।।
(সংকলিত)
কবি- সুন্দরীমোহন দাস

ঔ দেখ সূর্য্য উঠইন বিয়ানির বেলা ।
হৌ গুষ্টির দশরথ, রাজা বড় ভালা ।।
তিন বিয়া করছলা রাজার কপাল পুড়িয়া ।
... এক রাণিরও অইল না এক গুয়াও পুয়া ।।
কুবাইতনে আইলা মুনি রাজার অন্দর ।
অভিশাপ দিবার ছলে তাইন দিলা বর ।।
গাট্টা গাট্টা চাইর পুয়া অইল রাজার ঘর ।
বড় রাণির পুয়া রাম, ভরত মাইঝলা্জনর অইন ।।
হরু রাণির দুই পুয়া, শত্রুঘ্ন আর লক্ষইণ ।
দশরথে আইজ্ঞা দিলা, রাম অইবা রাজা ।
শুনিয়া সুখি অইলা, রাজ্যের যত প্রজা ।।
কেকৈর বাপের বাড়ীর বান্দি কপাল পুড়া ।
পিঠ যেলা মনও ওলা, ধনুর লাখান তেড়া ।।
কেকৈরে কইলা গিয়া, রাম রাজা অইত ।
তোর ছাওয়াল ভরত বুঝি ক্ষুদের জাউ খাইত ।
বড় পুয়া রাজা অইলে তুইন অইবে বান্দি ।।
গুসা করি উপাস থাকি পড় গিয়া কান্দি ।
ইতা হুনি কেকৈর মাথা চৌরঙ্গি দিলাইল ।।
গুসা করি উপাস থাকি মাটির উপর হুইল ।
দশরথে দেখি কইলা, ইতা কর কিতা ।।
ঔ দন্ডে দিতাম পারি, তুমি চাও যেতা ।
কেকৈয়ে এ কইলা তেউ রামরে পাঠাও বনে ।।
আমার ছাওয়াল ভরতরে বওয়াও সিংহাসনে ।
কেকৈর কথা হুনি রাজা গলি গেলা ।
কইলা, কান্দিও না গো সুনা, করমু ওলা তুমি চাও যেলা ।।
রাম গেলা বনবাস, ভরত বড় বুকা ।
বওইলা সিংহাসনে তাইন, রামর পাদুকা ।।
বাগে পাইয়া বউ, চুরি করলা রাবন ।
বান্দরর লগে রামে করইন যুদ্ধর আয়োজন ।।
বুদ্ধিমানে জাম্বুবানে কইন লও ঠেলা ।
লঙ্কাত যাইতায় কুন হালার হালা ।।
ফাল মারি হনুমান অইলা সাগর পার ।
লেইনজত্ আগুন বান্ধি করলা লঙ্কা ছারখার ।।
ইবাইদি বান্দর হকল বানাইল এক পুল ।
রাক্ষসে বান্দরে যুদ্ধ লাগলো তুমুল ।।
রাবনর রাক্ষস বংশ উজার করিয়া ।
হুককু হুককু করে বান্দর লেইনজ নাচাইয়া ।।
বান্দর গুষ্টি লইয়া রাম যুদ্ধ করইন ভীষণ ।
রাবন মারি আইনলা সীতা ঔত � রামায়ণ ।।

(Soujanya: Devashis Datta)

বিবিধ প্রসংগ - হাসন রাজা

লোকায়ত সঙ্গীত-সাধনায় হাসন রাজা ।।


'লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যের মাঝার।।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।।
এ ভাবিয়া হাসন রাজা
ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।
জানত যদি হাসন রাজা
বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।'

উপরের লোকগীতিটির রচয়িতা দেওয়ান হাসন রাজা (১৮৫৪-১৯০৬)। ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে অসম ও তৎসংলগ্ন সিলেট অঞ্চলে ৮.৮ রিখটার মাত্রার ভয়ংকর ভুমিকম্প ও তারপরেই ব্রহ্মপুত্রের ভীষণ বন্যায় ব্যাপক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি হয় । এই সময়ে রাজর্ষি হাসন রাজা তাঁর জমিদারির এলাকায় প্রভুত সেবাকার্য চালান । কিন্তু এই ঘটনা থেকে জীবনের অনিত্যতা ও ঈশ্বরের মর্জির কাছে মানুষের অসহায়তা তিনি সম্যক ভাবে উপলব্ধি করেন, যার প্রতিফলন পড়ে পরবর্তী এবং বিশেষতঃ উপর্যুক্ত লোকগীতিতে ।
হাসন রাজার জন্ম হয় সিলেটের সুনামগঞ্জ বিভাগের লক্ষণশ্রী গ্রামে । তাঁর পিতা দেওয়ান আলি রাজা ছিলেন একজন জমিদার ও হিন্দু রাজা বীরেন্দ্রনাথ সিংদেওএর বংশধর । পিতা ও জ্যেষ্ঠভ্রাতার অকাল্প্রয়ানে খুব কম বয়েসেই জমিদারিতে হাতেখড়ি হয় হাসনের । সেই সাথে শুরু হয় এক নতুন ধারার জীবনদর্শনের, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তীকালে যার অকুণ্ঠ প্রশংসক ছিলেন । বস্তুতঃ, হাসন রাজা সম্বন্ধে বৃহত্তর বিশ্বের পরিচয় ঘটান কবিগুরুই ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া একটি বক্তৃতায় । অবশ্য তার আগে ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৫ Indian Philosophical Congress-এর প্রথম অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি প্রসঙ্গক্রমে হাসন রাজার দুটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে তাঁর দর্শন চিন্তার পরিচয় দেন। ভাষণটি 'Modern Review' ( January 1926 ) পত্রিকায় 'The philosophy of Our People' শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' ( মাঘ ১৩২২ ) পত্রিকায়। তার একটি নীচে উদ্ধৃত করলামঃ
'মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন
শরীরে করিল পয়দা শক্ত আর নরম
আর পয়দা করিয়াছে ঠান্ডা আর গরম
নাকে পয়দা করিয়াছে খুসবয় বদবয়।'
১৯৩৬ এ রচিত এই কবিতাটির সাথে দেখুন তো, কোনও মিল পাওয়া যায় কিনা-
'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চূনি উঠল রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো পূবে পশ্চিমে ।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম 'সুন্দর',
সুন্দর হল সে ।'

প্যারডি-ছড়া - দিন-ক্ষণ নাহি গণি...

দিন-ক্ষণ নাহি গণি-
ভাবি দিন-রজনী।
এই লর্ডসে কবে তুমি হারিবে আবার,
ওহে, ব্রিটিশ-বাহিনী !!
ইশান্ত সাগরে তুফানে ও ঝড়ে
ডুবিল ব্রিটেনের ক্রিকেট-তরণী।।
নাচাও কি ব্যাটস্‌ম্যান বাইশ গজেতে
লাফায় কি বাউন্সার ও ভাঙ্গা পিচেতে!
তালগাছের দোসর তুমি সাতটি শিকার
মারি রচিলে কাহিনী !।

(বহুদিন পরে ভারতীয় ক্রিকেট টীম ইংলণ্ড গিয়ে ব্রিটিশ টীমকে টেস্টে হারিয়ে আসার প্রতিক্রিয়ায়)
২১শে জুলাই, ২০১৪।

রবীন্দ্র-সংখ্যা 'অবসর'-এ প্রকাশিত বিশেষ রচনা- এলেম নতুন দেশে

এলেম নতুন দেশে
পল্লব চট্টোপাধ্যায়
১ - প্রস্তাবনা
      এক পাড়াতুতো দাদার পড়ার বইয়ে কবিগুরুর লেখা একটি অদ্ভুত রচনা কৌতূহলবশত: পড়ে ফেলেছিলাম, 'একটা আষাঢ়ে গল্প'। এক দেশের রাজপুত্র-কোটালপুত্র-সদাগরপুত্র মিলে এক অচেনা দ্বীপে উদ্ভট কিছু মানুষের সন্ধান পায়, যারা তাসের পরিচয় নিয়ে থাকে এক জীবন্মৃত জাতি হয়ে। সহজেই বোঝার গল্প, কিন্তু কিছুই বুঝিনি তখন। যখন সময় এলো, দেখি সিলেবাস, বই সব বদলে গেছে। তার বছর দুই পরে 'তাসের দেশ'এর রেকর্ড আসে বাড়িতে। ওমা, দেখি এতো সেই গল্প, একটু বদলে গীতি-নাটকের রূপ দেওয়া হয়েছে। নাটকটার মধ্যে একটা অভিনবত্ব ও উন্মাদনা ছিল, যার ফলে ওটা আমার প্রিয় গীতি-নাট্য হয়ে দাঁড়ায়।
      বছর দু-তিন পরের কথা। তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারিংএর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে বসে আছি আর অবসর সময়ে বোনের গানের শিক্ষিকার কাছ থেকে এক-আধটা স্বরবিতান চেয়ে নিয়ে এসে আমার প্রিয় গানগুলি তোলার চেষ্টা করছি। ব্যাপারটা সহজ নয়, তখন তো আর ইয়ু-টিউবের যুগ ছিলনা যে ইচ্ছেমত যে কোনো গান শুনে নেব আর ক্যারাওকে দিয়ে গাইব। যা হোক, আমার উত্সাহে ঘাটতি ছিল না।
      তখন আমাদের পাড়ার বন্ধুবর্গের মধ্যে একটা উঠতি বয়সের বখাটে-মার্কা প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছিল, তাই এখানে কারো আসল নাম উল্লেখ করছি না, ভালো-মন্দ নির্বিশেষে। তবে পরিবেশ ও সুযোগ পেলে যে তারা ভালো কাজ করে দেখিয়ে দিতে পারে, তার প্রতিশ্রুতি সে বারই পেয়েছিলাম, একটা অবাক করা অনুভূতির মধ্যে দিয়ে। একদিন সকালে দুলালদের বারান্দায় আড্ডা দিচ্ছি। ও বলছিল ওর খুড়তুত বোন নীতা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে এসেছে দুর্গাপুর থেকে, গরমের ছুটিটা এখানেই কাটাবে। মেয়েটা ভালো নাচে, মাস-ছয়েক আগে ওরা 'তাসের দেশ' স্টেজ করে এসেছে দুর্গাপুরে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে এখানকার রবীন্দ্র-পরিষদের স্টেজে ওটা নামানো যাবে না? আমি তো শুনে লাফিয়ে উঠলাম, কেন হবে না? এখন তো সবার ছুটি। পাড়ার লোকেদের যদি সাহায্য পাওয়া যায়, বিশেষ করে বন্ধুদের, তাদের ভাই-বোন-মা-বাবাদের, চেষ্টা করতে দোষ কি!
      ব্যস, সেই মুহূর্তে একটা টাস্ক ফোর্সের ‘কোর টীম’ তৈরি হয়ে গেল। দুলাল যোগাড়ে ছেলে, তাছাড়া ও লিটল থিয়েটার গ্রুপে নাটক করে, ও অভিনয় আর ছেলেমেয়ে যোগাড় করার দায়িত্ব নিল। মাইল তিন দুরে থাকে আমাদের আরেক বন্ধু ভুট্টা, অদ্ভুত নাম হলেও দারুণ আবৃত্তি করে। লম্বা-চওড়া কালো চেহারা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গত রবীন্দ্র-জয়ন্তী অনুষ্ঠানে যখন 'কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও' আবৃত্তি করেছিল, মনে হয়েছিল স্বয়ং অমিত রায় নেমে এসেছে শিলং পাহাড় থেকে। সেই প্রথম মেয়েদেরকে পাবলিকলি 'সিটি' মারতে দেখেছিলাম। তা ভুট্টা তো এককথায় রাজপুত্র করতে রাজি। আর একটু দুরে থাকে তীর্থ, বয়স একটু কম, আবৃত্তিতে তারও জুড়ি ছিল না, সে রাজি হলো সদাগরের রোলে। কিন্তু ওরা তো কেউ নাচতে পারে না! তখন ঠিক হলো, নাচের পার্টি থাকবে আলাদা, তারা শুধু 'লিপ' দেবে। গান-আবৃত্তি-অভিনয় হবে ব্যাক-স্টেজ থেকে। কিন্তু এটা কি করা উচিত, পরামর্শ নিতে ছুটলাম বিলুকাকুর কাছে। ওনার বাবা বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ছিলেন, পুরো শান্তিনিকেতনীয় পরিবেশে মানুষ, তিনি শুনে বললেন, এরকম তো হয় বলে শুনিনি। যদিও তাসের দেশ গুরুদেবের শেষ বয়সের রচনা, তবু মনে আছে, নন্দলাল, শান্তিদেব, দিনুদা, অমিতাদি, মোহরদি এনারা নাচ গান অভিনয় সব একসাথে করতেন। পরে গানের দল আলাদা হলো। মনে পড়ে তাসের দেশের রিহার্সেলে জর্জদার উদ্দাম 'বাঁধ ভেঙ্গে দাও' এর সাথে কেলু নায়ার ছাড়া আর কেউই নাচতে পারছিলেন না, শেষমেষ গানটার থেকে শান্তিদা জর্জদাকেই বাদ দিয়ে দিলেন। যাহোক, ওনার সামনে নীতা আর ওনার মেয়ে বুড়ি রাজপুত্র-সদাগরের অভিনয় করে দেখল, সাথে ভুট্টা-তীর্থর সংলাপ, দেখে বিলুকাকু মুগ্ধ। বা:, এটা তো বেশ হচ্ছে, চলুক তাহলে।
      ব্যস, আমাদের আর পায় কে! গানে থাকলাম পুরুষকন্ঠে আমি, মিন্টু আর শান্ত। আমার গলা তেমন নয়, তবে স্টেজে উতরে যাব, এ ভরসা ছিল। সঞ্জয়দাকে ধরেছিলাম, ওসব ছেলেমানুষিতে আমি নেই, বলে কেটে পড়লেন। দুটি বাচ্চা ছেলে, জয় ও বুবাই(দুলালের ভাই) দের রাখা হলো পঞ্জা- ছক্কার রোলে। ওরা বেশ জমিয়ে তুলল, পিছন থেকে সংলাপ পড়ছিলাম আমি আর দুলাল, ঠিক রেকর্ডের মতই কেটে কেটে। প্রথম দিকে নাচের ছেলে-মেয়ে যথেষ্ট পাওয়া যাচ্ছিল না, কিন্তু পরে দেখা গেল, এত মা-বাবা তাঁদের বাচ্চাদের নিয়ে আসছেন যে বাছাই শুরু করতে হলো। তবু একজন হোমরা-চোমরা রাজা দরকার, নাচতেও হবে না তাকে। একদিন আমাদের উপরতলার শ্রীমতি বাগচী এসে বললেন, 'ওই রোলটা রবি ঠাকুর আমাকে ভেবেই লিখেছিলেন', এবং সত্যি, তিনি বেশ মানিয়েও গেলেন। রুইতনের জন্যে নেওয়া হলো তাপ্তী বলে একটি মেয়েকে- নাচে ভালো, মিষ্টি চেহারা, কিন্তু মুখে সদাই একটা কান্না-কান্না ভাব। আর থাকলো দুলালের বোন তন্বী, দেখতে সাদামাটা, কিন্তু ক্লাসিকাল নাচে পারদর্শী, ও থাকলো রুইতনী আর পত্রলেখার জোড়া ভূমিকায়; এদের কথায় পরে আসছি।

২ - মহড়া

      কথা হলো রবীন্দ্র-পরিষদের সাথে। রবীন্দ্র-জয়ন্তীর আর দেরী ছিল না, তাই স্টেজ পাওয়া গেল তার পরের রবিবারে। তাতে অবশ্য আমাদের ভালই হলো, কিছুটা সময় পাওয়া গেল প্রস্তুতির। এবার দরকার একজন দক্ষ পরিচালকের, যিনি ভুল-ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দিতে পারবেন, অথচ কেউ গোলমাল পাকাতে পারবে না। তাই এক সন্ধ্যাবেলা আমি প্রদীপকাকুর বাড়ি হানা দিলাম। উনি ফিজিক্সে ডক্টরেট হলেও সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, যেতেই বললেন, আমি তো ক্ল্যাসিকালের ভক্ত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপারে তোর কাকিকে ধর। কাকিমা স্নানে গেছেন, তাই তিনি গ্রামোফোনে একটা রেকর্ড চড়িয়ে দিয়ে বললেন, শোন, রবি ঠাকুরের ওরিজিনাল গলা, এইমাত্র একজন শুনতে দিয়ে গেল। শুরু হলো, 'গান কণ্ঠে নিলাম, আমার শেষ পারানির কড়ি'। 'গান গেয়ে তারে ভোলাব' পর্যন্ত হতেই ভেতর থেকে কাকিমার গলা পেলাম, ওটা কে গাইছে, বন্ধ কর, ইস, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বারোটা বাজিয়ে দিলে। এমন সব লোকে আজকাল রেডিওতে চান্স পায়! বলতে বলতে বাইরের ঘরে এসেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় পড়ে গেলেন। তাইত, এতো গুরুদেবের গলা। ভাবুন দেখি, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর মেয়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসামান্য জ্ঞান, আর তিনি কিনা! যাক, বিশেষ কিছু করতে হবে না শুনে শ্রীমতি মিনু ঘোষ পরিচালিকার দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন।
      মহড়া পুরোদমে চলছে। মিনুকাকিমা রুইতনকে ডেকে বললেন, নাচ তো সুন্দর হচ্ছে, তা কাঁদ কেন মা জননী? পিছন থেকে একটি মেয়ে ফক্কুড়ি করে বসলো, কি করি, আমার বদনই এমনি। সাথে সাথে হাসির হুল্লোড়। তন্বীকে কেউ ভুল করেও সুন্দর বলবে না, তাই ছক্কা 'সুন্দরী, তুমিই আমাদের পথ দেখাও' বলতেই সমস্বরে খুক-খুক কাশি শুরু হয়ে গেল। তার একটা সংলাপ ছিল, 'হঠাত মনে হলো আমি মালিনী'; তৎক্ষণাৎ মিন্টু নকল করে দেখালো, 'আমি হেমা মালিনী!' এবার অনেক কষ্টে মেয়ের রাগ ভাঙানো হলো। তারপর হারমোনিয়াম নিয়ে কাড়াকাড়ি। মৌ মেয়েদের বেশিরভাগ গানই গাইছে। সে আবার নিজে হারমোনিয়াম না বাজিয়ে গাইতে পারে না, আবার সব গানের সাথে বাজাতেও পারে না। সুতরাং আমি লীড করি, আর ওর গান এলেই হারমোনিয়াম কেড়ে নেয় আমার কাছ থেকে। ঠিক করা হলো অনুষ্ঠানের দিনে দুখানা হারমোনিয়াম থাকবে, যদি টিউনিং ম্যাচ করে।
      ইতিমধ্যে গায়কদের মধ্যমণি শান্ত বলে বসলো, দাদা, খোল না হলে কয়েকটা গান মোটেও জমবে না। 'আমরা নূতন যৌবনেরই দূত', কীর্তনাঙ্গের 'বল সখী, তারই নাম আমার কানে কানে'- এসব গান তবলায় কেমন জোলো লাগছে| অবশ্য গৌতম তবলা ভালই বাজাচ্ছে, তবু দুলাল কোত্থেকে বুড়ো নামে একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে নিয়ে এলো- উ: কি হাতের কাজ ওই বয়েসে! লোধকাকু ছিলেন খোলে ওস্তাদ, তা তিনি তো আর বসবেন না বালখিল্যদের মাঝে, তাই ওনাকে একদিন রিহার্সেলে ডেকে আনলাম, একটু গাইড করার জন্যে । উনি ভ্রূ কুঁচকে বললেন, একি হচ্ছে, 'আমরা নূতন যৌবনেরই.....' তে দাদরা বাজাচ্ছো কেন? ওটা ষষ্ঠী তাল। বেচারা বুড়ো অতশত জানেনা, তবে ২-৪ মাত্রা বুঝিয়ে দিতেই ধরতে পারল, গান জমে উঠল। শ্রীমতি লাহিড়ী, অমন সফিস্টিকেটেড মহিলা, অথচ হরতনির সংলাপে আগাগোড়া বলে গেলেন 'সমস্ত প্যাখম ছড়িয়ে দিয়ে', এবং শেষ পর্যন্তও ওটা শোধরানো গেল না। একদিন ছক্কার রোল পড়তে পড়তে দুলাল বলে উঠল, আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথ ছক্কাকে দিয়ে কোট কেনা করিয়েছিলেন কেন বলতে পারিস, শেষে এই গরমে কোট গায়ে নামতে হবে নাকি আমার ভাইটিকে! আমি অবাক হয়ে বললাম, সেকি কোথায় আছে এরকম? কেন, 'এতকাল যে সব ওঠাপড়া শোয়াবসার কোটকেনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলুম, তার অর্থ কি?' শুনে আর হেসে বাঁচি না। ছাপার ভুল-ও ছিল স্বরবিতানের টেক্সট-এ। ভাবছিলাম, হরতনি কেন বলছে 'ঘরে থাকার মত অশুচিতা নেই'। রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখে শেষে 'ঘরে'-কে 'মরে' করে দেওয়া হলো।
      সব তো হলো, এবার চিন্তা সাজসজ্জা নিয়ে। তাসের সাজ চাই, সিল্কের কাপড়ে হরতনের রানী, টেক্কা, ইস্কাবনের রাজা, গোলাম, দহলা, নহলা, চিড়েতন, রুইতনের বিভিন্ন তাস আঁকতে হবে, ফেব্রিক রঙ্গে, অত খরচ কে যোগাবে! আমার মাথায় এলো, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের জমা নেওয়া ড্রয়িং-শীট গুলো তো পরে ফেলেই দেওয়া হয়, সেগুলো আনা যায় তো! যেই ভাবা সেই কাজ। একদিন এক চেনা প্রফেসরকে ধরে পঞ্চাশ-ষাট খানা ব্যবহার করা কাগজ নিয়ে এলাম। পাশের বাড়ির নিত্য আর মিন্টু পোষ্টার কালার নিয়ে বসে গেল, হুবহু প্যাকেটের তাসের আদলে সবকটা তাস আঁকা হলো প্রতিটা দুটো করে, ঠিক হলো শক্ত সুতোয় বেঁধে গলা দিয়ে বুকে-পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে যাতে পেছন থেকেও সবাইকে চেনা যায়। রাবণ গোস্বামী নামকরা ডেকোরেটর-কম-মেকাপম্যান, নিয়েছেন সবাইকে সাজানোর দায়িত্ব। ওনার নাম নবকুমার, কিন্তু নাটকে রাবণ করে এত বিখ্যাত হয়ে যান ভদ্রলোক যে লোকে ওনার আসল নামটাই ভুলে গেছে। মজা হয়েছিল শো-এর দিনে, মাইকে কল করা হচ্ছে নবকুমার গোস্বামী গ্রীনরুমে আসুন, উনি বসে শুনছেন, কিন্তু নড়ছেন না। আসলে ব্যবহার না হওয়ায় নিজের নামটাই যে ভুলে গেছেন তিনি। আমাদের পাড়ার ছেলেরা, যারা কোনদিন কোনো সাংস্কৃতিক কাজে থাকেনি কখনো, তারাই দায়িত্ব নিল মঞ্চ ও আলোকসজ্জার। এবার আমরা মাঠে, থুড়ি, স্টেজে নামতে তৈরি।


৩ - অনুষ্ঠান

      শো-এর আগের দিন ছিল স্টেজ রিহার্সেল। মোটামুটি উতরে গেল। ৪০'x৩০' এর মঞ্চ, বাইরে খোলামাঠে দর্শক বসবে, বুকে দুরু-দুরু শুরু হয়ে গেছে। নেমে আসছি, এক ভদ্রলোক হিন্দিতে প্রশ্ন করলেন, গল্পটা আমায় মোটামুটি একটু বুঝিয়ে বলতে পারবেন? তিনি ধানবাদ থেকে প্রকাশিত হিন্দি দৈনিক 'আওয়াজের' সাংবাদিক ও কলা-সংস্কৃতি বিভাগের যুগ্ম সম্পাদক। আমি ওনাকে যথাসম্ভব হিন্দি করে তাসের দেশের গল্প ও বক্তব্যটা বুঝিয়ে দিলাম। তিনি খুশি হয়ে বিদায় নিলেন।
      পরদিন শো। সকাল থেকেই বেশ গরম। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই আমরা মোটামুটি তৈরি হয়ে পৌঁছে গেছি পরিষদে। দেখি শ'চারেক চেয়ার এসেছে। এদিকে কারো খেয়াল নেই যে ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে না হলেও ধীরে ধীরে আকাশ কালো করে ফেলেছে। আমরা একফাঁকে পরিষদের সেক্রেটারিকে ধরে একটা অল্টারনেটিভ ব্যবস্থার ব্যাপারে অনুরোধ করে এলাম।
      সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ পর্দাটা একটু ফাঁক করেই দেখি লোকে লোকারণ্য। আর শুধু বাঙালি নয়, কবিগুরুর নাটক, বিহারের(এখন ঝাড়খণ্ড)বাংলা বর্ডারের ছোট শিল্প-শহরটিতে বহু অবাঙ্গালিই বাংলা বোঝে। তাছাড়া নাচগানের উৎসব দেখার লোভটাও ত আছে, ফলে ভিড় একটু বেশিই হয়েছে। অনুষ্ঠানের একটু দেরী আছে, একফাঁকে দর্শকদের মধ্যে নেমে ক্যাজুয়ালি ঘুরে এলাম। দেখি এককোণে চারপাঁচজন মস্তান-গোছের ছোকরা গুলতানি করছে-'আমরা শালা চিল্লাবই। সব জায়গায় হুজ্জত করি, এরা কি কোনো ইস্পেশাল!' একটু দূরে দেখি বাদল ওরফে পাগল চক্রবর্তী কাঁধে বিখ্যাত ঝোলাখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখে হেসে বলল, 'কমরেড, এগিয়ে যা, দেখি বুর্জোয়া পাবলিক কে কি করতে পারে!' সামনের দিকে এসে দেখি, বাবা, বিলুকাকু, প্রদীপকাকু, ভুট্টার বাবা, সবাই আড্ডা দিচ্ছেন। দেখে একটু ভরসা হলো। এবার শুরু হবে শো, আমি ব্যাকস্টেজের ছোট পর্দাঘেরা জায়গাটিতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলাম।
      বাইরে মেঘ ছেযেছে চারদিকে, তার মাঝে সমবেত নাচ 'খরবায়ু বয় বেগে, চারিদিক ছায় মেঘে' দিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। পরিবেশের সাথে অদ্ভুত সামঞ্জস্যের ফলে দর্শকমনে রং ধরতে দেরী হলো না। তারপর সুদীপের মিষ্টি বাঁশির একটা ধুনের সাথে, বোধহয় মন উদাস করা বারোয়া ধরেছিল, প্রথম দৃশ্য শুরু হলো। সংলাপের সাথে অভিনয় জমে উঠেছে, এমন সময় পত্রলেখার বেশে তন্বীর প্রবেশ। সদাগর বলে উঠলো- 'ওগো পত্রলেখা, আমাদের রাজপুত্রের গোপন কথাটি হয়ত তুমিই আন্দাজ করতে পারবে, একবার শুধিয়ে দেখো না'। তৃষ্ণাদি তন্বীর দিদি, গেয়ে উঠলো, 'গোপন কথাটি রবেনা গোপনে'। এইবার হলো ঝামেলা। শান্ত গাইল, 'না,না, না, রবেনা গোপনে'; তারপর তৃষ্ণাদি 'গোপন কথাটি' বলার পর অন্তরা ধরা হবে। তা না করে তিনি স্থায়িতে আবার ফিরে এলেন। পত্রলেখা পাকা নাচিয়ে, একবার থমকে থেমেই তাল ধরে নিল, ফলে ব্যাপারটা ম্যানেজ হয়ে গেল।
      এরপর রাজপুত্রের 'যাবই আমি যাবই ওগো বাণিজ্যেতে' গানের সাথে উদ্দাম নাচে 'ঝড়ো হাওয়া কেবল ডাকে' বলতেই শুরু হয়ে গেল ঝড় ও বৃষ্টি, নবীনা আসার আগেই শো থামিয়ে দিতে হলো। লাল্টু একফাঁকে দর্শকদের অনুরোধ করে ঘোষণা করে দিল- আপনারা যাবেন না, নাটক হবে, নিশ্চয় হবে। তারা পাড়ায় অপাংক্তেয় ছিল এ সব কাজে, এখন সুযোগ পেয়ে ছাড়তে কেউই চায় না; অথচ বৃষ্টি থামার নাম নেই। এবার আমরা সেক্রেটারি সুকুমারবাবুকে ধরলাম, ভিতরের হলে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। উনি অভিজিতদা, নিমাইদার সাথে কথা বলে সব করেই রেখেছিলেন, বললেন, ব্যবস্থা হয়েই আছে, শুধু চেয়ারগুলো ঢোকাতে হবে। তবে জানই তো, স্টেজ একটু ছোট, হলের ক্যাপাসিটি কম, তাছাড়া আলোর জোগাড় বেশি কিছু হবে না, দুটো ফুটলাইট আর দুটো পেডেস্ত্রাল দিয়েই চালাতে হবে। কোই পরোয়া নেই, বলে আমরা হাতে হাতে চেয়ার ঢোকাতে শুরু করলাম। প্রথম দৃশ্যে দর্শকরা এত আচ্ছন্ন হয়ে গেছেন যে তাঁরা দাঁড়িয়ে ভিজছেন কিন্তু কেউ ফিরে যাচ্ছেন না। এবার ভিতরের হল খুলে দেওয়া হলো। চারশ ক্যাপাসিটির হলে অন্তত: ছ'শো লোক বসে-দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগলেন, ভাগ্য ভালো, এত দুর্যোগের মধ্যেও পাওয়ার ফেল করেনি!
      না:, এত সবের পরেও কিন্তু কারো উত্সাহে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পরেনি, না কলাকুশলীদের, না দর্শকদের। কবিগুরুও তা জেনেই লিখেছিলেন কিনা-
'একাকী গায়কের নহে ত গান, মিলিতে হবে দুইজনে,
         গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে।'
      সত্যিই তো, এমন সমন্বয় না থাকলে কি কোনো শিল্প-কলা বেঁচে থাকতে পারে?
      দর্শকদের অনুরোধ, গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। তা আর সম্ভব নয়, খর-বায়ুর দল পোশাক বদলে ফেলেছে, তাদের এখন তাস সাজতে হচ্ছে। অগত্যা রাজপুত্র-সদাগরের প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু হলো। দ্বিতীয় দৃশ্যে তাসেরা নামতেই জমে উঠলো পালা। তাসেদের অপরূপ পোশাক, তোলন-নামন আর যুদ্ধ দেখে দর্শক আর হেসে বাঁচে না। পঞ্জা-ছক্কার কাটা-কাটা কথাগুলোও দেখি সবার খুব পছন্দ হয়েছে। সুদীপের গলায় রাজা যখন ছড়া শোনালো-
'শান্ত যেই জন। যম তারে নেড়ে চেড়ে ঠেলে-ঠুলে দেয় ফেলে, বলে, মোর নাহি প্রয়োজন।’ -
      তাতে হাততালি এত পড়ল, আর এনকোর, এনকোর চেঁচামেচি শুরু হলো, যে ওটা ওকে আরেকবার করে দেখাতে হলো। এমনকি ভুঁইকুমড়ো ডালের জায়গায় যে সদাগর একটা আমপল্লব সমানে নাড়িয়ে গেল, সেটাও কেউ লক্ষ্য করলো না! আমার দুটো একক গান ছিল এখানে রুইতনের নাচের সাথে, 'তোমার পায়ের তলায় যেন গো রঙ লাগে' ও ‘উতল হাওয়া লাগলো আমার গানের তরণীতে', সুন্দর উতরে গেল।
      শেষদৃশ্যে বুড়ো নিমতলায় রাজসভা বসেছে। একে একে সবাই আসছে। একি, ড্রয়িং শীটগুলো সব গেল কোথায়? কারো খুলে পড়ে গেছে, কারো বা একটেরে হয়ে ঝুলছে। পাবলিক হই হই করছে, এমন সময় রাজা বলে উঠলেন, 'সভ্যগণ, তোমাদের আজ চেনা যায় না- সভার সাজ নেই, অত্যন্ত অসভ্যের মত!' তখন অন্য তাসেরা সমস্বরে বলে উঠলো, 'দোষ নেই। ঢিলে হয়ে গেল আমাদের সাজ, আপনি তা পড়ল খসে'। এবার খেয়াল হলো আমার। সত্যিই ত! তাসের সাজ পরে ত কখনো মহড়া হয়নি, তাই শেষ দৃশ্যে ওগুলো খুলে ফেলতেও বলা হয়নি। ভাগ্যিস সবাই বুদ্ধি করে নিজেরাই সব খুলে ফেলেছে। আর ভাগ্যিসই বা বলব কেন? তার মানে এই দাঁড়াল যে ছোট-বড় সবাই তাসের দেশের থিমটা ধরতে পেরেছে, আর তা বুঝেই অভিনয় করেছে, তাইনা সেটা এত প্রাণবন্ত হয়েছে। এবার দর্শকরাও বুঝতে পেরে সাজ-সজ্জাহীন তাসেদের নতুন রূপকে তালি দিয়ে স্বাগত জানাল। কিছুক্ষণ পরে বাঁধভাঙ্গা নাচের ঢেউয়ের সাথে অজস্র হাততালির ঢেউ মিশে অনুষ্ঠান শেষ হলো।
      হঠাত খেয়াল হলো, ওই 'চিল্লানেওয়ালা' 'হুজ্জত-ওয়ালা' পার্টিটাকে তো দেখলাম না, তারা কি ঠেকায় পড়ে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করলো?

৪ - উপসংহার

      পরদিন মিনুকাকিমা দেকে পাঠালেন আমাকে আর দুলালকে। গেলে পর পাঁচখানা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নে, ধর, সাজসজ্জা, রিহার্সেল, আনুষঙ্গিক খরচা আর পিডিআই এর GM এর তরফ থেকে পুরস্কার, সব মিলিয়ে সুকুমার এটা দিয়েছে তোদের জন্যে। আর জানিস কি হয়েছে, আমি কথায় কথায় বলছিলাম তাসের দেশের রাজপুত্রের চরিত্রটা রবীন্দ্রনাথ নেতাজিকে দেখেই লেখেন, বইটাও ওনাকেই উৎসর্গ করেছেন। তাই শুনে উত্সাহিত হয়ে জয়-হিন্দ ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ধরেছে আমাকে নেতাজি-জয়ন্তীতে ওদের ক্লাবের মাঠে এই নাটকটা নামাবার জন্যে, খরচাপাতি সব দেবে ওরা। ইতিমধ্যে আমরা এখানে আছি খবর পেয়ে ভুট্টা তীর্থকে স্কুটারে বসিয়ে নিয়ে হাজির। কথাটা শুনেই ক্ষেপে উঠে বলল, আমরা কি পাগল না প্রফেসনাল। সবাই ছাত্র, পড়াশোনা আছে। তবে এই টাকাটা কাজে লাগবে। এতদিন কষ্ট করে অনেক সাইকেল ঠেঙিয়েছি, সাজ-সজ্জার ড্রয়িং কাগজ তো কলেজ থেকেই এসেছে। এ টাকায় এখন পোলাও-মাংস হবে, বলেই একটা নোট আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল, ফেরার সময় নিতাই মোদককে এডভান্স করে দেব। আপনার বাগানটা কিন্তু শনিবার সন্ধ্যেয় চাই, কাকিমা।
      ইতিমধ্যে লাল্টু, নিত্য, তোতা, গোল্লা, নীতা, তন্বী সবাই হাজির। দুজনের হাতে দুটো কাগজ, বাংলা দৈনিক বসুমতী আর হিন্দি আওয়াজ। দেখি দুটো কাগজেই ছেপেছে খবরটা, আমার হিন্দি অনুবাদ-সহ। মিনু কাকি লজ্জিত হয়ে বললেন, দেখলে, কিছুই করলাম না, অথচ নামটা ছেপে দিল কাগজে! দুলাল বলল, আমাদের ফিস্টির যোগাড় করে দিয়েছেন, আর কি চাই? তাছাড়া আপনি না থাকলে অনুষ্ঠানটা হতই না হয়ত, সব খাওয়া-খাওয়ি করেই মরত। ও ঠিকই বলেছে, পাঁঠার মাংস তখন কুড়ি টাকা কিলো, পাঁচশো টাকা সে হিসেবে অনেক।
      এর পরের পর্বটার সাথে গলা আর পায়ের কম, হাত আর জিভের সম্পর্কটাই বেশি, তাই আর এ নিয়ে বিশদ লিখলাম না। তবে শনিবার সন্ধ্যেয় মাংস-পোলাওএর সাথে ভুট্টার গলায় দেবব্রতর গান একটা সারপ্রাইজ ছিল, সেটা সারপ্রাইজই থাক বরং। আমার তখন আর অন্য কিছুতেই মন ছিল না। একটা নতুন দেশে, যার নাম “রবি ঠাকুরের আপন দেশ”, তাতে পা রাখলাম সেটা মনে-প্রাণে উপলব্ধি করে পুলকিত হচ্ছিলাম।

      লেখক পরিচিতি - পল্লব চট্টোপাধ্যায় - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো) প্রকাশিত ।

বাংলা ছোট গল্প - সেরা লাঞ্চ (অফিসের গল্প-৩)

সেরা লাঞ্চ ।।
(ছোট গল্প)

বন্ধুদের মাঝে কখনো-সখনো গল্প হয় কে কোথায় কেমন খেয়েছে, বড় বড় পাঁচতারা হোটেল আর স্পেশ্যালিটি ও ব্র্যান্ডেড রেস্তোরাঁর গল্প, ইণ্ডিয়ান মাল্টি-কাইজিন থেকে চাইনিস-থাই-আরবী-কন্টিনেন্টাল, থীম রেস্তোরাঁ- এসবের আড্ডা। আমি একটু ভোজনরসিক ও নানাধরনের রেসিপি নিয়ে মাঝে মাঝে একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি বলে বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনি ও আড্ডায় যোগও দিই বটে, কিন্তু সংকোচে কাউকে বলতে পারিনা আমার জীবনের সেরা লাঞ্চটির কথা। 'আড্ডা'র বন্ধুদের মাঝে কিছু সমমনস্ক মানুষ পেয়েছি তাই এখানে আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি সে কাহিনী।
আমি তখন শিলচরে। গিন্নী বাপের বাড়িতে। নতুন লোকেশানে ড্রিল হবে তাই রুট ও লোকেশান দেখতে বেরোব আমি আর সহকর্মী বসাক। সাথে অফিসের ড্রাইভার নাথদা জীপ নিয়ে। গাড়ী সহর ছাড়াতেই নাথদা আমাদের খাওয়াদাওয়ার প্ল্যান কি জানতে চাইলেন। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি, খিদে নেই তখনও। বসাক বলল, 'ও করিমগঞ্জে খেয়ে নেব ফেরার পথে'। নাথদা কাছাড় অঞ্চলেরি মানুষ, বললেন, 'হুঁঃ, রূট সার্ভেতে কত যে শহর আর কত হোটেল পড়বে সব জানি। ও সব আমার উপর ছেড়ে দিন'।
এই নাথদাকে একটু বেশী আশকারা দেয় বলে বসাককে সহকর্মীরা, এমনকি জুনিয়াররাও কথা শোনাতে ছাড়েনা। ও আমাদের লেভেলের দু-চারজনকে ছাড়া অবশ্য কাউকেই বড় একটা পাত্তা দেয় না। আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিল ওর ভরসায় থাকলে খাওয়া-দাওয়া জুটবে কিনা। হঠাৎ দেখি গাড়ী ঘুরে নেবে গেল কাঁচা পথে। 'আরে আরে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন', আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। 'করিমগঞ্জ হয়ে পাথুরিয়া-আদমটিলার রাস্তা তো সবার জানা', নাথদা বলল, 'ওদিকে একটা ব্রিজ তৈরি হচ্ছিল বলে রাস্তা বন্ধ ছিল, গ্রামে আমার চেনা লোক আছে, চলুন একবার জেনে আসি।'
পড়েছি মোগলের হাতে! মাইল দশ-বারো যেতেই একটা ছোট গ্রাম পড়ল, সেখানে দেখি পুকুরপাড়ে একটা কুঁড়েঘরের সামনে এসে নাথদা 'জামাই, ও জামাই' বলে হাঁক পাড়ল। দেখি একটি কমবয়সী লোক খালিগায়ে লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এল, গলায় পৈতে ঝুলছে। আরে খুড়ো যে, দেখো কে এসেছে, বলে হাঁক-ডাক শুরু কর দিল। নাথদা বলল, 'না হে জামাই এখন বসছি না, সাহেবদের নিয়ে সাইট যাব, মাকে বল চাট্টি রেঁধে দিতে, ফেরার পথে খেয়ে যাব'।
'নিশ্চয়, এ কি বলার কথা, আপনাদের যত্ন করে খাওয়াই সে সাধ্য নেই আমার, তবে রাস্তায় যা পাবেন, তার থেকে এটাই ভাল। এ অঞ্চলে হোটেল বলে তো কিছু নেই!'
রাস্তায় বসাক গজগজ করতে লাগল, 'কি দরকার ছিল, আপনার ভাইঝিকে কষ্ট দেওয়ার, না হয় একবেলা না খেয়েই থাকতাম'। নাথদা বলল, 'ও তো আমার নিজের ভাইঝি নয়, গ্রাম সম্পর্কে, কাকা বলে। জামাইটি স্কুলের মাস্টার, খুব ভালমানুষ। তাছাড়া ওরা নীচু জাত নয়, যুগীর বামুন।' 'আপনি আর আমাকে বামুন দেখাবেন না নাথদা',আমি খেপে বল্লাম,'মুন্না আলির ক্যান্টিনে রোজ মুরগী সাঁটাচ্ছি- বরং আমাদিগকে খাওয়ালেই ওদের জাত যাবে!'
গাড়ী এগিয়ে চলল। রূট ও সাইট দেখে, প্ল্যান বুঝে জামাইদের গ্রামে যখন ফিরি তখন বেলা আড়াইটে। নাথদা বলল, 'দেখলেন, স্টেট হাইওয়ের রাস্তা বন্ধ, ভাগ্যিস অন্য রাস্তায় এসেছিলাম। করিমগঞ্জেই বা পৌঁছতেন কিভাবে?' মানতে বাধ্য হলাম। তাছাড়া পেটে ছুঁচোরা যা ডন-বৈঠক মারতে শুরু করে দিয়েছে, বুঝলাম, নাথদা বেশ বুদ্ধিমানেরই কাজ করেছে।
আমরা পৌঁছতেই মেয়ে তো রীতিমত হৈ-হট্টগোল শুরু করে দিল। 'এত দেরী করে আসতে আছে, দেখুন তো, আপনার জামাই খেয়েদেয়ে স্কুল চলে গেল, কত আর অপেক্ষা করবে! আসুন সবাই, খাবার তৈরী'।
কি ছিল খাবারে? মোটা ঢেঁকি-ছাঁটা চালের ভাত, মসুর ডাল, হিঞ্চে শাক, পোনা মাছ ভাজা, শিদল-শুঁটকির চাটনি, লাউএর বড়ি চচ্চড়ি আর আলু-পোস্ত। জানি, ফাইভ স্টারের দল নাক কুঁচকোবে, কিন্তু খিদের মুখে, আর সরল গ্রাম-বধুটির যত্ন ও আতিথ্যের গুণে মনে হল যেন অমৃত খেলাম। এমন কি, পাক্কা ঘটি বসাক শুঁটকি পর্যন্ত খেল তৃপ্তি করে। মেয়েটি বারবার অনুযোগ করছিল কিছু খেলাম না বলে, কিন্তু স্বল্পাহারী আমিও তখন তিনবার ভাত চেয়ে নিয়েছি। আসার সময় মেয়ে তো কেঁদেই অস্থির, 'এতদিন পরে বাপের বাড়ি থেকে কেউ এল, কিন্তু দুর্ভাগ্য, তেমন যত্ন করতে পারলাম না'। বসাক কিছু টাকা গুঁজে দিতে চেয়েছিল বাচ্চাটির হাতে, নাথদা আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে,'করেন কি, এটা কি হোটেল? মেয়ে আমার জন্মের মত আড়ি করে দেবে, জানেন!'
এরপর যদি শিলচরে ফিরে নাথদাকে আমরা দু-বোতল বীয়ার খাওয়াই, তাতে কার কি বলার থাকতে পারে!

১৯শে আগষ্ট, ২০১৪।

বাংলা ছোট গল্প - ডাক্তার

 ডাক্তার 


- এই যে তোমরা বল, 'রোগ সারাতে পারে না, সে আবার কেমন ডাক্তার', কথাটা কতটা ভুল, তা জানো?
- মানে কি বলতে চাও, রোগ সারাবে না, অথচ তাকে ভালো ডাক্তার বলতে হবে! মগের মুল্লুক নাকি?

কথা হচ্ছিল ডাঃ উপল রায়, আসানসোলের এক নামকরা ডেন্টাল সার্জনের সঙ্গে, যিনি আবার বৈবাহিক সুত্রে আমার আত্মীয়। আসানসোলের নিউ রোডে আমার বোনের বাসায় সেদিন সন্ধেয় কী কারণে যেন ওদের নিমন্ত্রণ ছিল। খাওয়াদাওয়ার পর ছাতে বসে আড্ডা দিচ্ছি চারজনে, বাকি দুজন আমার ভগ্নিপতি অভি ও তার ভাই অসি। ডাক্তাররা কিভাবে সরল রোগীদের ঠকিয়ে ব্যবসা করে সেই নিয়েই কথা হচ্ছিল। উপল আমাদের বিপক্ষে। আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও যে একটা জগৎ আছে সেইটে প্রমান করতেই সে বদ্ধপরিকর।

- মানে? 'দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ' জাতীয় কোন ব্যাপার আছে নাকি এর মধ্যে? আমার তরফে সারকাজম শুনে হাসে উপল। 
- ওই তো! সব কিছুর মধ্যেই তোমরা অলৌকিকত্ব টেনে আনতে চাও। বেশ, তোমাদের তাহলে একটা সত্য কাহিনী বলি, তাহলে ব্যাপারটা বোধগম্য হবে। এই যে আসানসোল-বরাকর-চিত্তরঞ্জনের মধ্যেকার ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চল, এটা কিন্তু নামেই বাংলা, এখানে প্রায় ৩০-৪০% বিহারী ও ঝাড়খন্ডি আদিবাসী বাস করে। তারা যে সবাই গরিব তা নয়, কিন্তু শিক্ষিত লোক হাতে গোনা যায়। আবার শিক্ষিতদের মধ্যেও বিদ্যার প্রকাশটুকু বাইরে, চারদেয়ালের মধ্যে কিন্তু তারা সেই বউ-ঠ্যাঙানো মধ্যযুগটাকেই আঁকড়ে আছে। এই চিত্তরঞ্জনেই থাকে আমার এক বন্ধু, কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাস করে বিলেতে গিয়ে MRCOG বা সংক্ষেপে গাইনি করে এলো। তারপর মিহিজামে নিজের ক্লিনিক আর ডিস্পেন্সারী খুলল।
- কিন্তু, মিহিজাম কেন?
- আরে, দুটো একই শহর, গা ঘেঁসাঘেঁসি। চিত্তরঞ্জন বেঙ্গলে, মিহিজাম বিহার ছিল, এখন ঝাড়খন্ডে। চিত্তরঞ্জনে কিছু শুরু করতে গেলে নানা পলিটিক্যাল সমস্যা, আর মিহিজামে হোমিও আর বায়ো কেমিকদের রমরমা। দুটিই চ্যালেঞ্জিং, তা প্রবীর, সঙ্গত কারণেই আসল নামটা বলছিনা, দ্বিতীয়টাকেই বেছে নিল। অঞ্চলে নামী ডাক্তারের অভাব, তাই পসার জমতেও দেরী হলো না। কিন্তু কিছু লোকের দেহাতি মনোভাবের জন্যে ওকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল মাঝে মাঝে।
- সেটা কিরকম, অভির প্রশ্ন। এরপরের গল্পটা উপলের ভাষাতেই বর্ণনা করছি।

সেবার এক বিহারী মাইনিং সর্দার, বোধ হয় ভিক্টোরিয়া কোলিয়ারী বা ওদিকে কোথায় কাজ করে, তার কাছে এলো বৌকে দেখাতে, কি না বিয়ের তিন বছর হয়ে গেল, ছেলেপুলে হচ্ছে না। তা প্রবীর যথারীতি ভদ্রলোককে সিমেন টেস্ট আর বৌটির একটা আল্ট্রাসনিক আর সার্ভিক্যাল স্মিয়ার টেস্ট করাতে বলল, ওর ক্লিনিকেই ব্যবস্থা ছিল, হয়ে গেল। দু-দিন পরে বৌকে নিয়ে শাশুড়ি হাজির রিপোর্ট নিয়ে। বললাম, মাজি, তোমার বৌমা ত ঠিকই আছে, তা ছেলের রিপোর্টে একটু খুঁত আছে, তোমাকে বলে তো হবে না, ছেলেকে পাঠিয়ে দিও। মা-টি তো চরম গাঁইয়া অথচ ধড়িবাজ, বলে, 'কা বোলত হো ডাগদর বাবু, মরদমে খোট! দিমাগ ঠিকানে মে বা নু?' প্রবীর দেখল ওকে বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা, বলল বৌ-এর চিকিৎসা করতে গেলেও তো তার মরদের সাথেই কথা বলতে হবে, নচেৎ সম্ভব নয়।

 তা দু-চারদিন পরে লোকটি এল, এবার একা। প্রবীর ওকে বুঝিয়ে বলল, তার স্পার্ম কাউন্ট অ্যাবনর্মালি লো, মোটালিটিও অনেক কম, তাই বেশ কিছুদিন চিকিৎসা করাতে হবে। ও তো রেগে অস্থির, ডাক্তার কিছু জানেনা। কে কবে কোথায় শুনেছে যে পুরুষের দোষে বাচ্চা হয় না। 'মর্দ মে খোট! ই কোনহ বিলায়তি মজাক বা!' এইবার ডাক্তারবাবুর হুঁশ হয়েছে যে কাদের পাল্লায় তিনি পড়েছেন। পুরুষতন্ত্র যে এখানে কত গভীরে শিকড় গেড়ে বসে আছে, তার একটা আভাস পেল এবার। কলকাতার লোক হলে হয়ত তার বিশ্বাস হত না, কিন্তু প্রবীর ওই অঞ্চলের মানুষ, son of the soil। ওর বুঝতে দেরী হলো না এরপর তর্ক চালাতে গেলে লোকটি দলবল নিয়ে আসবে, মারপিট শুরু হবে, হয়ত ক্লিনিকই বন্ধ হয়ে যাবে। আর তা না হলেও, বদনাম, ব্যবসার ক্ষতি। আর এ লোকটি যদি ভালো হয়, কিছুই না করে, তবু সে আর ফিরে ওর কাছে আসছে না, এটা নিশ্চিত। এখন যে তার মনের মত কথা বলবে তার কাছেই সে ছুটবে। অগত্যা প্রবীর এবার একটু নমনীয় হলো।

- আরে ঐসা কুছ নেহি। বিবিজি কা ইলাজ তো করবো পড়ি, পর আপকো ভি থোড়া মজবুত বনাইকে খাতির থোড়া দওয়া-দারু.... এই বলে ম্যানিক্স নামে আয়ুর্বেদিক গুলি লিখে দিলো তাকে, রোজ সকালে দশটা ট্যাবলেট দুধ, মধু আর বাদামের সাথে খাবার জন্যে। অনুপান দেখে ব্যাটা বেশ খুশি, বুঝলো, তাগড়া ব্যাটা বানাবার জন্যে ওর পুরুষত্ব বাড়াতে এই ওষুধ, আর কিছু নয়।
- কিন্তু সত্যি কি এতে কাজ হয়? এবার আমার প্রশ্ন উপলকে।
- কিছুটা হয়। বিশেষত: যদি কোনো সাময়িক অসুস্থতার কারণে কাউন্ট বা মোটালিটি কমে গিয়ে থাকে। তা নইলে পুরুষের কোনো খুঁত থাকলে কৃত্রিম গর্ভাধান ছাড়া কোনো গতি নেই, অবশ্য মেয়েটি যদি নরম্যাল থাকে।
- হুঁ, তারপর কি হলো?

তারপর যথারীতি নাম-কে-ওয়াস্তে চিকিৎসা শুরু হলো মেয়েটির। শুধু নানাধরনের ভিটামিন পিল আর মাঝে মাঝে একটা করে সনোগ্রাফি। সেটাও না করলে সন্দেহ হবে তাই। এই ভাবে দু-বছর চালানো হলো। তারপর একদিন সে ওদেরকে বলল, 'দ্যাখো, আমি চিকিৎসা করে প্রায় সুস্থ করে এনেছি তোমার বৌকে। কিন্তু সমস্যা এতটা বড়, যে কলকাতায় একজন নামী ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তোমাদের, খরচা আছে। প্রায় লাখ-দুয়েক খরচ করতে পারবে?
- বেটোয়া কে খাতির ই কোন বড়ি বাত বা। খরচা-পাতি করব। আপনি ডাক্তারকে সব বুঝিয়ে লিখে দিন।

প্রবীরের এক বন্ধু, ডাঃ চ্যাটার্জি টেস্টটিউব বেবি খ্যাতিসম্পন্ন ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর সহকারী ছিলেন এককালে, এখন নিজেই ফার্টিলিটি ক্লিনিক খুলেছেন কলকাতায় ও বেশ নাম করেছেন। তাঁকে সব কিছু লিখে লোকটিকে ছেড়ে দিল প্রবীর। তারপর দু'টো বছরও যায় নি, ছেলে কোলে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে এসে হাজির বিহারী-দম্পতি। বৌটি পায়ে পড়ে আর কি। বলে, ‘নেহি ডাগদর সাব, ইয়ে বেটা নেই হোতা তো সৌতন কা মুহ দেখনা পড়তা, হমরে লিয়ে তো আপহি ভগবান হো’। ভাবো তো মজা! যেখানে সে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিল, সেখান থেকে একেবারে সোজা দেবতার আসনে!

- কিন্তু তাতে কি প্রমান হলো উপলদা, অসি এবার মুখ খুলল, তাদের যদি শেষমেষ বাচ্চা না হত?
- কিন্তু তার উল্টো দিকটা দ্যাখো। প্রবীর তো ডাক্তার হিসেবে ঠিক কাজই করতে গেছিল, কিন্তু তাতে ওর বদনামই হত, অথচ প্রমান হতনা যে সে খারাপ ডাক্তার। নাঃ, অনেক গল্প হলো, এবার উঠতে হবে, বলে আমাদিগকে ভ্যাবাচ্যাকা করে রেখে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল উপল।

২৮শে জুন, ২০১৪

বাংলা অণু গল্প ৩৪ - সূক্ষ্ম-শরীর (অফিসের গল্প-২)

সূক্ষ্ম শরীর ।।

আজ অনেকদিন আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল...তা বছর দশেক তো হবেই। আমাদের রিগের ইনস্ট্রুমেন্টেশন সেকশানে রবিবাবু বলে একটি তেলুগু ছোকরা ইঞ্জিনিয়ার কাজ করত। কাজে-কর্মে ও মন্দ ছিল না, কিন্তু ওর জনপ্রিয়তা ছিল অন্য একটা কারনে যেটা নিয়ে বাকি রিগগুলোর মধ্যে তাকে নিয়ে বেশ টানাটানি ছিল। সেটা ছিল ওর কাঠির মতো শরীর। অফশোর রিগের বেশ কিছু ইলেক্‌ট্রনিক সার্কিট, প্যানেল বা সেন্সারে ঠিকভাবে কাজ করতে গেলে ম্যানহোল বা ক্যাবিনেটের ঢাকনা খুলে তার ভিতরে ঢুকে যেতে হয়, নয়ত ভাল কাজ হয় না। আর দেহের সূক্ষ্মতার কারনে এ কাজে রবিবাবুর জুড়ি ছিল না।
একদিন হয়েছে এক কান্ড। ইউনিট চালু করার আগে কুলিং ওয়াটার পাম্প অন করতে আমি সাব-বেসে নামছি, সিঁড়ি থেকেই দেখতে পাচ্ছি রবিবাবু হিট-এক্সচেঞ্জারে কিছু একটা করছে। হঠাৎ চোখের পলক ফেলার মধ্যেই দেখি সে গায়েব। গেল কোথায়? প্রায় ১০০ ফুট নীচে উত্তাল সমুদ্র। রেলিঙের ফাঁক দিয়ে পড়ে গেল না তো! একটু দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেলাম। মাই গড! ছয় ইঞ্চি ব্যাসের সী-ওয়াটার ডিসচার্জ লাইনের পাশ থেকে বেরিয়ে এলো রবিবাবু, সশরীরে, নাকি সূক্ষ্ম-শরীরে! তার পর থেকে ওর নামকরণই হয়ে গেল ইউডি (ইউনিডাইমেনশনাল বা একমাত্রিক)।
হঠাৎ একদিন রবিবাবু আমার অফিসে হাজির। 'গারু, একটা কথা ছিল, কিন্তু বলতে সংকোচ হচ্ছে।' জানা গেল, ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে, এক বিশাল অংকের পণের বিনিময়ে। কিন্তু ভাবী শ্বশুরের একটি শর্ত, সমুদ্রের কাজ ছাড়তে হবে। 'আরে তুমিও যেমন, রবি', আমি বললাম, 'চাকরি ছেড়ে দাও, এত টাকা পাচ্ছো, তারপর ব্যবসা কর'। 'না গারু, আমার চাকরির জন্যেই এই বিয়ে, দেখুন না কাউকে বলে কিছু করা যায় কিনা', তার সকরুণ অনুরোধ। কাজটা কঠিন ছিল, নেহাৎ প্রসেসে একজন ইঞ্জিনিয়ার সেই মুহূর্তে দরকার ছিল বলে গ্যাস কম্প্রেশন প্ল্যান্টে ও বদলি পেয়ে, সুরাট জয়েন করতে চলে গেল।
আজ এতদিন পরে তার কথা কেন উঠল? বান্দ্রা থেকে বোরিভিলি শেয়ার ট্যাক্সিতে বসে আছি, ওরা পিছনে চারজন, সামনে দুজন সওয়ারি নেয়। দেখি ড্রাইভার আমায় অনুরোধ করছে সামনের সীটে গিয়ে বসার জন্যে, এক দম্পতি পিছনে বসবেন চারজনের ভাড়া দিয়ে। রবিবাবু আমাকে ঠিক চিনেছে কিন্তু আমি চিনতে পারি নি, কারণ সে তো তখন রীতিমত থ্রী-ডি! শ্বশুর আর তার মেয়েতে মিলে আর চান্স নেয়নি, রবিবাবুর চেহারা এখন আর হাতির আড়ালেও ঢাকা পড়বে না।
১০ই জুলাই, ২০১৪

বাংলা অনুগল্প ৩৩ - সত্যি হলেও গল্প (অফিসের গল্প-১)

সত্যি হলেও গল্প ।।

অনেকদিন আগেকার কথা। প্রজেক্ট অফিসে উচ্চ পর্যায়ের মীটিং চলছে। রিজিওন্যাল ম্যানেজার বেজায় খাপ্পা। কোনও মেসিন ফুল এফিসিইয়েন্সি তে রান করছে না। বিশেষ করে ইলেকট্রিক সেকশানে। পাওয়ার ফ্যাক্টার এত কম কেন? এই যে মিঃ মণ্ডল, চুপ করে কেন, প্লীজ সে সামথিং!
মণ্ডল সাহেব সেকশানের হেড। উনি টাকমাথা চুলকে যাচ্ছেন দেখে পাশে বসা এসিস্টান্ট চন্দ্র কানে কানে কি যেন বলল। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মিঃ মণ্ডলের চোখমুখ। উনি উঠে বললেন, 'স্যার, আমাদের ট্রান্স্‌ফর্মারগুলো দেখুন। ৪৪০ ভোল্টকে ৬৫০এ কনভার্ট করে দিচ্ছে, একেবারে ১৫০ পারসেন্ট এফিসিয়েন্সি!' এই বলে সগর্বে হলের চারদিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। দু মিনিট চুপচাপ, যেন কোনও নেতার মৃত্যুতে শোকপালন হচ্ছে। তারপরেই রাগে ফেটে পড়লেন আর-এম। 'গেট আউট, গেট আউট......' পাগলের মতো চেঁচাতে থাকলেন যতক্ষন না মন্ডল সায়েব হল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পরে ক্যান্টিনে আমরা জুনিয়ার মহলে এ নিয়ে হাসাহাসি করছি। স্টেপ-আপ ফ্যাক্টার হয়ে গেল ট্রান্সফর্মারের এফিসিয়েন্সি, কোথাকার ইঞ্জিনিয়ার উনি! সিন্‌হাদা আমাদের মধ্যে একটু বয়স্ক, ৭০ সালে ঢাকা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে উনি ৭১এর দাঙ্গার সময় রায়গঞ্জে চলে আসেন ও বাকী পড়াশোনা ভারতেই করেন। সিনহাদা বললেন, 'মণ্ডলের গল্প শুনতে চাও তো আমায় জিগ্যেস কর।' আমরা হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠতেই উনি শুরু করলেন।
- '১৯৭১এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে তখনও ভারতের সাড়া পাওয়া যায়নি সাহায্যের। খানসেনা আর তাদের বাংলাদেশী চামচেদেরি রমরমা। হিন্দুরা দলে দলে পালাচ্ছে ইন্ডিয়ার দিকে, পেছনে জামাত-ই-ইসলামের দল তাড়া করে যাচ্ছে, ধরতে পারলেই লুট-অত্যাচার-ধর্ষণ-খুন। একটা দল তখন তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে যশোর থেকে বেনাপোলের দিকে। জামাতিদের ধাওয়া করা দলটাতে একটি ছোকরা ছিল নুরুল হুদা নামে। সরষার কাছে ও একটু পিছিয়ে পড়েছিল দলছুট হয়ে। হঠাৎ একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে দেখে একটা লোক পড়ে আছে রাস্তার ধারে ঝোঁপের ভিতর, মাথায় ভারী কিছুর চোট। নুরুল যেতে লোকটা ততক্ষণে মরে গেছে। পকেট হাতড়ে দেখে পয়সাকড়ি কিছু নেই, শুধু প্লাস্টিক মোড়া একটা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমার সার্টিফিকেট, নাম লেখা নারায়ণ চন্দ্র মণ্ডল। সেই মুহূর্তেই ভাবনাটা মাথায় এল। কি হবে ছাই বাংলাদেশে ফিরে, আর ধর্ম বা জামাত যে গোটা জীবন খাওয়াবে তার গ্যারান্টি কি? আত্মীয়স্বজন বলতেও কেউ নেই, অগত্যা...।
- 'অগত্যা বেনাপোল। বেনাপোল জান তো, যশোর আর চব্বিশ পরগনার মাঝে বাংলাদেশ বর্ডার, গোলেমালে বর্ডার পার হয়ে নুরুল চলে এল পেট্রাপোল, ইন্ডিয়া। এখন তার নাম হল নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল।'
- 'বলেন কি দাদা!' আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম। এই মণ্ডল সায়েবই......
- 'তবে আর বলছি কি। তারপর কলকাতায় এসে উনি ঝটপট করে ফেললেন একটা ইলেকট্রিসিয়ানের কোর্স, নামে মণ্ডল ছিল, পেয়ে গেলেন কাস্ট সার্টিফিকেট। সরকারি চাকরি পেতে আর কি চাই!' চা শেষ করে এবার উঠলেন সিন্‌হাদা, পিছনে আমরা সবাই।
মাস দুই পরে সিন্‌হাদা ধরেছেন আমাকে। 'কি হে মুখার্জি, আমার গল্পটা দিব্যি ছাপিয়ে দিলে যে পত্রিকায়! নেহাত গুলের ওপর কপিরাইট থাকেনা, নয়ত আমি খেসারৎ দাবী করতাম', সিন্‌হাদা হাসলেন দাঁত বের করে।
আমি আর কি করি? বললাম, 'দাদা, আপনার স্টাইলটা যদি বাগাতে পারতাম, আমার গল্পটাকেও সত্যি বলে ধরত লোকে। কিন্তু জানি সেটা আমি এ জন্মে পারবনা'।
কুয়েত, ১৯শে আগষ্ট, ২০১৪।

বাংলা অণু গল্প ৩২ - চিরন্তনী

চিরন্তনী ।।

অহল্যা উদাস হয়ে বাতায়নপ্রান্তে বসেছিলেন। তাঁর প্রতি কঠিন শাস্তি আরোপ করেছেন তাঁর পতিদেব ঋষি গৌতম। প্রস্তররচিত কারার অভ্যন্তরে তাঁকে থাকতে হবে যতদিন না স্বয়ং ঈশ্বর সে কারাগার ধ্বংস করে তাঁকে মুক্তি না দেন। তাঁর বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ এবং তা যে মিথ্যা নয় তা ঋষিও অনুমান করেন, যদিও তাঁর মনে বিশ্বাস যে এর জন্যে দেবরাজই একা দায়ী, গুরুর ছদ্মবেশে......।
চমক ভাঙ্গল পরিচিত কণ্ঠস্বরে। ‘এ কি, ইন্দ্র তুমি! কি সাহসে আবার এসেছ এখানে? আর তোমার শরীরে সহস্র লোচন আঁকা কেন?’
‘ধীরে, অহল্যে, ধীরে। গুরুদেব এখন প্রস্তর-কারাগার নির্মানে ব্যস্ত, এ মুহূর্তে তাঁর এখানে আসার সম্ভাবনা নেই। আর এগুলো লোচন নয়, যোনি-চিহ্ন, গুরুদেবের অভিশাপ।‘
‘তার মানে ঋষির শাপে ফল হয়!’
‘পাগল!’ ইন্দ্র হাসলেন। ‘তোমার নারীত্বের দাবী আমি মিটিয়েছি, করেছি পুরুষের কর্তব্য। কিন্তু সমাজের চোখে আমি অপরাধী, নৈতিকতার দিক দিয়েও। তাই ঋষির মান রাখতে ওগুলো শরীরে আমি নিজেই এঁকে নিয়েছি।‘
‘সে কি! আর অন্য অভিশাপ?’
‘সে তো আর পোষাকের আড়ালে বোঝা যাবে না, লোকে যা খুশী কল্পনা করে নেবে। এখন বল, আমার প্রতি তোমার কোনও অভিযোগ নেই তো?’
‘হে দেবরাজ, তুমি আমাকে পূর্ণ করেছ। দিয়েছ নারীর মর্যাদা। বিশ্বাসহনন আর চরিত্রহীনতার সমস্ত দায় তুলে নিয়েছ নিজের উপর। দোষ তো আমারও কম ছিল না। তোমার ঐ ছদ্মবেশও আমি মুহূর্তেই ধরে ফেলেছিলাম। আর কি করতে চাও তুমি!’
‘দেখ আমি দেবতাদের অধিপতি। স্বর্গমর্তের শৃংখলা রক্ষার ভার আমার উপরে, আর ঋষি গৌতমের হাতে আছে সমাজধর্ম রক্ষার দায়িত্ব। শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। তাই আমি দেবর্ষিকে পাঠিয়েছি ঋষি বাল্মিকীর কাছে। তিনি ইক্ষাকুকুলপতি রামের জীবনকাহিনী রচনা করবেন। তিনি তোমার এই পতিরূপে উপপতিসেবার বৃত্তান্তটাই উল্লেখ করবেন এই কাব্যে।‘

‘তবে আমার ধারণা’, ইন্দ্র বলে চললেন, ‘বিশ্বের লোক একসময় নারীর চোখ দিয়ে সব কিছু বুঝতে সক্ষম হবে, তাই সেই সময়ের নিরিখে আমার সাধনা হবে ভবিষ্যতের নারী যেন আপন ভাগ্যকে জয় করবার অধিকার পায়, আপন মানসিক ও শারীরিক দাবী যেন মুখ ফুটে বলতে পারে, অহোরহ সেই প্রচেষ্টায় রত থাকা।‘
এই বলে দেবরাজ ইন্দ্র বিদায় নিলেন।

মুম্বাই ২৯শে আগস্ট, ২০১৪।

বাংলা অনু গল্প ৩১ - একটি মিথ-থা প্রেমের গল্প

একটি মিথ-থা প্রেমের গল্প ।।

নাঃ, আর পারা যাচ্ছে না। সেই সাড়ে ছটায় অফিস থেকে ফিরেছে উমা। তারপর রান্না শেষ হতে আটটা। দুজনের কাজ, কতটুকু আর! কিন্তু অনিমেষের ফিরতে প্রতিদিন অন্ততঃ এগারটা। তাও বুঝত যদি অফিসে কাটায় সময়টা। ফিরবে তো সেই আকণ্ঠ গিলে। ছেলেকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবার পর আর একা একা সময় কাটে না। অথচ ব্যাপারটা লজ্জার, সবাইকে বলাও তো যায় না! উমা কি ভেবে শেষে শ্যামাকেই ফোন করল। কিছুটা তো সময় কাটুক।
শ্যামা উমার পিঠোপিঠি ছোট বোন। সত্যিই সে শ্যামাঙ্গী, উমার ঠিক উলটো। অথচ ওদের এরকম কোনও জ্বালা নেই। ও আর বর দীপ্তেন্দু দুজনেই একই স্কুলে পড়ায়, একমাত্র মেয়েকেও ভর্তি করেছে সেখানে। খুব উচ্চাশা না থাকলেও নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। শ্যামা একটু অবাকই হল, দিদি এসময় ফোন করায়। 'হ্যাঁ, ভাল আছি, তোরা? জামাইবাবু কোথায়? সে কি, এখনও ফেরেনি! আচ্ছা?...
কথা চলল আধঘণ্টার মত। 'ঠিক আছে, জামাইবাবুকে একটা ফোন করছি। আর শোন, যা বললাম, তেমনটি করবি, কেমন? দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে।' শ্যামা ওদিক থেকে লাইন কেটে দিল।
রাত দশটা নাগাদ অনিমেষ ঘরের বেল বাজাল। ভেতর থেকে শুনল উমার গলা, 'আসছি, এত দেরী করতে হয়, এদিকে অনিমেষের আসার সময় হয়ে গেল।' বলতে বলতে দরজা খুলল উমা। 'ওমা, তুমি!' যেন জোর করে খুশী হবার নাটক করল সে।
'কেন, তুমি কাকে ভেবেছিলে?' গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বলে অনিমেষ।
'আমি! কাকে আবার? আমার আর কে আছে কোন চুলোয়? একটা বোন আছে, তারও তো সময় নেই, নিজের ফ্যামিলি নিয়েই ব্যস্ত!'
'কেন, শ্যামা নাকি কল করেছিল, তুমি ফোন তোলনি!'
'কি জানি, আমি তো শুনিনি, হয়ত বাথরুমে ছিলাম।'
আর কথা না বাড়িয়ে চেঞ্জ করতে গেল অনিমেষ। পরদিন থেকে জানিনা কেন ঠিক সাতটার মধ্যে ঘর ফিরতে লাগল অনিমেষ।

উমাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কাল অফিস থেকে আসার পথে একটা কাজ করতে হবে। এক বোতল ভাল স্কচ আনতে হবে, ব্যাপারটা মহিলাদের পক্ষে শোভন না হলেও। ও হ্যাঁ, আর একটা ফোন, শ্যামাকে, থ্যাঙ্কস জানিয়ে।

কুয়েত, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৪।

অণু গল্প ৩০ - বাপের বাড়ি

বাপের বাড়ি ।।

'তপা রে, তোর শ্বশুরবাড়ি ঘুরে এলাম। উঃ, একটা দুর্ভাবনা কাটল', তরুণ ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই কথাগুলো বলল। কিন্তু যার উদ্দেশ্যে বলা, সে যেন কিছু শুনতেই পায়নি এমন ভান করে যাচ্ছে। 'কি রে, কিছু বলছিস না যে?'
'আমি আবার কি বলব! তোরা ঘাড় থেকে আইবুড়ো বোনকে নামাচ্ছিস, খুশী তো তোদেরই হবার কথা'- তপা ছদ্ম ঝাঁঝের সাথে বলল।
'না রে। তোর বরটা খুব ভালমানুষ, শ্বশুর-শ্বাশুড়িও তথৈবচ। ভাবছিলাম তুই ঝগড়া করবিটা কার সাথে। তা আজ তোর ননদ কুটিলাদিকে দেখে সে চিন্তাটা ঘুচল। আস্ত খাণ্ডারনী একটি!'
'আহা, আমি যেন ঝগড়া করতেই ও বাড়িতে যাচ্ছি! কিন্তু হ্যাঁরে দাদা, সত্যি ওর নাম কুটিলা?'
'দূর বোকা, ঠাট্টাও বুঝিস না! তবে সাবধান, বিবাহিতা হলেও উনি প্রায় সারাক্ষণই বাপের বাড়িতে। সেখানে আবার নিজের বাপের বাড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে যেও না সবসময়।' তরুণের সাবধান-বাণী।

যাক, বিয়েটা ভালয় ভালয় চুকে গেল, ফুলশয্যাও। তারপর একদিন ননদ জয়া ধরেছে তপাকে। 'এই যে দত্তবাড়ির মেয়ে, ওয়েলকাম টু সরকারবাড়ি- এখন থেকে তোমারও বাড়ি এটাই। আমি কিন্তু সে ধরনের মেয়েদের দু-চক্ষে দেখতে পারিনা যারা বিয়ের পরেও বাপের বাড়ির মেয়ে হয়ে থেকে যায়, সারাক্ষণ শুধু বাপের বাড়ির গল্পই করতে থাকে। আমি নাহয় একটু পষ্টো কথা বলি তাই লোকে অনেক কিছু বলে, কিন্তু আমার ভাইটি একেবারে হীরের টুকরো ছেলে, সে যেন কখনও কিছু ফীল না করে। আর মা-বাবা বলতে এখন শুধু তোমার বরের মা-বাবা, এমনকি তোমার কুকুর-বেড়াল বলতেও এ-বাড়ির কুকুর-বেড়াল, বুঝেছ?'
'একশোবার!' তপা একটু অস্বাভাবিক জোর দিয়েই বলল। 'আমিও এগ্‌জাক্টলি তাই মনে করি দিদিভাই। এই দেখ না আমার বৌদিকে। ছিল তো একটা অজ পাড়া-গাঁয়ে। আর আমার দাদা তো কে না জানে চেহারায় গুণে রাজপুত্তুর। বৌদি যা শ্বশুর-শ্বাশুড়ি পেয়েছে, আগেকার দিনের লোক হলে বলত দশরথ-কৌশল্যা- দু'বেলা চন্নামেত্তর খেত। কিন্তু বৌদির সেই এক কথা- আমার বাপের বাড়ি এই, বাপের বাড়ি সেই- তিন বছর বিয়ে হয়ে গেল, এখনও শুধরালো না...।'
'ন্যাকামো দেখে আর বাঁচিনে....অসহ্য.....' কোনমতে রাগ চেপে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এল জয়া!

সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৪; মুম্বাই।

বাংলা অণু গল্প ২৯ - কেউ ফেরে না

কেউ ফেরে না ।।

খাণ্ডোয়ায় ট্রেনটা থামতেই নেমে পড়লেন পুনর্বসু ভট্টাচার্য। এদিক ওদিক তাকালেন একবার। ঐ তো, অর্জুন গাছটা ঠিকই আছে প্ল্যাটফর্মের এককোণে, কিন্তু না আছে সেই ময়না পাখিটা, না গাছের তলার সেই কুকুরটা। তপনই বা কোথায় গেল? এসি কামরাটা দাঁড়ায় প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষে, একটা চা-ওলা শুদ্ধু মেলেনা সেখানে। আর থাকবেই বা কেন? বাবুরা ঠাণ্ডায় ঘুমোবেন বেলা পর্যন্ত, তার পর কেটারিং-এর বাসি স্যান্ডুইচ আর ঠাণ্ডা চা খাবেন আরাম করে। এই পুনর্বসুবাবুর মত দু-চারটে পাগলাটে লোকের জন্যেই তপনের দোকান চলত।

দুর্গাপুরের তপন চক্রবর্তী নিঃস্ব অবস্থায় খান্ডোয়া স্টেশনে কিভাবে এল সে এক অন্য গল্প। বুড়ো ঠেলাওয়ালা বুধন কুশোয়াহার দয়ায় তারই সাথে পাঁউরুটি সেঁকার কাজে লেগে পড়েছিল, সেও প্রায় সাত বছর হল। অপুত্রক বুধনের ঠেলাগাড়ি এখন তপনেরই, বুধনের বিধবা তার আম্মা। আগে এই বোম্বে মেলের শেষ বগিটা ছিল ভীড়ে ঠাসা জেনারেল, একদিন ছক বদলে এসি কামরাগুলো দিয়ে দেওয়া হল সেখানে, ঝপ করে সেল কমে গেল তপনের। তখন সে শুরু করল অমলেট বানানো, তাতে কিছুটা অন্ততঃ সুরাহা হল।

কিন্তু হল কি ছেলেটার, পুনর্বসুর একটু চিন্তা হয় বৈকি! তিনি জব্বলপুরে রেলের ইঞ্জিনিয়ার, তিন কুলে কেউ নেই, অকৃতদার, শখের মধ্যে ব্রিজ খেলা আর বংশসূত্রে পাওয়া সংস্কৃত-চর্চা। বারবার অফিসের কাজে ভুসাওয়াল যেতে-আসতে প্রতিবার দেখা এই নিঃসহায় ছেলেটার প্রতি একধরণের মায়া পড়ে গেছিল। তাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতেও চেয়েছেন, তপনই রাজী হয়নি। এদিকে গাড়ি ছাড়ছে। উনি কি ভেবে কামরা থেকে ব্যাগটা নামিয়ে গাড়ি ছেড়ে প্ল্যাটফর্মের উপর এগিয়ে গেলেন।

ঠিক ট্রেন ছাড়তেই দেখা গেল তপনের ঠেলা। 'ওরে অকাল-কুষ্মাণ্ড, কুঞ্জকুঞ্জর, বন্যবরাহ, দস্যু-বর্বর!' বলতে বলতে পুনর্বসু তপনের হাতদুটো ধরলেন। 'আমি তোর খোঁজে গাড়ি ছেড়ে দিলুম, আর তুই ব্যাটা স্কন্ধকাটা আমাকে ফাঁকি দিতে এখানে এসে বসেছিস!'
'কি করছেন জ্যাঠাবাবু, লোকে দেখছে। এখন আর গাড়ি নেই, চলুন পুরোন জায়গায় গিয়ে বসি'- ওরা এলো সেই অর্জুন গাছটির নীচে। 'আচ্ছা জ্যাঠাবাবু, আপনার কখনও জানতে ইচ্ছে হয়নি কিসের নেশায় আমি স্টেশনের এই এককোণায় এসে ঠেলা লাগিয়ে বসে থাকতাম'?
'কি আবার, তুই তো আমার ব্যাটা, আমারই মত পাগল!'
'অনেকটা তাই বলতে পারেন। এখানে এসেই আমার চোখে পড়ে এই গাছটা, ওই ময়না পাখিটা যে মাঝেমধ্যেই মিষ্টি গলায় শিস দিয়ে উঠত আর গাছের তলায় নেড়িকুত্তাটা সারাক্ষণ মুগ্ধ হয়ে পাখিটাকে দেখত। আপনাকে আবার বলছি, জ্যেঠাবাবু, আমি ওদের কেউ নই, কিন্তু ওই দুটিকে ছেড়ে বেশিক্ষণ কোথাও গিয়ে টিকতে পারতাম না। পাখিরা কদ্দিন বাঁচে জানি না, একদিন ময়নাটা ফট করে মরে গেল। কুকুরটা তিন-চারদিন কোথাও নড়ে নি, আমি পাঁউরুটি দিলে খেত না, তারপর জানিনা কোথায় চলে গেল। তারপর আম্মাও গেল দু'মাস আগে, এখন আর শহরে আমার নিজের বলতে কেউ নেই'- একটু যেন রুক্ষ শোনাল তপনের গলা।
'তবে আর দেরী কিসের? আমার সাথে চল, পড়াশুনা করবি, তারপর রেলে ঢুকিয়ে দেব, কেমন?'
'যাব, জ্যাঠাবাবু। তবে একবার বাড়ি গিয়ে মাকে দেখে আসি। তারপর নিশ্চয়ই যাব।'

পুনর্বসু প্রতিবার ভুসাওয়াল যাওয়া-আসার পথে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন খাণ্ডোয়া স্টেশনের দিকে। নাঃ, তপনের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে- সাক্ষী থাকে নীরব একটি অর্জুন গাছ।

মুম্বাই, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪।

বাংলা অণুগল্প ২৮ - হিন্দু

হিন্দু ।।
স্বদেশ ও স্বরাজ, এই দুই মরাঠি বন্ধুর হাত ধরে মনসিজ দত্ত প্রথম এসেছিল এই সঙ্ঘে। শাখার কার্যবাহী সুভাষচন্দ্র অগ্রবালকে প্রথম দেখেই চমকে উঠেছিল সে। এই ত নেতাজি! খাকী হাফপ্যান্ট, সাদা শার্ট আর কালো টুপি পরে অবিকল তাই মনে হচ্ছিল তার, যদিও পরমুহূর্তেই সে তার ভুল বুঝতে পেরেছিল। 'দাদা, হা আমচা বঙ্গালি মিত্র আহে', স্বদেশ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল তাকে সবার সাথে।
তাহলে আজ মনসিজের খাতিরে একটা বাংলা দেশবন্দনা হয়ে যাক, এই বলে সুভাষদা সবাইকে নিয়ে কোরাসে ধরলেন-
'ওই শোন, জননী ডাকে সবারে।
শঙ্খ বেজেছে বজ্র স্বরে।।
ঝড় উঠেছে দেখ আকাশ জুড়ে
আর কে ঘরে থাকতে পারে...।।'

মনসিজ অভিভূত, এইরকম কোনও প্রতিষ্ঠানের কথা তার জানা ছিল না। প্রত্যেকটি কথায় শুদ্ধ হিন্দী বা সংস্কৃতের প্রয়োগ, ব্যায়াম, খেলাধূলা, গান ও তর্কবিতর্কের অনুষ্ঠান, ইস, এতদিন সে জানতে পারেনি কেন!
সেদিন বিন্দুদা প্রশ্ন তুলেছিলেন, হিন্দু শব্দের অর্থ নিয়ে। প্রায় সকলেই বলল, 'সনাতন ধর্মই হিন্দুধর্ম, যা আগে ভারতবাসীমাত্রেরই ধর্ম ছিল। বিজাতীয় মুসলমান ও খৃষ্টানদের প্রভাবে কালে কালে তা অনেকাংশে হারিয়ে যায়, এবং আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তাকে উদ্ধার করার'। তবে মনসিজ বেশ কিছু পড়াশোনা করেছে এ বিষয়ে। সে বলল, ' সিন্ধুনদের বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে একসময় যে সভ্যতার বিকাশ হয় তার নামই কালে হয়ে দাঁড়ায় সিন্ধু বা হিন্দু সভ্যতা, তা থেকেই হিন্দুধর্ম। অতএব, যাঁরা নিজেদেরকে এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারাবাহক বা অঙ্গস্বরূপ মনে করেন, তাঁরাই হিন্দু, তাঁর পৈতৃক ধর্ম যা খুশী হোক না।'
'এই পরিভাষা তুমি কোত্থেকে পেলে?' ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র মিলিন্দের প্রশ্ন। 'আমি ডাঃ কেশব হেডগেওয়ারের লেখা পড়েছি', উত্তর এল।
সন্ধ্যে হতে চলেছে। পুরো মাঠে কারো মুখে কোনও কথা নেই। শুধু একটানা ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে। প্রার্থনা শেষে বেরিয়ে আসতে আসতে আলগোছে কানে এল সুভাষজি, বিন্দুদাদের কণ্ঠস্বর-'না না, এখন কেউ কিছু বলবে না। খুব সতর্কভাবে এগোতে হবে, নয়ত নাগপুরের সন্মেলনে কি জবাব দেব...'
ঝিঁঝিঁপোকাদের দাপটে পরের কথাগুলো আর শুনতে পায় না মনসিজ। আর শোনবার প্রয়োজনও মনে করে না।
১০ই নভেম্বর, ২০১৪।

বাংলা অণুগল্প- ২৭ - ক্ষিদ্দা ২.০

ক্ষিদ্দা ২.০ ।।

১লা ডিসেম্বর, ২০০৪। ৪৯.১৩ সেকেন্ড। ছেলেটির মুখের দিকে আর-পি-এফের বড়কর্তারা তাকিয়ে আছেন। না, ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে বিশ্বরেকর্ড বা জাতীয় রেকর্ড, এমনকি রাজ্য রেকর্ডও হয়ত নয়, তবে একছুটে ওয়াগন ব্রেকার বা রেল-ডাকাত ধরতে তা যথেষ্ট ভাল, অর্থাৎ বিনয় মণ্ডলের সিলেকশন হয়ে গেল। সেদিনই সে জানতে পারল যে তার তিনমাস আগেই এথেন্স ওলিম্পিকে ৪৫.৪৮ সেকেণ্ড করে ভারতের নতুন জাতীয় রেকর্ড গড়েছেন কে একজন বিনু। নাঃ, বয়েস হচ্ছে, আর বোধহয় এ রেকর্ড ছোঁয়া হবেনা এ জীবনে।
রবি ঠাকুরের কোনও একটা গানে চমৎকার একটা কথা ছিল, কি কথা মনে পড়ছেনা এখন - তারকেশ্বর স্টেশনের ফুট ওভার ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে ভাবছিল বিনয়। হঠাৎ নজরে পড়ল গুটিকয় বাচ্চা ছেলে তাসের জুয়া খেলছে সিঁড়ির তলায়। ব্রিজ থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বিনয়। কি সর্বনাশ! দলে একটা ন-দশ বছরের ফ্রক পরা মেয়েও আছে। তাকে দেখেই পুলিশ- বলে ছুটে এদিক ওদিক লুকিয়ে পড়ল সবকটা, আর মেয়েটা কি ভেবে ছুটে পালাতে লাগল। ছুটুক, বিনয় ভাবল, তার হাত এড়িয়ে যাবে কোথায়!
কিন্তু বিনয় যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাই ঘটল। তাকে দৌড়ে হারিয়ে মেয়েটি কিছুক্ষণের মধ্যেই নিখোঁজ। সামান্য একটা বস্তির মেয়ে হয়ে খালিপায়ে দৌড়ে হারিয়ে দিল আর-পি-এফের চ্যাম্পিয়ানকে! অন্য কেউ হলে কি হত জানিনা, কিন্তু বিনয় শান্তভাবে তাকিয়ে থাকল মেয়েটির চলে যাওয়ার দিকে। তার চোখে এক দুরূহ, দুঃসাধ্য স্বপ্ন।
পাঁচ বছর পরের ঘটনা। কোচিনের জাতীয় জুনিয়ার এথলেটিক্স মীটে হৈহৈ কাণ্ড। ৪০০ মিটারে মেয়েদের সিনিয়ার রেকর্ড মনজিত কাউরের ৫১.০৫ টি প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে বাংলার কোন অখ্যাত ছুটকি কোনার। বাংলারই আর একটি বাচ্চা ছেলে দাশু বাউরি, ছেলেদের ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে সগর্বে দাঁড়িয়ে মেডেল নিচ্ছে, সবাই তাকে ডাকছে 'মাস্টার বোল্ট'। সে আজ ভেঙ্গেছে দুটি জাতীয় জুনিয়ার রেকর্ড, ১০০ ও ২০০ মিটারের। কিছুদূরে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কোচ বিনয় মণ্ডল, চোখে তার আজ আনন্দাশ্রু। পাঁচ বছর আগে পুলিশের ভয়ে পলাতকা একটি বালিকাকে নিয়ে যে বীজটি সে বপন করেছিল, সে গাছে আজ ফল ধরতে শুরু করেছে। ওই গরিব-দুঃখী ছেলেমেয়েগুলোর মাঝে সে তার স্বপ্নকে সাকার হতে দেখতে শুরু করেছে, ওদের মাঝে সে খুঁজে পেয়েছে নিজের হারিয়ে যাওয়া সত্বাকে।
এ পৃথিবীতে সবই নশ্বর। তবু তো চলা থেমে থাকে না। বিশ্বাত্মা এক থাকে, শুধু নিত্য নূতন মাধ্যমের পরিবর্তন ঘটে, মনে পড়ে যায় ভুলে যাওয়া গানের চরণ-
'তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে, কুসুম ফোটে।'
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
মুম্বাই, ১৯শে নভেম্বর, ২০১৪।

Thursday, November 20, 2014

বাংলা অণু-গল্প- ২৬- 'সমস্যা'

সমস্যা ।।


'এসো, এসো, বিভাস', স্বামী লোকহিতানন্দের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল বিভাস মহারাজ, ওরফে স্বামী পীতাম্বরানন্দকে দেখে, 'তারপর, পশ্চিম ভারতের খবর কিরকম?'
'সব ভাল, মহারাজ', বিভাস বললেন, 'এবার মুম্বাই-পুনে-নাশিক মিলিয়ে রেকর্ড কালেকশন হয়েছে। কাশ্মীরের বন্যাপীড়িতদের জন্যে আরেকটা কিস্তি পাঠাতে পারেন।'
পূর্বাশ্রমের নাম পরিত্যাগ করে বিভাস মহারাজের সদ্য নতুন নামকরণ হয়েছে নিয়ম অনুযায়ী সঙ্ঘে যোগ দেওয়ার বারো বছর পরে। গত বারো বছর ধরে তিনি মুম্বাই ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে সংঘের জন্যে চাঁদা তোলার কাজ সাফল্যের সাথে করে আসছেন। এবার তাঁদের লক্ষ্য পুণেতে আশ্রমের একটি শাখা খোলার।

'পুণের খবর কি, বিভাস', স্বামীজির ডাকে চমক ভাঙে বিভাস মহারাজের, 'কর্পোরেশনের মেয়রের সাথে দেখা হয়েছিল?'
'হ্যাঁ মহারাজ। জমি মাস ছয়েকের মধ্যেই পাবার সম্ভাবনা আছে। তবে পাষান রোডে এন-সি-এলের কিছুটা উদ্‌বৃত্ত জমি আছে, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করলে সেটাই পাওয়া যেতে পারে।'
'হুঁঃ, সুখবর সন্দেহ নেই। চিন্তা তারপর কি হবে তাই নিয়ে। ওখানে বসাব কাকে? কেদারনাথ আর গৌরীকুণ্ডের ধ্বসে তিনজন সিনিয়ার স্বামীজী নিহত হয়েছেন। কাশ্মীরে লোক পাঠাতে গিয়ে কেদারনাথের পুনর্নির্মাণের কাজে ঢিলে পড়ে গেছে। তোমাকে পুণের দায়িত্ব দিলে টান পড়বে কালেকশনে। নতুন সন্ন্যাসী প্রায় আসছেই না যে।'
'সে কি মহারাজ,' এবার বিভাসকেও চিন্তিত দেখাল। 'সবাই কি বস্তুবাদী হয়ে পড়ল, না কি এন-জি-ও গুলো টেনে নিচ্ছে সবাইকে? যাই বলুন, বিজ্ঞাপন আর বিপণনের জৌলুষে আমাদেরই এ বয়সে মাথা ঘুরে যায়, আর তারপর ঈশ্বরে বিশ্বাসও কমে আসছে মানুষের মধ্যে।'
'দেখো, ভোগবাদের মধ্য থেকেই মহাপুরুষেরা বেরিয়ে আসেন। আর তোমাকে বলতে বাধা নেই, আমিও নিরীশ্বরবাদী, কিন্তু লোকহিতকেই নিজের ধর্ম মনে করি। সমস্যাটা অন্যত্র। এর জন্য দায়ী ভাল পরিবারগুলোর মধ্যে সফল জন্মনিয়ন্ত্রণ।'
'তার মানে', এবার বিভাস সত্যিই অবাক হলেন।
'আর কি, সব বাড়িতেই এখন একটি কি দুটি সন্তান। দুই বা তার বেশী পুত্র আর কোথায় যে বাপ-মা এক ছেলের সন্ন্যাসী হওয়া মেনে নেবে। সেদিন একটি ছেলে এসেছিল, যাদবপুরের ইঞ্জিনীয়ার। তারপরেই তার মা-বাবা এসে হাজির, ওকে ফিরিয়ে দিন স্বামীজী, আমাদের ওই একটি ছেলে - বলে সে কি কান্না! ছেলেটিকে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠালাম।'

এইবার দুটো দীর্ঘশ্বাস একসাথে পড়ল।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
মুম্বাই, ১৭ই নভেম্বর, ২০১৪।