Wednesday, November 26, 2014

বাংলা অনুগল্প ৩৩ - সত্যি হলেও গল্প (অফিসের গল্প-১)

সত্যি হলেও গল্প ।।

অনেকদিন আগেকার কথা। প্রজেক্ট অফিসে উচ্চ পর্যায়ের মীটিং চলছে। রিজিওন্যাল ম্যানেজার বেজায় খাপ্পা। কোনও মেসিন ফুল এফিসিইয়েন্সি তে রান করছে না। বিশেষ করে ইলেকট্রিক সেকশানে। পাওয়ার ফ্যাক্টার এত কম কেন? এই যে মিঃ মণ্ডল, চুপ করে কেন, প্লীজ সে সামথিং!
মণ্ডল সাহেব সেকশানের হেড। উনি টাকমাথা চুলকে যাচ্ছেন দেখে পাশে বসা এসিস্টান্ট চন্দ্র কানে কানে কি যেন বলল। আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মিঃ মণ্ডলের চোখমুখ। উনি উঠে বললেন, 'স্যার, আমাদের ট্রান্স্‌ফর্মারগুলো দেখুন। ৪৪০ ভোল্টকে ৬৫০এ কনভার্ট করে দিচ্ছে, একেবারে ১৫০ পারসেন্ট এফিসিয়েন্সি!' এই বলে সগর্বে হলের চারদিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। দু মিনিট চুপচাপ, যেন কোনও নেতার মৃত্যুতে শোকপালন হচ্ছে। তারপরেই রাগে ফেটে পড়লেন আর-এম। 'গেট আউট, গেট আউট......' পাগলের মতো চেঁচাতে থাকলেন যতক্ষন না মন্ডল সায়েব হল থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পরে ক্যান্টিনে আমরা জুনিয়ার মহলে এ নিয়ে হাসাহাসি করছি। স্টেপ-আপ ফ্যাক্টার হয়ে গেল ট্রান্সফর্মারের এফিসিয়েন্সি, কোথাকার ইঞ্জিনিয়ার উনি! সিন্‌হাদা আমাদের মধ্যে একটু বয়স্ক, ৭০ সালে ঢাকা থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে উনি ৭১এর দাঙ্গার সময় রায়গঞ্জে চলে আসেন ও বাকী পড়াশোনা ভারতেই করেন। সিনহাদা বললেন, 'মণ্ডলের গল্প শুনতে চাও তো আমায় জিগ্যেস কর।' আমরা হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠতেই উনি শুরু করলেন।
- '১৯৭১এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে তখনও ভারতের সাড়া পাওয়া যায়নি সাহায্যের। খানসেনা আর তাদের বাংলাদেশী চামচেদেরি রমরমা। হিন্দুরা দলে দলে পালাচ্ছে ইন্ডিয়ার দিকে, পেছনে জামাত-ই-ইসলামের দল তাড়া করে যাচ্ছে, ধরতে পারলেই লুট-অত্যাচার-ধর্ষণ-খুন। একটা দল তখন তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে যশোর থেকে বেনাপোলের দিকে। জামাতিদের ধাওয়া করা দলটাতে একটি ছোকরা ছিল নুরুল হুদা নামে। সরষার কাছে ও একটু পিছিয়ে পড়েছিল দলছুট হয়ে। হঠাৎ একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে দেখে একটা লোক পড়ে আছে রাস্তার ধারে ঝোঁপের ভিতর, মাথায় ভারী কিছুর চোট। নুরুল যেতে লোকটা ততক্ষণে মরে গেছে। পকেট হাতড়ে দেখে পয়সাকড়ি কিছু নেই, শুধু প্লাস্টিক মোড়া একটা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমার সার্টিফিকেট, নাম লেখা নারায়ণ চন্দ্র মণ্ডল। সেই মুহূর্তেই ভাবনাটা মাথায় এল। কি হবে ছাই বাংলাদেশে ফিরে, আর ধর্ম বা জামাত যে গোটা জীবন খাওয়াবে তার গ্যারান্টি কি? আত্মীয়স্বজন বলতেও কেউ নেই, অগত্যা...।
- 'অগত্যা বেনাপোল। বেনাপোল জান তো, যশোর আর চব্বিশ পরগনার মাঝে বাংলাদেশ বর্ডার, গোলেমালে বর্ডার পার হয়ে নুরুল চলে এল পেট্রাপোল, ইন্ডিয়া। এখন তার নাম হল নারায়ণচন্দ্র মণ্ডল।'
- 'বলেন কি দাদা!' আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম। এই মণ্ডল সায়েবই......
- 'তবে আর বলছি কি। তারপর কলকাতায় এসে উনি ঝটপট করে ফেললেন একটা ইলেকট্রিসিয়ানের কোর্স, নামে মণ্ডল ছিল, পেয়ে গেলেন কাস্ট সার্টিফিকেট। সরকারি চাকরি পেতে আর কি চাই!' চা শেষ করে এবার উঠলেন সিন্‌হাদা, পিছনে আমরা সবাই।
মাস দুই পরে সিন্‌হাদা ধরেছেন আমাকে। 'কি হে মুখার্জি, আমার গল্পটা দিব্যি ছাপিয়ে দিলে যে পত্রিকায়! নেহাত গুলের ওপর কপিরাইট থাকেনা, নয়ত আমি খেসারৎ দাবী করতাম', সিন্‌হাদা হাসলেন দাঁত বের করে।
আমি আর কি করি? বললাম, 'দাদা, আপনার স্টাইলটা যদি বাগাতে পারতাম, আমার গল্পটাকেও সত্যি বলে ধরত লোকে। কিন্তু জানি সেটা আমি এ জন্মে পারবনা'।
কুয়েত, ১৯শে আগষ্ট, ২০১৪।

No comments:

Post a Comment