Wednesday, November 26, 2014

বাংলা ছোট গল্প - সেরা লাঞ্চ (অফিসের গল্প-৩)

সেরা লাঞ্চ ।।
(ছোট গল্প)

বন্ধুদের মাঝে কখনো-সখনো গল্প হয় কে কোথায় কেমন খেয়েছে, বড় বড় পাঁচতারা হোটেল আর স্পেশ্যালিটি ও ব্র্যান্ডেড রেস্তোরাঁর গল্প, ইণ্ডিয়ান মাল্টি-কাইজিন থেকে চাইনিস-থাই-আরবী-কন্টিনেন্টাল, থীম রেস্তোরাঁ- এসবের আড্ডা। আমি একটু ভোজনরসিক ও নানাধরনের রেসিপি নিয়ে মাঝে মাঝে একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি বলে বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনি ও আড্ডায় যোগও দিই বটে, কিন্তু সংকোচে কাউকে বলতে পারিনা আমার জীবনের সেরা লাঞ্চটির কথা। 'আড্ডা'র বন্ধুদের মাঝে কিছু সমমনস্ক মানুষ পেয়েছি তাই এখানে আজ নির্দ্বিধায় বলতে পারি সে কাহিনী।
আমি তখন শিলচরে। গিন্নী বাপের বাড়িতে। নতুন লোকেশানে ড্রিল হবে তাই রুট ও লোকেশান দেখতে বেরোব আমি আর সহকর্মী বসাক। সাথে অফিসের ড্রাইভার নাথদা জীপ নিয়ে। গাড়ী সহর ছাড়াতেই নাথদা আমাদের খাওয়াদাওয়ার প্ল্যান কি জানতে চাইলেন। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি, খিদে নেই তখনও। বসাক বলল, 'ও করিমগঞ্জে খেয়ে নেব ফেরার পথে'। নাথদা কাছাড় অঞ্চলেরি মানুষ, বললেন, 'হুঁঃ, রূট সার্ভেতে কত যে শহর আর কত হোটেল পড়বে সব জানি। ও সব আমার উপর ছেড়ে দিন'।
এই নাথদাকে একটু বেশী আশকারা দেয় বলে বসাককে সহকর্মীরা, এমনকি জুনিয়াররাও কথা শোনাতে ছাড়েনা। ও আমাদের লেভেলের দু-চারজনকে ছাড়া অবশ্য কাউকেই বড় একটা পাত্তা দেয় না। আমার একটু সন্দেহ হচ্ছিল ওর ভরসায় থাকলে খাওয়া-দাওয়া জুটবে কিনা। হঠাৎ দেখি গাড়ী ঘুরে নেবে গেল কাঁচা পথে। 'আরে আরে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন', আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। 'করিমগঞ্জ হয়ে পাথুরিয়া-আদমটিলার রাস্তা তো সবার জানা', নাথদা বলল, 'ওদিকে একটা ব্রিজ তৈরি হচ্ছিল বলে রাস্তা বন্ধ ছিল, গ্রামে আমার চেনা লোক আছে, চলুন একবার জেনে আসি।'
পড়েছি মোগলের হাতে! মাইল দশ-বারো যেতেই একটা ছোট গ্রাম পড়ল, সেখানে দেখি পুকুরপাড়ে একটা কুঁড়েঘরের সামনে এসে নাথদা 'জামাই, ও জামাই' বলে হাঁক পাড়ল। দেখি একটি কমবয়সী লোক খালিগায়ে লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এল, গলায় পৈতে ঝুলছে। আরে খুড়ো যে, দেখো কে এসেছে, বলে হাঁক-ডাক শুরু কর দিল। নাথদা বলল, 'না হে জামাই এখন বসছি না, সাহেবদের নিয়ে সাইট যাব, মাকে বল চাট্টি রেঁধে দিতে, ফেরার পথে খেয়ে যাব'।
'নিশ্চয়, এ কি বলার কথা, আপনাদের যত্ন করে খাওয়াই সে সাধ্য নেই আমার, তবে রাস্তায় যা পাবেন, তার থেকে এটাই ভাল। এ অঞ্চলে হোটেল বলে তো কিছু নেই!'
রাস্তায় বসাক গজগজ করতে লাগল, 'কি দরকার ছিল, আপনার ভাইঝিকে কষ্ট দেওয়ার, না হয় একবেলা না খেয়েই থাকতাম'। নাথদা বলল, 'ও তো আমার নিজের ভাইঝি নয়, গ্রাম সম্পর্কে, কাকা বলে। জামাইটি স্কুলের মাস্টার, খুব ভালমানুষ। তাছাড়া ওরা নীচু জাত নয়, যুগীর বামুন।' 'আপনি আর আমাকে বামুন দেখাবেন না নাথদা',আমি খেপে বল্লাম,'মুন্না আলির ক্যান্টিনে রোজ মুরগী সাঁটাচ্ছি- বরং আমাদিগকে খাওয়ালেই ওদের জাত যাবে!'
গাড়ী এগিয়ে চলল। রূট ও সাইট দেখে, প্ল্যান বুঝে জামাইদের গ্রামে যখন ফিরি তখন বেলা আড়াইটে। নাথদা বলল, 'দেখলেন, স্টেট হাইওয়ের রাস্তা বন্ধ, ভাগ্যিস অন্য রাস্তায় এসেছিলাম। করিমগঞ্জেই বা পৌঁছতেন কিভাবে?' মানতে বাধ্য হলাম। তাছাড়া পেটে ছুঁচোরা যা ডন-বৈঠক মারতে শুরু করে দিয়েছে, বুঝলাম, নাথদা বেশ বুদ্ধিমানেরই কাজ করেছে।
আমরা পৌঁছতেই মেয়ে তো রীতিমত হৈ-হট্টগোল শুরু করে দিল। 'এত দেরী করে আসতে আছে, দেখুন তো, আপনার জামাই খেয়েদেয়ে স্কুল চলে গেল, কত আর অপেক্ষা করবে! আসুন সবাই, খাবার তৈরী'।
কি ছিল খাবারে? মোটা ঢেঁকি-ছাঁটা চালের ভাত, মসুর ডাল, হিঞ্চে শাক, পোনা মাছ ভাজা, শিদল-শুঁটকির চাটনি, লাউএর বড়ি চচ্চড়ি আর আলু-পোস্ত। জানি, ফাইভ স্টারের দল নাক কুঁচকোবে, কিন্তু খিদের মুখে, আর সরল গ্রাম-বধুটির যত্ন ও আতিথ্যের গুণে মনে হল যেন অমৃত খেলাম। এমন কি, পাক্কা ঘটি বসাক শুঁটকি পর্যন্ত খেল তৃপ্তি করে। মেয়েটি বারবার অনুযোগ করছিল কিছু খেলাম না বলে, কিন্তু স্বল্পাহারী আমিও তখন তিনবার ভাত চেয়ে নিয়েছি। আসার সময় মেয়ে তো কেঁদেই অস্থির, 'এতদিন পরে বাপের বাড়ি থেকে কেউ এল, কিন্তু দুর্ভাগ্য, তেমন যত্ন করতে পারলাম না'। বসাক কিছু টাকা গুঁজে দিতে চেয়েছিল বাচ্চাটির হাতে, নাথদা আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলে,'করেন কি, এটা কি হোটেল? মেয়ে আমার জন্মের মত আড়ি করে দেবে, জানেন!'
এরপর যদি শিলচরে ফিরে নাথদাকে আমরা দু-বোতল বীয়ার খাওয়াই, তাতে কার কি বলার থাকতে পারে!

১৯শে আগষ্ট, ২০১৪।

No comments:

Post a Comment