Wednesday, November 26, 2014

বাংলা অণু গল্প ২৯ - কেউ ফেরে না

কেউ ফেরে না ।।

খাণ্ডোয়ায় ট্রেনটা থামতেই নেমে পড়লেন পুনর্বসু ভট্টাচার্য। এদিক ওদিক তাকালেন একবার। ঐ তো, অর্জুন গাছটা ঠিকই আছে প্ল্যাটফর্মের এককোণে, কিন্তু না আছে সেই ময়না পাখিটা, না গাছের তলার সেই কুকুরটা। তপনই বা কোথায় গেল? এসি কামরাটা দাঁড়ায় প্ল্যাটফর্মের একেবারে শেষে, একটা চা-ওলা শুদ্ধু মেলেনা সেখানে। আর থাকবেই বা কেন? বাবুরা ঠাণ্ডায় ঘুমোবেন বেলা পর্যন্ত, তার পর কেটারিং-এর বাসি স্যান্ডুইচ আর ঠাণ্ডা চা খাবেন আরাম করে। এই পুনর্বসুবাবুর মত দু-চারটে পাগলাটে লোকের জন্যেই তপনের দোকান চলত।

দুর্গাপুরের তপন চক্রবর্তী নিঃস্ব অবস্থায় খান্ডোয়া স্টেশনে কিভাবে এল সে এক অন্য গল্প। বুড়ো ঠেলাওয়ালা বুধন কুশোয়াহার দয়ায় তারই সাথে পাঁউরুটি সেঁকার কাজে লেগে পড়েছিল, সেও প্রায় সাত বছর হল। অপুত্রক বুধনের ঠেলাগাড়ি এখন তপনেরই, বুধনের বিধবা তার আম্মা। আগে এই বোম্বে মেলের শেষ বগিটা ছিল ভীড়ে ঠাসা জেনারেল, একদিন ছক বদলে এসি কামরাগুলো দিয়ে দেওয়া হল সেখানে, ঝপ করে সেল কমে গেল তপনের। তখন সে শুরু করল অমলেট বানানো, তাতে কিছুটা অন্ততঃ সুরাহা হল।

কিন্তু হল কি ছেলেটার, পুনর্বসুর একটু চিন্তা হয় বৈকি! তিনি জব্বলপুরে রেলের ইঞ্জিনিয়ার, তিন কুলে কেউ নেই, অকৃতদার, শখের মধ্যে ব্রিজ খেলা আর বংশসূত্রে পাওয়া সংস্কৃত-চর্চা। বারবার অফিসের কাজে ভুসাওয়াল যেতে-আসতে প্রতিবার দেখা এই নিঃসহায় ছেলেটার প্রতি একধরণের মায়া পড়ে গেছিল। তাকে নিজের সাথে নিয়ে যেতেও চেয়েছেন, তপনই রাজী হয়নি। এদিকে গাড়ি ছাড়ছে। উনি কি ভেবে কামরা থেকে ব্যাগটা নামিয়ে গাড়ি ছেড়ে প্ল্যাটফর্মের উপর এগিয়ে গেলেন।

ঠিক ট্রেন ছাড়তেই দেখা গেল তপনের ঠেলা। 'ওরে অকাল-কুষ্মাণ্ড, কুঞ্জকুঞ্জর, বন্যবরাহ, দস্যু-বর্বর!' বলতে বলতে পুনর্বসু তপনের হাতদুটো ধরলেন। 'আমি তোর খোঁজে গাড়ি ছেড়ে দিলুম, আর তুই ব্যাটা স্কন্ধকাটা আমাকে ফাঁকি দিতে এখানে এসে বসেছিস!'
'কি করছেন জ্যাঠাবাবু, লোকে দেখছে। এখন আর গাড়ি নেই, চলুন পুরোন জায়গায় গিয়ে বসি'- ওরা এলো সেই অর্জুন গাছটির নীচে। 'আচ্ছা জ্যাঠাবাবু, আপনার কখনও জানতে ইচ্ছে হয়নি কিসের নেশায় আমি স্টেশনের এই এককোণায় এসে ঠেলা লাগিয়ে বসে থাকতাম'?
'কি আবার, তুই তো আমার ব্যাটা, আমারই মত পাগল!'
'অনেকটা তাই বলতে পারেন। এখানে এসেই আমার চোখে পড়ে এই গাছটা, ওই ময়না পাখিটা যে মাঝেমধ্যেই মিষ্টি গলায় শিস দিয়ে উঠত আর গাছের তলায় নেড়িকুত্তাটা সারাক্ষণ মুগ্ধ হয়ে পাখিটাকে দেখত। আপনাকে আবার বলছি, জ্যেঠাবাবু, আমি ওদের কেউ নই, কিন্তু ওই দুটিকে ছেড়ে বেশিক্ষণ কোথাও গিয়ে টিকতে পারতাম না। পাখিরা কদ্দিন বাঁচে জানি না, একদিন ময়নাটা ফট করে মরে গেল। কুকুরটা তিন-চারদিন কোথাও নড়ে নি, আমি পাঁউরুটি দিলে খেত না, তারপর জানিনা কোথায় চলে গেল। তারপর আম্মাও গেল দু'মাস আগে, এখন আর শহরে আমার নিজের বলতে কেউ নেই'- একটু যেন রুক্ষ শোনাল তপনের গলা।
'তবে আর দেরী কিসের? আমার সাথে চল, পড়াশুনা করবি, তারপর রেলে ঢুকিয়ে দেব, কেমন?'
'যাব, জ্যাঠাবাবু। তবে একবার বাড়ি গিয়ে মাকে দেখে আসি। তারপর নিশ্চয়ই যাব।'

পুনর্বসু প্রতিবার ভুসাওয়াল যাওয়া-আসার পথে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন খাণ্ডোয়া স্টেশনের দিকে। নাঃ, তপনের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে- সাক্ষী থাকে নীরব একটি অর্জুন গাছ।

মুম্বাই, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪।

No comments:

Post a Comment