Wednesday, November 26, 2014

বাংলা ছোট গল্প - ডাক্তার

 ডাক্তার 


- এই যে তোমরা বল, 'রোগ সারাতে পারে না, সে আবার কেমন ডাক্তার', কথাটা কতটা ভুল, তা জানো?
- মানে কি বলতে চাও, রোগ সারাবে না, অথচ তাকে ভালো ডাক্তার বলতে হবে! মগের মুল্লুক নাকি?

কথা হচ্ছিল ডাঃ উপল রায়, আসানসোলের এক নামকরা ডেন্টাল সার্জনের সঙ্গে, যিনি আবার বৈবাহিক সুত্রে আমার আত্মীয়। আসানসোলের নিউ রোডে আমার বোনের বাসায় সেদিন সন্ধেয় কী কারণে যেন ওদের নিমন্ত্রণ ছিল। খাওয়াদাওয়ার পর ছাতে বসে আড্ডা দিচ্ছি চারজনে, বাকি দুজন আমার ভগ্নিপতি অভি ও তার ভাই অসি। ডাক্তাররা কিভাবে সরল রোগীদের ঠকিয়ে ব্যবসা করে সেই নিয়েই কথা হচ্ছিল। উপল আমাদের বিপক্ষে। আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বাইরেও যে একটা জগৎ আছে সেইটে প্রমান করতেই সে বদ্ধপরিকর।

- মানে? 'দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ' জাতীয় কোন ব্যাপার আছে নাকি এর মধ্যে? আমার তরফে সারকাজম শুনে হাসে উপল। 
- ওই তো! সব কিছুর মধ্যেই তোমরা অলৌকিকত্ব টেনে আনতে চাও। বেশ, তোমাদের তাহলে একটা সত্য কাহিনী বলি, তাহলে ব্যাপারটা বোধগম্য হবে। এই যে আসানসোল-বরাকর-চিত্তরঞ্জনের মধ্যেকার ত্রিভুজাকৃতি অঞ্চল, এটা কিন্তু নামেই বাংলা, এখানে প্রায় ৩০-৪০% বিহারী ও ঝাড়খন্ডি আদিবাসী বাস করে। তারা যে সবাই গরিব তা নয়, কিন্তু শিক্ষিত লোক হাতে গোনা যায়। আবার শিক্ষিতদের মধ্যেও বিদ্যার প্রকাশটুকু বাইরে, চারদেয়ালের মধ্যে কিন্তু তারা সেই বউ-ঠ্যাঙানো মধ্যযুগটাকেই আঁকড়ে আছে। এই চিত্তরঞ্জনেই থাকে আমার এক বন্ধু, কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাস করে বিলেতে গিয়ে MRCOG বা সংক্ষেপে গাইনি করে এলো। তারপর মিহিজামে নিজের ক্লিনিক আর ডিস্পেন্সারী খুলল।
- কিন্তু, মিহিজাম কেন?
- আরে, দুটো একই শহর, গা ঘেঁসাঘেঁসি। চিত্তরঞ্জন বেঙ্গলে, মিহিজাম বিহার ছিল, এখন ঝাড়খন্ডে। চিত্তরঞ্জনে কিছু শুরু করতে গেলে নানা পলিটিক্যাল সমস্যা, আর মিহিজামে হোমিও আর বায়ো কেমিকদের রমরমা। দুটিই চ্যালেঞ্জিং, তা প্রবীর, সঙ্গত কারণেই আসল নামটা বলছিনা, দ্বিতীয়টাকেই বেছে নিল। অঞ্চলে নামী ডাক্তারের অভাব, তাই পসার জমতেও দেরী হলো না। কিন্তু কিছু লোকের দেহাতি মনোভাবের জন্যে ওকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছিল মাঝে মাঝে।
- সেটা কিরকম, অভির প্রশ্ন। এরপরের গল্পটা উপলের ভাষাতেই বর্ণনা করছি।

সেবার এক বিহারী মাইনিং সর্দার, বোধ হয় ভিক্টোরিয়া কোলিয়ারী বা ওদিকে কোথায় কাজ করে, তার কাছে এলো বৌকে দেখাতে, কি না বিয়ের তিন বছর হয়ে গেল, ছেলেপুলে হচ্ছে না। তা প্রবীর যথারীতি ভদ্রলোককে সিমেন টেস্ট আর বৌটির একটা আল্ট্রাসনিক আর সার্ভিক্যাল স্মিয়ার টেস্ট করাতে বলল, ওর ক্লিনিকেই ব্যবস্থা ছিল, হয়ে গেল। দু-দিন পরে বৌকে নিয়ে শাশুড়ি হাজির রিপোর্ট নিয়ে। বললাম, মাজি, তোমার বৌমা ত ঠিকই আছে, তা ছেলের রিপোর্টে একটু খুঁত আছে, তোমাকে বলে তো হবে না, ছেলেকে পাঠিয়ে দিও। মা-টি তো চরম গাঁইয়া অথচ ধড়িবাজ, বলে, 'কা বোলত হো ডাগদর বাবু, মরদমে খোট! দিমাগ ঠিকানে মে বা নু?' প্রবীর দেখল ওকে বোঝানোর চেষ্টা করা বৃথা, বলল বৌ-এর চিকিৎসা করতে গেলেও তো তার মরদের সাথেই কথা বলতে হবে, নচেৎ সম্ভব নয়।

 তা দু-চারদিন পরে লোকটি এল, এবার একা। প্রবীর ওকে বুঝিয়ে বলল, তার স্পার্ম কাউন্ট অ্যাবনর্মালি লো, মোটালিটিও অনেক কম, তাই বেশ কিছুদিন চিকিৎসা করাতে হবে। ও তো রেগে অস্থির, ডাক্তার কিছু জানেনা। কে কবে কোথায় শুনেছে যে পুরুষের দোষে বাচ্চা হয় না। 'মর্দ মে খোট! ই কোনহ বিলায়তি মজাক বা!' এইবার ডাক্তারবাবুর হুঁশ হয়েছে যে কাদের পাল্লায় তিনি পড়েছেন। পুরুষতন্ত্র যে এখানে কত গভীরে শিকড় গেড়ে বসে আছে, তার একটা আভাস পেল এবার। কলকাতার লোক হলে হয়ত তার বিশ্বাস হত না, কিন্তু প্রবীর ওই অঞ্চলের মানুষ, son of the soil। ওর বুঝতে দেরী হলো না এরপর তর্ক চালাতে গেলে লোকটি দলবল নিয়ে আসবে, মারপিট শুরু হবে, হয়ত ক্লিনিকই বন্ধ হয়ে যাবে। আর তা না হলেও, বদনাম, ব্যবসার ক্ষতি। আর এ লোকটি যদি ভালো হয়, কিছুই না করে, তবু সে আর ফিরে ওর কাছে আসছে না, এটা নিশ্চিত। এখন যে তার মনের মত কথা বলবে তার কাছেই সে ছুটবে। অগত্যা প্রবীর এবার একটু নমনীয় হলো।

- আরে ঐসা কুছ নেহি। বিবিজি কা ইলাজ তো করবো পড়ি, পর আপকো ভি থোড়া মজবুত বনাইকে খাতির থোড়া দওয়া-দারু.... এই বলে ম্যানিক্স নামে আয়ুর্বেদিক গুলি লিখে দিলো তাকে, রোজ সকালে দশটা ট্যাবলেট দুধ, মধু আর বাদামের সাথে খাবার জন্যে। অনুপান দেখে ব্যাটা বেশ খুশি, বুঝলো, তাগড়া ব্যাটা বানাবার জন্যে ওর পুরুষত্ব বাড়াতে এই ওষুধ, আর কিছু নয়।
- কিন্তু সত্যি কি এতে কাজ হয়? এবার আমার প্রশ্ন উপলকে।
- কিছুটা হয়। বিশেষত: যদি কোনো সাময়িক অসুস্থতার কারণে কাউন্ট বা মোটালিটি কমে গিয়ে থাকে। তা নইলে পুরুষের কোনো খুঁত থাকলে কৃত্রিম গর্ভাধান ছাড়া কোনো গতি নেই, অবশ্য মেয়েটি যদি নরম্যাল থাকে।
- হুঁ, তারপর কি হলো?

তারপর যথারীতি নাম-কে-ওয়াস্তে চিকিৎসা শুরু হলো মেয়েটির। শুধু নানাধরনের ভিটামিন পিল আর মাঝে মাঝে একটা করে সনোগ্রাফি। সেটাও না করলে সন্দেহ হবে তাই। এই ভাবে দু-বছর চালানো হলো। তারপর একদিন সে ওদেরকে বলল, 'দ্যাখো, আমি চিকিৎসা করে প্রায় সুস্থ করে এনেছি তোমার বৌকে। কিন্তু সমস্যা এতটা বড়, যে কলকাতায় একজন নামী ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তোমাদের, খরচা আছে। প্রায় লাখ-দুয়েক খরচ করতে পারবে?
- বেটোয়া কে খাতির ই কোন বড়ি বাত বা। খরচা-পাতি করব। আপনি ডাক্তারকে সব বুঝিয়ে লিখে দিন।

প্রবীরের এক বন্ধু, ডাঃ চ্যাটার্জি টেস্টটিউব বেবি খ্যাতিসম্পন্ন ডাঃ বৈদ্যনাথ চক্রবর্তীর সহকারী ছিলেন এককালে, এখন নিজেই ফার্টিলিটি ক্লিনিক খুলেছেন কলকাতায় ও বেশ নাম করেছেন। তাঁকে সব কিছু লিখে লোকটিকে ছেড়ে দিল প্রবীর। তারপর দু'টো বছরও যায় নি, ছেলে কোলে মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে এসে হাজির বিহারী-দম্পতি। বৌটি পায়ে পড়ে আর কি। বলে, ‘নেহি ডাগদর সাব, ইয়ে বেটা নেই হোতা তো সৌতন কা মুহ দেখনা পড়তা, হমরে লিয়ে তো আপহি ভগবান হো’। ভাবো তো মজা! যেখানে সে ক্লিনিক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছিল, সেখান থেকে একেবারে সোজা দেবতার আসনে!

- কিন্তু তাতে কি প্রমান হলো উপলদা, অসি এবার মুখ খুলল, তাদের যদি শেষমেষ বাচ্চা না হত?
- কিন্তু তার উল্টো দিকটা দ্যাখো। প্রবীর তো ডাক্তার হিসেবে ঠিক কাজই করতে গেছিল, কিন্তু তাতে ওর বদনামই হত, অথচ প্রমান হতনা যে সে খারাপ ডাক্তার। নাঃ, অনেক গল্প হলো, এবার উঠতে হবে, বলে আমাদিগকে ভ্যাবাচ্যাকা করে রেখে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল উপল।

২৮শে জুন, ২০১৪

No comments:

Post a Comment