জ্ঞানবৃক্ষ- ১১
মানে না যে!
ঝিঙেটোলার জমিদার চণ্ডীচরণবাবু মস্ত কালীভক্ত মানুষ। তিনি নিজের জমিদারিতে কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিত্যপূজা হয় সেখানে। সকালে স্নান সেরে পূজাশেষে মায়ের প্রসাদান্ন নিয়ে তাঁর উপবাসভঙ্গ হয়, তার আগে জলস্পর্শ করেন না তিনি। অঞ্চলের লোক তাঁকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে আবার তাঁর রক্তচক্ষুকে ভয়ও করে কম না।
এহেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার কিন্তু পরাস্ত একজনের কাছে যে আবার তাঁর নিজের প্রজা না হলেও তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুরারিমোহনবাবু। মুরারি আধুনিক বিজ্ঞান আর ইংরেজি জানেন, হিন্দু আর পাশ্চাত্য দর্শনও পড়েছেন কিছুটা। কিন্তু বেদান্ত-দর্শনের চেয়ে লোকায়ত দর্শনই তাঁর বেশি প্রিয়, আর সেখানেও তাঁর মনোভূমি দখল করে বসে আছেন যাঁরা তাঁদের নাম ঋষি চার্বাক, জাবালি আর বোধিসত্ত্ব। মা কালী বা কোন দেবদেবীরই স্থান নেই সেখানে। জমিদারের সঙ্গে এ নিয়ে তাঁর তর্ক হয় মাঝে মাঝেই, কিন্তু কোন বিরোধে না গিয়ে অনায়াস তাচ্ছিল্যে সব কিছু এড়িয়ে যান বলে তিনি কিছু বলতেও পারেন না মুরারিবাবুকে। ফলে একটা জাতক্রোধ থাকলেও কিছু করা হয়ে ওঠে না, শুধু মনে মনেই ফুঁসতে থাকেন।
ইতিমধ্যে একদিন এক ধামাধরা শিক্ষক এসে খবর দিলেন সেদিন নাকি মুরারিবাবু নীতিশিক্ষার পাঠে ছোট ছোট ছাত্রদের বুঝিয়েছেন যে পুণ্যের লোভ না রেখেও ভাল কাজ যেমন পরোপকার, জনসেবা এসব করা যায়। স্বর্গ-নরক বলে পৃথিবীর বাইরে নাকি কিছু নেই, ভাল কাজ করে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার নামই নাকি স্বর্গ। সেবাই নাকি সবচেয়ে বড় ধর্ম, শিব-দুর্গা-কালীর পুজো না করলেও কোন ক্ষতি হয় না। পুজো-টুজো নাকি সব ভড়ং, লোক-দেখানো, লোক ঠকানোর ধান্দা।
নাস্তিকতা যদি বা মানতে পারতেন চণ্ডীবাবু, কালীপুজোর বিরুদ্ধে কথা বলা নিয়ে রাগে ক্ষেপে গেলেন তিনি। আজ অমাবস্যা, ঠিক করলেন মা-কে পুজোয় সন্তুষ্ট করে এর একটা বিহিত করতে হবে। আবার মুরারি লোকটা নাস্তিক হলেও গ্রামের বিপদে-আপদে বুক পেতে দেন, লোকের যে কোন সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য আর সেবা করেন, পড়ানও ভাল, বিশেষ করে গরীব আর মেধাবী ছাত্রদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান- তাই তিনি গ্রামের সবার প্রিয়। তাই হঠাৎ করে কিছু করতে গেলে লোকে অসন্তুষ্ট হবে, জমিদারেরও বদনাম হবে। অগত্যা শ্যামা মা-ই ভরসা। ১০৮খানা জবাফুল দিয়ে তিনি আজ পুজো করে অঞ্জলি দিলেন।
রাত্রে ঘুমের মধ্যে চণ্ডীচরণ স্বপ্নে দেখলেন মা কালী এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর পাশে। 'কী রে, আজ যে পুজোর বড় ঘটা, কী চাই বল দেখি তোর?'
- 'মা, মুরারিটার বড্ড বাড় বেড়েছে, কী করি বল তো?'
- 'হুম, সব জানি। তা দে না ব্যাটাকে তাড়িয়ে রাজ্য থেকে। তোরই তো পাঠশালা!'
- 'সেটা কি ভাল হবে মা? অন্য প্রজারা, গ্রামের লোকে পাঁচটা কথা বলবে। জমিদার বলে তো যা খুশি করতে পারি না।'
- 'তাইতো! কী করা যায় তাহলে?'
- 'মা, তুমি তো সর্বশক্তিমান। একটা কিছু কর না যাতে ও নিজে থেকেই ভয় পেয়ে পালায়। বা অন্য লোকজন ওর উপর ক্ষেপে গিয়ে মেরে তাড়ায়। সব চেয়ে ভাল হয় মা ওকে তুলে নিলে, তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়।'
- 'না রে, আমার দ্বারা কিছু হবে না। যা করার তোকেই করতে হবে।'
এবার স্পষ্টতঃই অবাক হলেন চণ্ডীবাবু। এটা কী এমন কাজ যে মায়ের পক্ষেও অসম্ভব! তিনি থাকতে না পেরে শুধিয়েই ফেললেন কথাটা।
- 'বুঝি রে ব্যাটা, খুব অবাক লাগছে। কিন্তু আমাদের শক্তি তাদের উপরেই খাটে যারা আমাদের বিশ্বাস করে। একবার রণরঙ্গিনী রূপ ধরে সামনে এলেই ভয়ে অক্কা পায়। কিন্তু মুরারি তো আমাকে মানেই না। শুধু আমাকে কেন, স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য, ভূত-ভগবান-জন্মান্তর কিচ্ছু মানে না। ওর আমি করবটা কী? আমাদের যত জারিজুরি সব ভক্ত আর ভণ্ডদের উপর, নাস্তিকের কোন ক্ষতি করতে পারার ক্ষমতা নেই আমার। তাই যা করার সব তোকেই করতে হবে।' এই বলে মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন চণ্ডীবাবু। বসে ভাবতে লাগলেন। কী করবেন? ফলাফলের কথা না ভেবে মুরারিকে তাড়িয়ে দেবেন? মায়ের পূজা বন্ধ করে দেবেন? মুরারির কাছে নাস্তিক্যের দীক্ষা নেবেন? না কি যেমন চলছে তেমনই চলতে দেবেন?
আপনারা কি পারবেন চণ্ডীচরণবাবুকে একটু সাহায্য করতে???
জ্ঞানবৃক্ষ- ১২
এক যে ছিল গাধা!
এক ধোপার এক গাধা ছিল। গাধাটা বুড়ো হয়ে গেছিল বলেই বা অন্য কোন কারণে, ক্রমেই কুঁড়ে আর অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিল, সেই সুকুমার রায়ের নাকওলা সাহেবের গাধার মতো-
"ডাইনে বললে যায় সে বামে
তিন পা যেতে দু'বার থামে।
দেখতে দেখতে থেকে থেকে,
খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে।"
একদিন কিন্তু রাসভ-নন্দন সত্যিই একটা অগভীর শুকনো পাতকুয়োয় পড়ে গেল। ধোপা ভাবল, যাকগে, ব্যাটা কাজ করে না, শুধু খায় আর ঘুমোয়। থাক পড়ে, উঠতে পারে উঠুক, নয়ত মরুক। ও রেগেমেগে বাড়ি চলে এল।
সন্ধেয় গাধা বাড়ি আসে না দেখে ধোপা ওর ছেলেকে নিয়ে কুয়োর ধারে এসে দেখে তখনও গাধা নেতিয়ে শুয়ে আছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে ভাল বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেকে বলল, 'ওরে গাধাটা মনে হচ্ছে মরেই গেছে। ভালই হয়েছে, চল দুজনে মিলে ওটাকে কবর দিই। আমি মাটি খুঁড়ছি, তুই কুয়োতে ফেলে যা।'
তাই হ'ল। তখন অন্ধকার ছেয়ে এসেছে, গর্তে গাধাকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছেনা। তবু তারই মধ্যে ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি ফেলে বাপ-ব্যাটায় যখন ভাবছে যে গাধার কবর হয়েছে, হঠাৎ দেখে মূর্তিমান লাফিয়ে গর্তের বাইরে। আসলে কী হয়েছে, উপর থেকে মাটি পড়তে শুরু হওয়ায় গাধা ভাবে ওকে উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে, সে পিঠে পড়া মাটি নীচে ঝেড়ে ফেলে তার উপরে উঠে দাঁড়াতে থাকে। এভাবে ধীরে ধীরে মাটির স্তুপ ওর পায়ের তলায় জমতে থাকে আর তিনি ওপরে উঠতে থাকেন- শেষে একলাফে বাইরে। ধোপা আর কী করে, গাধাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
এবার গাধা ভাবতে থাকে ধোপা ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে, কৃতজ্ঞতায় সেও মন দিয়ে তার সেবা করতে থাকে। ধোপা খুশি। কিন্তু আমাদের মাথায় এখন অনেক প্রশ্ন।
১) বলি বটে গাধা, কিন্তু তার মাথায় এত বুদ্ধি! বিপদে পড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কি জন্ম-বোকাদেরও মাথা খুলে যায়?
২) মুর্খ আর ফাঁকিবাজ বলে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এই নেতিমূলক ভাবনাটা তার মাথাতেই আসে না। তাই কি সে বিপদকে সুযোগে পরিবর্তিত করে ফেলে।
৩)তাহলে কি সময়বিশেষে বুদ্ধি বা জ্ঞান কম থাকাটাই কাজে দেয়, যাকে ইংরেজিতে বলে- 'Ignorance is bliss'?
৪) ধোপা চেয়েছিল গাধাকে মারতে, কাজ করে না বলে। ভ্রমক্রমে তাকে বাঁচিয়ে ফেলে লাভ কিন্তু দু'জনেরই হল।
৫) গাধা কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝল না, সাধে কি বলে গাধা!
৬) এই গল্পের কি কোন শিক্ষা আছে? আমার তো মাথায় ঢুকছে না, কেউ আমায় বোঝাতে পারেন?
জ্ঞানবৃক্ষ- ১৩
"দরদস্তুর"
'মরিচ কাটা বেনে' কথাটা শুনেছ? বেনে বা বণিকরা জাত হিসেবে কতটা কঞ্জুষ হয় জানি না, তবে 'ছাঁদাবাঁধা বামুন', 'বদ্যিদের কুটুম', 'স্যাঁকরাদের হরিনাম' এসব যেমন কথায় কথায় চলে আসছে, তেমনি বেনেদের কেউ ভালমানুষ হলেও এই অপবাদটা তাদের প্রায়ই সইতে হয়। কথাটা এল কোত্থেকে? সে কোন এক বেনে দোকানদার ভুল করে আধখানা শুকনো লঙ্কা ওজনে বেশি দিয়ে ফেলেছিল। ব্যাপারটা কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হতেই সে খদ্দেরের পিছনে মাইলখানেক ছুটে গেছিল ওই কাটা মরিচখানা ফেরৎ আনতে।
এক গ্রামে এরকমই এক হাড়কিপটে বণিক ছিলেন ধনঞ্জয় সাহা। নিমকের ব্যবসায় তাঁর দেশজোড়া খ্যাতি, তবে তাঁকে দেখে সেসব বোঝার উপায় নেই। টাকাপয়সা তাঁর সিন্দুকে ঢোকার পর পারতপক্ষে আর বাইরের হাওয়া খায়না। এহেন সাহামশাই যে অম্লশূলে ভুগলেও বড় ডাক্তার দেখাবেন না, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেদিন রাত্রে মৌরলার ঝাল আর আমড়ার টক খাবার পর আর পেটের ব্যথায় ঘুমোতে পারেন না, ছটফট করতে থাকেন। হঠাৎ দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারে মা কালীর ছবিতে চোখ পড়তেই কি ভেবে যেন মানত করে বসেন- 'মাগো, এই অম্লশূলের ব্যথা সারিয়ে দাও মা, এবার কালীপুজোয় তোমাকে জোড়া মোষ বলি দিয়ে পুজো দেব।'
মা এর মন্দিরে বলিতে আজকাল মোষ আর খুব একটা পড়ে না, তাই মা কালী মনে হয় এই মানতে একটু খুশি হয়েই ধনঞ্জয়ের শূলের ব্যথা সারিয়ে দিলেন। ধনঞ্জয় ভাবলেন, যাক, ব্যথা এমনিই সেরে গেছে- মানতের কথা তাঁর আর মনে রইল না।
এদিকে মা কিন্তু কিছুই ভোলেন নি। কালীপুজোয় মোষ না পেয়ে তিনি স্বপ্নে দেখা দিলেন ধনঞ্জয়কে- 'কী রে, জোড়া-মোষ মানত করেছিলি, ভুলে গেলি?'
- 'মা, ব্যথা তো আমার নিজে থেকেই সেরে গেল, আবার মোষ কেন?'
মা আর কিছু বললেন না। পরদিন রাত্রে শুরু হল দ্বিগুণ ব্যথা। ছটফট করতে করতে মা কালীকে ডাকাডাকি করতেই তিনি হাজির।
- 'কী, ব্যথা এমনিই সেরে গেছিল, না!'
- 'মা গো তুমি ঠাট্টাও বোঝোনা। তবে মা গো, মোষ আজকাল আর কোথায় কে দেয়? পরের অমাবস্যায় আমি তোমায় বরং জোড়া পাঁঠা দেব।'
- 'বেশ তাই দিস।' মা অদৃশ্য হলেন। ধনঞ্জয়ের ব্যথাটাও বেশ খানিকটা কমল।
অমাবস্যা পেরোল। কোথায় পাঁঠা? আবার মা এলেন স্বপ্নে।
- 'মা গো, ব্যবসায় ভীষণ টানাটানি যাচ্ছে, পাঁঠা পারবনা, বরং তুমি জোড়া হাঁস নাও।'
- 'ঠিক আছে তাই দিস।'
এ যাত্রা গেল। কিন্তু হাঁস আর আসে না। শেষে পরের বার নেমে হল জোড়া পায়রা। তাও দেয়না ধনঞ্জয়। এইবার মা গেলেন প্রচণ্ড রেগে। ব্যথা আবার ফিরে এল। 'মা, মরে যাব মা, ব্যবসা একদম চলছে না। দুটো পায়রা কিনে যে বলি দেব তার পয়সাও নেই।'
- 'কিন্তু মানত তো রাখতেই হবে, নয়ত নরকে যাবি রে ব্যাটা!'
- 'মা, তাহলে বরং দুটো ফড়িং দেব তোমাকে। দোহাই, পয়সা খরচ করতে পারব না, দয়া কর।'
- 'বেশ তাই দিস।'
আরো গোটা দুই অমাবস্যা পেরোল। ফড়িংয়েরও দেখা নেই। আবার অম্লশূল ফিরে এল। ডাকতেও হল না, মা এবার রণরঙ্গিনী মূর্তি নিয়ে এসে দেখা দিলেন।
- 'পাপিষ্ঠ, তোর এত সাহস, আমাকে কথা দিয়ে তার খেলাপ করিস! একজোড়া ফড়িং পর্যন্ত দিতে পারিস না?'
এবার মায়ের পায়ের উপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়লেন ধনঞ্জয়। মা গো, তুমি কেমন দেবতা, দুটো ফড়িংএর জন্যেও ভক্তকে এমন কষ্ট দাও। ওই তো বাইরে কত উড়ে বেড়াচ্ছে, ধরে খেয়ে নাও না মা যত খুশি!'
মা কালী জীবনে বোধহয় এমন জব্দ হননি। 'সাধে কি বলে মরিচ-কাটা বেনে'- এই বলে তিনি চিরকালের জন্যে অদৃশ্য হলেন।
জ্ঞানবৃক্ষ- ১৪
"ইতি ইতি, নেতি নেতি"
এই? না এ নয়!
''চিন্তাভাবনাসহ যা কিছু
আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য
তা দিয়ে গঠিত হয় ‘ইহা’। আমাদের
ইন্দ্রিয় ও মনের নাগালের
বাইরে যা আছে অর্থাৎ
অতীন্দ্রিয় আর মানসাতীত তা
দিয়ে হয় ‘উহা’র গঠন”, গুরু বললেন।
বুদ্ধিমান শিষ্য এই বিমূর্ত
ধারণাটি মানতে রাজি নন।
“কিন্তু গুরুদেব”, গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে সে প্রতিবাদ করে, “যা বাস্তব নয় তা নিয়ে আমরা কেন আমাদের
মনকে বিভ্রান্ত করব?”
গুরু হেসে বললেন, “তুমি
এখানে আমাকে এমন কিছু
দেখাতে পার যা বাস্তব?”
“অবশ্যই”, শিষ্য জবাবে ছাত
থেকে ঝুলন্ত একটি ঘন্টার
দিকে ইশারা করে বলল,
“যেমন ধরুন, এই ঘণ্টাটা। আমি মনে করি এটি বাস্তব। তবে
আপনি যদি এখানে নেই
এমন একটি দ্বিতীয় ঘণ্টার
থাকায় বিশ্বাস করতে বলেন, সেটা আমার পক্ষে কঠিন হবে”।
গুরু এবার হেসে জিজ্ঞাসা
করলেন, “তুমি কি এই
ঘণ্টাটিকে আসল বলছ?”
শিষ্য।। কেন আমি তো এটাকে আমার
চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে
পাচ্ছি!
গুরু।। ধর
তুমি অন্ধ হয়ে গেছ। তাহলে
এই ঘণ্টাটি কি অবাস্তব হয়ে
উঠবে না?”
শিষ্য।। মোটেও
নয়, কারণ এখনও আমি এর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে
পাচ্ছি।
গুরু।। ধর
তুমি বধির।
শিষ্য।।তবুও আমি এর আকার আর গঠন অনুভব
করতে পারি আমার হাত
দিয়ে স্পর্শ করে।
গুরু।। ধর
তোমার স্পর্শের অনুভূতিও নষ্ট হয়ে গেল। তাহলে
কী হবে?
এবার
শিষ্য যেন কিছুটা ধন্দে পড়ল, “হ্যাঁ, এতে যুক্তি আছে”।
“তাহলে প্রসঙ্গে ফিরি”,
গুরু বললেন, “পরিস্থিতিটাকে
এবার একটু উল্টো দিক থেকে
দেখা যাক। মনে কর তুমি একটি
মৃতদেহ যার কোন ইন্দ্রিয়ানুভূতিই নেই। ঘণ্টার
কেন, কোন কিছু বোঝারই তোমার সাধ্য নেই। এবার
তোমাকে একটি মাত্র অনুভূতি প্রদান করা হল- স্পর্শের।
তুমি এখন স্পর্শ করে ঘণ্টাটি অনুভব করলে আর
এটা তোমার কাছে সত্য
হয়ে উঠল। আমি এরপর তোমাকে আর একটি
অনুভূতি ফিরিয়ে দিচ্ছি, শ্রবণের।তুমি এখন ঘণ্টার শব্দ
শুনতে পাচ্ছ। এটি
কি আরও বাস্তব হয়ে
ওঠে না? এখন যদি আমি তোমায় পাঁচটি
ইন্দ্রিয়ই ফিরিয়ে দিই, তোমার জন্যে
ঘণ্টা ‘সম্পূর্ণ বাস্তব’ হয়ে উঠবে।
কী, সহমত?”
শিষ্য মাথা নেড়ে
বলল, “হ্যাঁ”।
“তবু
এ অযৌক্তিক”, গুরু গম্ভীর হয়ে
বললেন, “তুমি কিভাবে অনুমান
করলে যে এখানে কেবল
পাঁচটি উপলব্ধি আছে? ধর আমি
তোমাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিচ্ছি। এটি
কি ঘণ্টার বাস্তব অস্তিত্বের স্বপক্ষে সম্পূর্ণ এক নতুন
মাত্রা যুক্ত করে না?
কিম্বা ধর আমি তোমাকে
একটি সপ্তম....দশম…..
অনুভূতির সহস্রতম ইন্দ্রিয় দিলাম। তাতেও কি
ঘণ্টার বাস্তবতা পূর্ণরূপে প্রকাশ
পায়?”
শিষ্যের মুখে আর কথা সরে না, সে নীরব
সম্মতিতে আত্মসমর্পণ করে।
“পুত্র!”,
গুরু বলেন, “চিন্তাসহ
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির প্রকাশ
যাতে তাকে আমরা বলি ‘ইহা’ (ইদম্)। ইন্দ্রিয়ের
নাগালের বাইরে যা, অবাঙ্মানসগোচর তার
নাম ‘তাহা’ (তদাঃ)। সমগ্র
বেদান্ত ‘ইহা’ আর ‘তাহা’ নিয়ে।”
এইবার গুরু ঈশ্বর-বিশ্বাসের বিষয়ে
শিষ্যকে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। ঈশ্বরের
অস্তিত্বকে তুমি অস্বীকার
করতে পার না কারণ
তুমি তাঁকে নিজের সীমিত
ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবে
না। ঈশ্বর
‘তাহা’। নিজের বোধগম্যতার
সীমা বুঝতে পারলে মানুষের মনে একপ্রকারের
বৌদ্ধিক নম্রতা জন্মায়।
বিশ্বাস নম্রতার দ্বারা লব্ধ এই
জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমাদের সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ানুভূতি দিয়ে আমরা যা বুঝতে
পারি তা হ'ল
বাস্তবের এক সূক্ষ্ম ভগ্নাংশমাত্র। এই
‘তদাঃ’ তোমার কল্পনারও নাগালের বাইরে, কারণ কল্পনা তোমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিরই
মধ্যে মূলীভূত, তার বাইরে কিছু নয় ।
‘তদাঃ’এর বাস্তবতায় কল্পনা কীভাবে ব্যর্থ হয় তা
কল্পনা করতে গেলেও বুঝতে হবে যে, সমস্ত
সংজ্ঞা বা পরিভাষা ‘ইদম’এর রাজ্যের
অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ঈশ্বরের
সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।
তাই এতে কোন আশ্চর্য নেই যে আমাদের ঋষিরা ঈশ্বর বা ব্রহ্মের বর্ণনায় সকলে একটি কথাই
বলেছেন- নেতি, নেতি (ন-ইতি, ইহা নয়)।