অপয়া।
(গল্প, তবু গল্প নয়)
এই অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হিসেবে আমার প্রথম কাজ হল এই দিগম্বর ষাঁড়ের খোজ নেওয়া- কে এই স্বনামধন্য মহাপুরুষ। কিন্তু যাকেই শুধোই সেই কানে হাত দিয়ে কেটে পড়ে। কাছাকাছি সাঁকতোড়িয়ায় পিসির বাড়িতে উঠেছি, ছুটি কাটাতে এসে। পিসতুত দাদা ঝালবাগান ক্লাবে খেলেছে সেদিন। ওর কাছে, আর দুই ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম দিগম্বরের বিবরণ। তখনও শীর্ষেন্দুর 'পাতালঘর' বইটা বেরোয়নি, আমরা জানিনে 'অপয়া গোবিন্দে'র কাহিনী। পরে ছবিটা দেখে বুঝেছিলাম অপয়া গোবিন্দ আর দিগম্বর ষাঁড়ের মধ্যে কোনও বিশেষ তফাৎ নেই। তফাতের মধ্যে গোবিন্দ নিজের অপয়া স্টেটাস নিয়ে গর্বিত ছিল, এইটুকু।
একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বরাকর স্টেশন থেকে শেয়ারের অটোয় সাঁকতোড়িয়া আসছি, এমন সময় অটোওলার সাথে এক যাত্রীর ভাড়া নিয়ে বচসা শুরু হল। ভাড়ায় কিছুতেই বনছে না দেখে গ্রাম্য লোকটি রেগে বলল, 'দু'টাকা লিবি নাই? লে তবে, দিগম্বর ষাঁ...', এটুকু বলতেই ফটাস্- একটা টায়ার ফেটে গেল। গাড়ি কোনমতে রাস্তার ধারের নয়ানজুলির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিথ্যে বলছি না, মহাশয়টি চিরকুণ্ডা থেকে আসানসোল পর্যন্ত একসময় নিজের নামেই বিখ্যাত ছিলেন, ওনার ছেলেমেয়েরা আমার পরিচিত, তাদের মুখ চেয়ে গল্পে ভদ্রলোকের নামটা শুধু বদলে দিলাম। তাছাড়া আমাদের প্রিয় জুকেরবার্গ-সৃষ্ট এই মুখগ্রন্থটির কোনও ক্ষতি হোক তাও আমি চাইনা।
আজ্ঞে হ্যাঁ, দিগম্বরবাবুর ছেলে আমার থেকে বেশ খানিকটা বড় ছিল বলে আমার সাথে মুখচেনা আলাপ থাকলেও বন্ধুত্ব ঠিক ছিল না। তবে ওঁর মেয়ে সবিতা আমার পিসতুতো বোনেদের বান্ধবী, সেই সূত্রে আমারও বন্ধু। সবিতা তখন কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে, একদিন ওদের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে সকাল সকাল এসে হাজির পিসীর বাড়ি। এসেই দিদিকে ধরেছে, চল না প্রিয়াদি, বরাকর বাজারে একটা হারমোনিয়ম কিনতে হবে। দিদি আবার দুষ্টুমি করে বলল, আমার মামাতো ভাই এসেছে, ওকেও নিয়ে যাই, জানিস তো, ও ভাল হারমোনিয়াম চেনে। ভাবটা এই, চল্ না আমাদের সাথে, মজাটা দেখবি!
ও বাবা, এ যা শুনলাম, দিগম্বরবাবু মেয়েকে যন্তোরটা কেনার জন্যে যা টাকা দিয়েছেন, তাতে হয়ত ক'খানা রীড আসবে মাত্র। সবিতা বলল, দ্যাখ, বাবা আমার সম্বন্ধ করছেন। এই অঞ্চলে বাবার সুনাম তো সবাই জানে। তাই আমাকে কিছুটা গান শিখতেই হবে। অন্ততঃপক্ষে দুটো করে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ভক্তিগীতি, লোকগীতি আর আধুনিক হলেই হবে। বাদ্যযন্ত্রের দোকানে গিয়ে বললাম- সাঁকতোড়িয়ার শ্যামাপতিবাবু আমার পিসেমশাই, ওঁর মেয়ের জন্যে একটা হারমোনিয়াম কিনতে চাই। পিসেমশায়ের নামে ভদ্রলোক বিগলিত হয়ে একটা সেকেণ্ড হ্যান্ড হারমোনিয়াম প্রায় জলের দরে দিয়ে দিলেন। হারমোনিয়াম নিয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে সবিতা বাড়ি ফিরে গেল। পরে শুনেছিলাম, সবিতার ভাল বিয়ে হয়েছে, তবে কলকাতা গিয়ে বাসাভাড়া নিয়ে সব আয়োজন করতে হয়েছে।
আজ আর দিগম্বরবাবু এ জগতে নেই, জানিনা ডিসেরগড় অঞ্চলে এখনও তাঁর নামে হাঁড়ি ফাটে কিনা। পরে জেনেছিলাম উনি ছিলেন মারোয়াড়ি, জীন-ধর্মগুরু ঋষভদেবের ডাকনাম 'ষাঁড়' উপাধি গ্রহন করেছিলেন তাঁরা- অবশ্য ওখানে থেকে থেকে বাঙ্গালিই হয়ে গেছিলেন। তবে বাবার উপাধি ছেলে নেয়নি, জৈন লিখত সে। তার কারণ কি বাপের সুনামের প্রতি ঘৃণা, না অন্য কিছু?তা জানিনা, তবে এটুকু জানি বসতবাড়ি আর ঝালবাগান মোড়ের মুদীর দোকানটুকু ছাড়া ছেলে আর কিছুই পায়নি, বাকি সব অস্থাবর সম্পত্তি দিগম্বরবাবু দান করে গেছেন একটা চ্যারিটেবল মিশনকে।
(গল্প, তবু গল্প নয়)
বরাকরের বেগুনিয়া মোড়ে নেমে ডিসেরগড়ের পথে পড়ে ছোট্ট টাউনশিপ ঝালবাগান। সেখানকার ইউনাইটেড ক্লাব JUC ফুটবলের দুর্ধর্ষ দল। ওদেরকে হারাতে পারে ডিসেরগড় কয়লাঞ্চলে এ হেন টীম নেই।তবে এবার কুলটি বন্ধুমহল আর নিরসা এসসি ক্লাব তাদের ভাল চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। ঝালবাগান ইউনাইটেড ক্লাবের মাঠে ঝালবাগান বনাম নিরসার ফাইনাল। দ্বিতীয়ার্ধের ৩৫ মিনিট পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য। ঝালবাগানের গোলকীপার ছাড়া পুরো টীম মরিয়া হয়ে উঠে এসেছে নিরসার পেনাল্টি বক্সে। এমন সময় একটা ভুল পাস থেকে কাউন্টার করল নিরসার ফরোয়ার্ড ছেলেটি। এগিয়ে আসা গোলরক্ষককে কাটিয়ে এগিয়ে গেল সে, ছ'গজ দূরেই ফাঁকা গোল। গোলে শট নেবার মুহূর্তে একজনের কানফাটানো আওয়াজ ভেসে এল- 'দিগম্বর ষাঁ------ড়'। কি হল কে জানে, ছ'গজ থেকে ফাঁকা গোলের বল উড়ে গেল বারের বহু উপর দিয়ে। অবিশ্বাস্য ঘটনা! তারপরই খেলার মোড় ঘুরে যায় আর শেষ মিনিটের গোলে জিতে যায় ঝালবাগান ক্লাব।
এই অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হিসেবে আমার প্রথম কাজ হল এই দিগম্বর ষাঁড়ের খোজ নেওয়া- কে এই স্বনামধন্য মহাপুরুষ। কিন্তু যাকেই শুধোই সেই কানে হাত দিয়ে কেটে পড়ে। কাছাকাছি সাঁকতোড়িয়ায় পিসির বাড়িতে উঠেছি, ছুটি কাটাতে এসে। পিসতুত দাদা ঝালবাগান ক্লাবে খেলেছে সেদিন। ওর কাছে, আর দুই ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম দিগম্বরের বিবরণ। তখনও শীর্ষেন্দুর 'পাতালঘর' বইটা বেরোয়নি, আমরা জানিনে 'অপয়া গোবিন্দে'র কাহিনী। পরে ছবিটা দেখে বুঝেছিলাম অপয়া গোবিন্দ আর দিগম্বর ষাঁড়ের মধ্যে কোনও বিশেষ তফাৎ নেই। তফাতের মধ্যে গোবিন্দ নিজের অপয়া স্টেটাস নিয়ে গর্বিত ছিল, এইটুকু।
একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বরাকর স্টেশন থেকে শেয়ারের অটোয় সাঁকতোড়িয়া আসছি, এমন সময় অটোওলার সাথে এক যাত্রীর ভাড়া নিয়ে বচসা শুরু হল। ভাড়ায় কিছুতেই বনছে না দেখে গ্রাম্য লোকটি রেগে বলল, 'দু'টাকা লিবি নাই? লে তবে, দিগম্বর ষাঁ...', এটুকু বলতেই ফটাস্- একটা টায়ার ফেটে গেল। গাড়ি কোনমতে রাস্তার ধারের নয়ানজুলির মুখে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিথ্যে বলছি না, মহাশয়টি চিরকুণ্ডা থেকে আসানসোল পর্যন্ত একসময় নিজের নামেই বিখ্যাত ছিলেন, ওনার ছেলেমেয়েরা আমার পরিচিত, তাদের মুখ চেয়ে গল্পে ভদ্রলোকের নামটা শুধু বদলে দিলাম। তাছাড়া আমাদের প্রিয় জুকেরবার্গ-সৃষ্ট এই মুখগ্রন্থটির কোনও ক্ষতি হোক তাও আমি চাইনা।
আজ্ঞে হ্যাঁ, দিগম্বরবাবুর ছেলে আমার থেকে বেশ খানিকটা বড় ছিল বলে আমার সাথে মুখচেনা আলাপ থাকলেও বন্ধুত্ব ঠিক ছিল না। তবে ওঁর মেয়ে সবিতা আমার পিসতুতো বোনেদের বান্ধবী, সেই সূত্রে আমারও বন্ধু। সবিতা তখন কলেজে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে, একদিন ওদের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নিয়ে সকাল সকাল এসে হাজির পিসীর বাড়ি। এসেই দিদিকে ধরেছে, চল না প্রিয়াদি, বরাকর বাজারে একটা হারমোনিয়ম কিনতে হবে। দিদি আবার দুষ্টুমি করে বলল, আমার মামাতো ভাই এসেছে, ওকেও নিয়ে যাই, জানিস তো, ও ভাল হারমোনিয়াম চেনে। ভাবটা এই, চল্ না আমাদের সাথে, মজাটা দেখবি!
ও বাবা, এ যা শুনলাম, দিগম্বরবাবু মেয়েকে যন্তোরটা কেনার জন্যে যা টাকা দিয়েছেন, তাতে হয়ত ক'খানা রীড আসবে মাত্র। সবিতা বলল, দ্যাখ, বাবা আমার সম্বন্ধ করছেন। এই অঞ্চলে বাবার সুনাম তো সবাই জানে। তাই আমাকে কিছুটা গান শিখতেই হবে। অন্ততঃপক্ষে দুটো করে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, ভক্তিগীতি, লোকগীতি আর আধুনিক হলেই হবে। বাদ্যযন্ত্রের দোকানে গিয়ে বললাম- সাঁকতোড়িয়ার শ্যামাপতিবাবু আমার পিসেমশাই, ওঁর মেয়ের জন্যে একটা হারমোনিয়াম কিনতে চাই। পিসেমশায়ের নামে ভদ্রলোক বিগলিত হয়ে একটা সেকেণ্ড হ্যান্ড হারমোনিয়াম প্রায় জলের দরে দিয়ে দিলেন। হারমোনিয়াম নিয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে সবিতা বাড়ি ফিরে গেল। পরে শুনেছিলাম, সবিতার ভাল বিয়ে হয়েছে, তবে কলকাতা গিয়ে বাসাভাড়া নিয়ে সব আয়োজন করতে হয়েছে।
আজ আর দিগম্বরবাবু এ জগতে নেই, জানিনা ডিসেরগড় অঞ্চলে এখনও তাঁর নামে হাঁড়ি ফাটে কিনা। পরে জেনেছিলাম উনি ছিলেন মারোয়াড়ি, জীন-ধর্মগুরু ঋষভদেবের ডাকনাম 'ষাঁড়' উপাধি গ্রহন করেছিলেন তাঁরা- অবশ্য ওখানে থেকে থেকে বাঙ্গালিই হয়ে গেছিলেন। তবে বাবার উপাধি ছেলে নেয়নি, জৈন লিখত সে। তার কারণ কি বাপের সুনামের প্রতি ঘৃণা, না অন্য কিছু?তা জানিনা, তবে এটুকু জানি বসতবাড়ি আর ঝালবাগান মোড়ের মুদীর দোকানটুকু ছাড়া ছেলে আর কিছুই পায়নি, বাকি সব অস্থাবর সম্পত্তি দিগম্বরবাবু দান করে গেছেন একটা চ্যারিটেবল মিশনকে।
No comments:
Post a Comment