Friday, February 24, 2017

জ্ঞানবৃক্ষ

জ্ঞানবৃক্ষ -১
ইতিবাচক।

এক পথচারী একবার জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলে। গোটা রাত্রি ঘুরে ঘুরে ভোরবেলায় জঙ্গলের প্রান্তে এক নদীর ধারে সে এসে পৌঁছোয়। সে দেখল, জায়গাটা অপরূপ সুন্দর। দূরে পাহাড়ের মাথায় সূর্যোদয় হচ্ছে, তার বর্ণময় রশ্মি নদীপারের গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে নদীর জলে চুঁইয়ে পড়ছে, দেখে আনন্দে পথিক তার দুশ্চিন্তা, পথশ্রমের কথা ভুলে গেল। সে নদীতীরে একটা গাছের তলায় এসে বসল।

বড় ক্লান্ত, এক গ্লাস শরবত পেলে বেশ হত। ওমা, ভাবামাত্র পথিক দেখে তার পায়ের কাছে ট্রেতে সুসজ্জিত একগ্লাস মিষ্টি সুগন্ধি শরবত। একটু ভয়ে ভয়ে সে সেটা খেয়ে নিল।
আহা, কি সুন্দর জায়গা, কি মনোরম প্রাকৃতিক শোভা। এমন যায়গায় একটা বাংলোবাড়ি থাকলে কে আর শহরে ফিরে যায়? পথিক মনে মনে ভাবতে লাগল। যেই না ভাবা, অবাক কাণ্ড, মুহূর্তে নদীর তীর ঘেঁসে একটা চমৎকার বাগানবাড়ি তৈরি হয়ে গেল, তার চাবি ছন করে পথিকের পায়ের কাছে এসে পড়ল।
আরে, মনে মনে ভাবলাম আর সত্যি হয়ে গেল! তাই ত, কিন্তু এত সুন্দর বাড়ি ভোগ করব একা আমি। বিয়ে ত করি নি, একটা বৌ পেলে এসময় মন্দ হত না। ভাবতেই তাকিয়ে দেখে, একটি সুন্দরী কন্যা মাথা নীচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে তার বরমাল্য।

এবার পথিক সত্যিই বেশ ভয় পেল। কি হচ্ছে এসব, এই নদীতীরে, এই গাছের তলায় কোনও মায়াবী জাদুকর নেই ত? কে জানে যদি কোন দৈত্য বা রাক্ষস আমার সাথে ছলনা করছে...এই রে! আমাকে ত খেয়ে ফেলবে তাহলে।

যেই ভাবা, মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত এক দৈত্য, মস্ত হাঁ করে হাসতে হাসতে সে এসে টপ করে গিলে ফেলল পথিককে। আমার গল্প এখানেই শেষ। গণেশপুরী আশ্রমের গুরুমাঈ চিতবিলাসানন্দ গল্পটি শেষ করে থামলেন। এবার ভক্তরা বল, কি বুঝলে? সবাই চুপ।

গুরুমাঈ নিজেই বোঝালেন শেষে- বৎসগন, এই মানবজীবন এক কল্পতরু। তুমি এখানে বিশ্বাসের সাথে যা চাইবে তাই পাবে। ভাল চাইলে ভাল, খারাপ চাইলে খারাপ। কোনও কিছু এখানে অসম্ভব নয়। তাই নেতিবাচক চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ইতিবাচক ভাব, জীবন সুখে ও শান্তিতে কাটবে। তা নইলে রাক্ষসের পেটে!




জ্ঞানবৃক্ষ- ২

মরণ রে!


জটাবুড়ির বয়েস - তা আশি ত হবেই। শরীর নড়বড়ে, হাত পা চলে না, চোখে দেখে না বুড়ি। এই বয়েসে দরকার ছিল ছেলে-বউয়ের সেবার, তা ছেলেও ত বৌ নিয়ে কেটে পড়েছে শহরে, এখন আর টাকাও দেয়না একটা। কিন্তু পেট ত চালাতে হবে। ঘরদোর ভেঙে পড়ছে, আবোল-তাবোলের বুড়ির বাড়ির মত কোনমতে কাঠি-কুটি গুঁজে আটকে রেখেছে। সারাদিন মাঠে জঙ্গলে কাঠকুটো কুড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে যায় গঞ্জের হাটে, বিক্রী করে যা হাতে আসে তাতে একটা পেটচলে যায় কোনোক্রমে।

তবে আজ আর পারছে না জটাই। পরশু রাত থেকে জ্বর ছিল, আজ সকালে জ্বর ছাড়লেও শরীর দুর্বল। কিন্তু বাড়িতে যে একটা দানাও পড়ে নেই, তাই বাধ্য হয়েই কাঠ কুড়োতে বেরোল বুড়ি।

ঘন্টাদুই ধরে খুঁজে অনেক কাঠ পাওয়া গেছে। এবার বোঝা তুলে হাটে যাওয়ার পালা। কিন্তু কোমরে বড়ই ব্যথা, শরীর যে আর চলে না। 'হে ভগবান, আর কত কষ্ট দেবে গো এ বয়সে। আর যম মুকপোড়াও বলিহারি, আমাকে তুলে নেবার কতা ভুলে মেরে দিয়েচে! ওগো যমরাজা, কোতায় তুমি, এস বাবা আমায় এবার তুলে নাও।'

যমরাজ বোধহয় যমলোকে সোমপান করতে করতে বুড়ির হাহাকার শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি গেলাস নামিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন। 'কি গো বুড়ি, আমায় ডাকাডাকি করছিলে যে বড়! কি সব তোলার কথা হচ্ছিল। কি চাই?' 
'তুমি কে বাবা?'
'আমি যম। তুমি ত আমাকেই ডাকছিলে গো। এখন বল, কি চাও তুমি আমার কাছে?'
' যমরাজা! পেন্নাম হই গো। বাবা, বড় বেপদে পড়েচি। শরীলে বড্ড ব্যতা। তা এলেই যখন, এট্টু বোঝাটা তুলে দাওনি মাতায়।'

'আমার মরণও নেই' কথাটা তো অনেকেই বলে, সত্যি মরতে কে চায়?





জ্ঞানবৃক্ষ- ৩

সকলই তোমারি ইচ্ছা।


'হে মা কালী, দয়া কর। আমার ছেলেরই যেন চাকরিটা হয়। তোমার পুজোয় এবার একটা আস্ত পাঁঠা দেব, হেই মা গো!' স্বপ্নের মধ্যেই যেন মা কালী এসে দেখা দিয়েছেন সিভিল কন্ট্রাক্টার ক্ষেত্রবাবুকে। ছেলে সার্ভেয়ারের কাজের ইন্টারভিউ দিয়েছে পিডাব্লুডিতে। ক্ষেত্রবাবু ভালভাবেই জানেন যে সেটা সোনার খনি। একবার ঢুকতে পারলে একদিন সুপারভাইজার হবেই, তারপর- দুহাতে টাকা। তাই আজ মা কালীকে ছাড়া চলবে না। 

হঠাৎ যেন মা কথা কয়ে উঠলেন।
'সে কি রে! অমন একটা চাকরির বদলে শুধু একটা পাঁঠা! ইঞ্জিনীয়ার মদন পাণ্ডে তার ছেলের জন্যে জোড়া পাঁঠা, তাছাড়া সোনার চেন মানত করেছে। তা চাকরিটা তার ছেলে পাবে না কেন?'
'মা, শেষ পর্যন্ত তুমি পাণ্ডের তাঁবেদারি করলে! কে না জানে ওর ঘুসের টাকা!' এবার একটু উষ্মা প্রকাশ পায় ক্ষেত্রবাবুর গলায়, 'আমার পাওনার দশ পারসেন্ট ওর পকেটেই ত যায়।' 
'তাহলে বাটপাড়িয়ার ভাই চাকরিটা পাবে না কেন বল? ও একটা মন্দির বানিয়ে দেবে বলেছে বটতলার মোড়ে।'
'মা, মারোয়াড়ি ব্যবসাদারদের অনেক টাকা। তার ভাইএর চাকরির কি দরকার বল? আমি যে মধ্যবিত্ত, দিন আনি দিন খাই।'
'তাহলে বরং তোর কথামত সিঙ্গাড়াওলা পঞ্চাননের নাতিটাকেই চাকরিটা করে দিই কি বল? ও মাত্র পাঁচ সিকের পুজো দিয়েছে। বেচারা এত গরীব, এর বেশী আর পারল না।'

এবার স্পষ্টতঃই মেজাজ হারিয়ে ফেললেন ক্ষেত্রবাবু। আর কোন যুক্তি নেই তাঁর কাছে। ঠাকুর-দেবতারা যে উকিলের মত জেরা করবেন তাঁর সাথে এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি, অথচ আজকের স্বপ্নে তাই ঘটে যাচ্ছে। 'তাহলে মা, তোমার যা ইচ্ছে তাই কর- আমার কিছু বলার নেই', তিনি অগত্যা বললেন। 

'ওরে আমি ত তাই করি যা আমার ইচ্ছে হয়। তোরাই মিছে মিছে মানত-মন্দির-ধর্ণা এসব নিয়ে ছোটাছুটি করিস'- এই বলে মা কালী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।



জ্ঞানবৃক্ষ- ৪
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক!

'গুরুদেব, স্বর্গ কী এবং নরকই বা কী? কেউ কেউ বলেন- মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর, কথাটা কি সত্যি?' শিষ্য একদিন গুরুকে এই প্রশ্নটা করেই ফেলল।
'ওরে, মরার পরে কী হয় জানিনে, তবে এই পৃথিবীতে যদি স্বর্গ আর নরক দেখতে চাস, আয় আমার সঙ্গে', গুরু শিষ্যকে নিয়ে চললেন।
তাঁরা দুজন একটা ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। খোলা জানলা দিয়ে শিষ্যকে দেখতে বললেন ভেতরের দৃশ্য।

সেখানে একটা বড় হলঘরে অনেক লোক চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে। ঘরে অজস্র সুখাদ্য থরে থরে সাজানো। কিন্তু খাবে কি করে, তাদের প্রত্যেকের হাত বাঁধা আর খাবার আছে গভীর পাত্রের ভেতরে, মুখ দিয়ে খাবার উপায় নেই। বড় বড় চামচ অজস্র, কিন্তু কিভাবে ব্যবহার করবে বুঝতে না পেরে সবাই ক্ষুধার্ত হয়ে হিংস্রভাবে হই-হট্টহোল আর মারামারি করছে। সেখান থেকে সরে এসে গুরু শিষ্যকে অন্য একটা ঘরের কাছে নিয়ে এলেন।
দ্বিতীয় ঘরটাতেও প্রায় এক দৃশ্য। সেই হাত-বাঁধা মানুষ-জন, সেই একধরণের পাত্রে সুখাদ্য রাখা, সেই চামচ। অথচ কেউ গোলমাল করছে না। শিষ্য অবাক হয়ে দেখে, একজন মুখে চামচের হাতলটা ধরে খাবার নিয়ে অন্যজনকে খাইয়ে দিচ্ছে। একজনের খাওয়া হয়ে গেলে সে এবার যে খাইয়েছে তাকে একইভাবে খাইয়ে দিচ্ছে। এভাবে পরস্পরকে খাইয়ে দেওয়ায় কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে না, সবারই পেট ভরছে।
গুরু বললেন-'কি রে, কোনটা স্বর্গ আর কোনটা নরক, সেগুলো কোথায় আর তাদের মধ্যে তফাৎ কী সব এবার মাথায় ঢুকল?' শিষ্য ঘাড় নাড়লেও জিজ্ঞাসা তার তখনও ফুরোয় নি।
- 'তাহলে গুরুদেব, এর মধ্যে আপনার ভূমিকাটা কী? লোকে কেন
খামখা আপনার শিষ্যত্ব নেবে?'
- 'তাহলে বৎস গুরুবন্দনা স্মরণ কর-
অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্‌।
তদ্প‌দং দর্শিতং যেন তস্মৈঃ শ্রীগুরবে নমঃ।।
গোলাকার পাত্রে সুখাদ্য সর্বত্রই সাজানো আছে, তবু লোকে খেতে পায় না, মারামারি করে মরে। তদ্পদং দর্শিতং, মানে ওই মুখে চামচে ধরে পরস্পরকে খাওয়ানোর বুদ্ধিটা কে দেয় তাহলে!!'
(প্রচলিত কাহিনী, নবরূপে পরিবেশন)



জ্ঞানবৃক্ষ- ৫
চিকিৎসা (১)

গুরু ভেষজাচার্য ধন্বন্তরীর গুরুকুল আশ্রমে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নে রত ছাত্রেরা। অধ্যয়নের সাথে সাথে হাতে-কলমে শিক্ষার পাঠের দিকেও গুরুর নজরে কিন্তু ঘাটতি নেই। তিনি সবসময় বলে থাকেন ভেষজশাস্ত্র, শল্যচিকিৎসা যতটা না বিজ্ঞান, তারচেয়েও কিছু বেশি ব্যবহারবিধি আর মনোবিদ্যা। চিকিৎসা শুধু ওষুধ বা কাটাছেঁড়া দিয়ে হয় না, প্রয়োজনে রোগীর মনের গভীরে ঢুকতে হবে চিকিৎসককে। এই বলে তিনি রোগীর মানসিক অবস্থা, পারিবারিক শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি, সংস্কার এগুলোর গুরুত্ব নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ বোঝালেন। অন্যেরা বুঝলেও একটি ছাত্রের কিন্তু সংশয় যায় না। 'গুরুদেব, একটা অন্ততঃ নিদর্শন আমি নিজের চোখে দেখে বুঝতে চাই, আমাকে সে সুযোগটা দিন।'

- 'ঠিক আছে। বিকেলে আমি বাসায় বসে যখন রোগী দেখি, আমার সঙ্গে থাকবি কটা দিন, দেখবি আমি কিভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলি, কেমন ব্যবহার করি।' শিষ্য সম্মত হল। গুরু রোগী দেখেন, চিকিৎসা করেন, শিষ্য ওষুধের পুরিয়া তৈরি করে, বোতলে তরল আসব ঢালে আর গুরুকে লক্ষ্য করতে থাকে। কয়েকদিন পরে এক মধ্যবয়সী শ্রেষ্ঠী এল, তার একটা ছোট ঘা সারে না, বারবার মূত্র হয়। 'হুঃ, শর্করাধিক্য হয়েছে, বহুমূত্রের লক্ষণ স্পষ্ট। এখন দু'দাগ ওষুধ দিচ্ছি, তিনদিন পরে আবার এসো।'
তিনদিন পরে শ্রেষ্ঠী এলে আচার্য তাকে শুধোন, 'খুব মিষ্টি খাও, না?' 'আজ্ঞে হ্যাঁ, মিষ্টান্ন ছাড়া কিছু খাবারে রুচি হয় না আমার।'
- 'শোন হে শ্রেষ্ঠী। আজ থেকে সবরকম মিষ্টি বাদ, শর্কর, গুড়, মিষ্টফল, আখের রস একদম ছোঁবে না যদি বাঁচতে চাও। বুঝলে?'
-'আজ্ঞে হ্যাঁ', শ্রেষ্ঠী সম্মত হল, তারপর আচার্যকে নমস্কার করে বাড়ি ফিরে গেল।
শিষ্য এতক্ষণ দেখছিল মনোযোগ দিয়ে। এবার সে আর থাকতে পারল না। বলল, 'গুরুদেব, শ্রেষ্ঠী প্রথম যেদিন এল, সেদিন আপনি কিছু বললেন না, ওষুধের নামে সামান্য খানিকটা যবক্ষারচূর্ণ দিয়ে বিদায় করলেন। আজ সে কী এমন নতুন কথা জানাল যে তাকে মিষ্টি খেতে মানা করলেন? এ কাজ তো সেদিনও করতে পারতেন!'
- 'না রে, পারতাম না। মনে করে দেখ সেদিন আমার এই ঘরে কাঁচের বোয়ামে সাজানো ছিল মিশ্রী আর বাতাসা, ঘরের কোণায় রাখা ছিল গুড়ের বস্তা। এই অবস্থায় তাকে যদি শর্করা ত্যাগ করতে বলতাম, সে কী শুনত? না, আমাকে দ্বিচারী ভাবত! গতকাল সব শর্করজাতীয় দ্রব্য এ ঘর থেকে স্থানান্তরিত করেছি, তবে শ্রেষ্ঠীকে পুনর্বার ডেকেছি। জানিস তো, শাস্ত্রে বলে 'আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও। বুঝলি?'

শিষ্য বুঝল। তবু গুরু বললেন, 'এখনও মনস্তত্ত্বের আরেকটা শিক্ষা বাকি আছে। কিছুক্ষণ আগে যে রাজ-করণিক ডাকতে এসেছিল তার ছেলেকে দেখতে যাবার জন্যে, সেখানে তুই যাবি আমার সঙ্গে সহায়ক হিসেবে, ঠিক আছে?'

যে আজ্ঞে গুরুদেব, শিষ্য বলে।   


জ্ঞানবৃক্ষ- ৬
চিকিৎসা (১)

গুরু ভেষজাচার্য ধন্বন্তরী তাঁর গুরুকুল আশ্রমে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নরত ছাত্রদের মধ্যে একজনকে আর কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না যে রোগীর আচার আচরণ, পারিবারিক অবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষা আর মনস্তত্ব বুঝে তবেই তার চিকিৎসা করা উচিত। তাতে সুচিকিৎসা হয় আর কবিরাজের পসারও বাড়ে। তিনি ঠিক করেছেন ক'দিন নিজের সঙ্গে রেখে রোগী দেখার সময় তাকে সঙ্গী করে হাতে-কলমে সব শেখাবেন।
সেদিন গুরু ডাক পেয়ে গেছেন এক রোগীর বাসায়, শিষ্য চলেছে সঙ্গে সরঞ্জামের বাক্সটি বয়ে। বাড়িতে ঢোকার মুখে গুরু বললেন, সব লক্ষ্য রাখবি আমি কী করছি আর কেন করছি আর প্রশ্ন যা কিছু মাথায় আসবে সব এখন নয়, ফেরার পথে। শিষ্য সমঝদারের মত ঘাড় নাড়ল। 
রোগী একটা দশ বছরের ছেলে। খুব পেট কামড়াচ্ছে, বার পাঁচ-ছয় পায়খানা হয়েছে। ভেষজাচার্য প্রথমে গিয়ে রোগীকে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন, তারপর বললেন- 'হুঁ, গুচ্ছেক কাঁচা পেয়ারা খাওয়া হয়েছে বুঝতে পারছি। ওসব আর চলবে না। এখন দু'দিন শুধু যবের মণ্ড আর গুড়-লেবুর শরবত খাবে। দুপুরে পাতলা খিচুড়ি, ব্যস।' এই বলে রোগীকে একটা তেতো পাঁচন খাইয়ে সম্মানদক্ষিণা নিয়ে বিদায় নিলেন।

পথে শিষ্য গুরুকে ধরেছে- 'কিভাবে কী জানলেন গুরুদেব? কাঁচা পেয়ারার কথাও কি নাড়ি দেখে টের পাওয়া যায়? ওই বিদ্যাটা আমাকে শিখিয়ে দিতেই হবে।'
'ওরে মুর্খ, নাড়ি দেখে কি পেয়ারা বোঝা যায়? চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। আমি ঘরটাতে গিয়ে প্রথমেই চারপাশটা একবার দেখে নিই ভাল করে। তারপর নাড়ি দেখার সময় কায়দা করে হাতড়ে একটা কাঁচা পেয়ারা পাই বালিশের তলে। রোগীকে এসব দিয়ে একটু চমকে দিতে পারলে চিকিৎসকের উপর ভরসা বাড়ে, তাতে রোগী চিকিৎসার পদ্ধতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে আর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে। বুঝলি?'
'আজ্ঞে, হ্যাঁ গুরুদেব।' শিষ্য পরম বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল।
কয়েকদিন পরে ডাক এসেছে আরেক বাড়ি থেকে। গুরু বললেন, তুই আগে ভেতরে গিয়ে সব দেখে শুনে চিকিৎসা কর, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি, দরকার পড়লে তবেই ডাকিস। শিষ্য খুশিমনে রোগীর বাসায় ঢুকল।
রোগী এক বিধবা বুড়ি, তার সাংঘাতিক অম্বল, গা গুলোচ্ছে। শিষ্য ঘরে গিয়েই তো চারপাশ খুঁজে দেখতে শুরু করেছে, এটা-ওটা হাতড়ায়। 'কাল রাত্রে কী খেয়েছেন বলুন তো বুড়িমা? নিশ্চয় আজেবাজে কিছু পেটে গেছে!'
'না বাবা, চার কুড়ি বছর বয়স হতে চলল, কী আর খাব এ বয়সে......!' ইতিমধ্যে শিষ্যের চোখে পড়েছে ঘরের এক কোনায় একটা খোঁড়া বাছুর বাঁধা, তার একটি পা নেই। উল্লসিত শিষ্য বলে- 'কেন, বাছুরের ঠ্যাং খান নি? হুঁ হুঁ ব্বাবা, আমাকে ফাঁকি দেওয়া......!'

গোলমাল শুনে গুরু হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে দেখে শিষ্যকে বাড়ির লোকেরা খড়ম, ঝাঁটা আর ছাতা দিয়ে পেটাচ্ছে। কোনমতে তাকে উদ্ধার করেন গুরু।        


জ্ঞানবৃক্ষ- ৭

চিকিৎসা (২)


রাজগৃহ, মগধ, ৫৪০ খ্রীস্টপূর্ব

রাজগৃহের বর্তমান নাম রাজগীর। এই রাজগীর এখন বিহার প্রদেশে হলেও সে যুগে এটি মগধের একটি বড় শহর ও রাজধানী ছিল। একদিন মগধের মহারাজা বিম্বিসারের ছেলে অভয় কুমার বনের মধ্যে এক পরিত্যাক্ত সদ্যোজাত শিশুকে কুড়িয়ে পান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে শিশুটি ছিল শালবতী নাম্নী এক গণিকার পুত্রসন্তান যাকে সে জন্মের পরই বনে ফেলে আসে। অভয় কুমার তাকে পরম যত্নে নিজের প্রাসাদে নিয়ে এসে পুত্রবৎ লালন পালন করেন। মৃত্যুর জন্য পরিত্যক্ত হয়েও নবজাতক জীবিত রয়েছে, তাই তার নাম দেন জীবক- জীবক কুমারভচ্চ। তিনি শিশুটির লালন পালনের সাথে সাথে তাকে নানান শাস্ত্র ও শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলেন। মগধের পাঠ শেষ হলে অভয় কুমার জীবককে উচ্চশিক্ষার জন্যে তক্ষশীলা পাঠান। 

 নালন্দা আর তক্ষশিলা সে সময় বিদ্যাচর্চার স্বর্গভূমি ছিল। তক্ষশিলায় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের জনক  কাশীধামের আচার্য সুশ্রুতের ভাবশিষ্য বিশ্ববিখ্যাত আয়ুর্বেদাচার্য আত্রেয়ের কাছে জীবক ও অন্য ছাত্রেরা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর শিক্ষা প্রায় সমাপ্ত হলে আচার্য ছাত্রদের সমাবর্তন উৎসব উপলক্ষে একটি গুরুদক্ষিণা চান। তক্ষশিলার চারদিকে তখন ঘন জঙ্গল। জনপদকে কেন্দ্র করে এক যোজন দূরত্ব থেকে তিনি ছাত্রদেরকে এমন কিছু উদ্ভিদ সংগ্রহ করে আনতে বলেন যার মধ্যে কোন ঔষধি গুণ নেই। যে যত এরকম গাছপালার ডাল এনে দেখাতে পারে সে তত বড় চিকিৎসক হবার ক্ষমতা রাখবে এমনটাই বলা হয় তাদের। সব ছাত্রেরা সারা দিন ঘুরে প্রত্যেকেই বেশ কিছু উদ্ভিদ নিয়ে আসে, যাদের মধ্যে নাকি কোন ভেষজ গুণ নেই। আত্রেয় এসব দেখেও দেখেন না। তিনি জীবক ফেরেন না বলে চিন্তামগ্ন। এদিকে জীবক গোটা দিন ধরে গাছগাছড়া খুঁজে চলেছেন। তাঁর হাতে আসছে একের পর এক গাছ- কালমেঘ, অশ্বগন্ধা, থানকুনি, বিষাক্ত আকন্দ আর ধুতুরা, লজ্জাবতী লতা, কিন্তু পরীক্ষা করে দেখেন প্রতিটির মধ্যেই কোন না কোন ভেষজ বা ঔষধি গুণ বর্তমান। শেষে লজ্জিত, ক্লান্ত জীবক সারাদিন ঘোরাঘুরি করে খালি হাতে ফিরে এসে মলিনমুখে আচার্য্যকে নিজের ব্যর্থতার কথা বললেন। জানালেন যে তিনি এমন কোন উদ্ভিদ দেখেননি যার কোন প্রকার ঔষধি গুণ নেই। কিন্তু পরিবর্তে আচার্য আত্রেয় রাগ তো করলেনই না, বরং অত্যন্ত প্রীত হয়ে বললেন যে সব ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জীবকের শিক্ষাই সম্পুর্ণ ও সফল হয়েছে। তিনি তাঁকে স্নাতক উপাধি ও প্রমাণপত্রের সাথে কিছু অর্থ দিয়ে মগধে ফিরে গিয়ে স্বতন্ত্রভাবে চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রয়োগ শুরু করার নির্দেশ দিলেন।

কথিত আছে মগধে শিষ্য জীবক ঠিকমতো চিকিৎসা করছেন না সব শাস্ত্র ভুলে গেছেন তাই নিয়েও গুরু আত্রেয়ের চিন্তা থাকত। পরীক্ষা করার জন্যে তিনি একবার একজনের হাতে শিষ্যের কুশল জিজ্ঞাসা করে চিঠি দিয়ে রাজগীর পাঠালেন। অনেক দূরের পথ, তিনি লোকটিকে নির্দেশ দিলেন যেন যাত্রাকালে শুধুমাত্র তেঁতুলগাছ খুঁজে তার তলায় বিশ্রাম নেয়। 

লোকটি তাই করে, কিন্তু সে মগধ পৌঁছে বেশ ভালরকম অসুস্থ হয়ে পড়ে। জীবক তাকে যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে শুধিয়ে গুরুর নির্দেশটি জেনে ঘটনাটি বুঝে ফেলেন ও পত্রের জবাব লিখে লোকটিকে নির্দেশ দেন যেন ফেরার পথে সে কেবলমাত্র নিমগাছের তলায় বিশ্রাম নেয়। লোকটি জীবকের নির্দেশ পালন করে তক্ষশিলা পৌঁছোতেই পুনরায় সুস্থ হয়ে ওঠে। আত্রেয় তার কাছ থেকে সব বিবরণ জেনে পরম আশ্বস্ত হন যে তাঁর শিষ্য অধীত বিদ্যা ভোলা তো দূর, এখন চিকিৎসা-বিদ্যার শীর্ষে আছেন।    
 কালক্রমে জীবক কুমারভচ্চ মগধ-নরেশ বিম্বিসার, রাজপুত্র অভয়কুমার, কৌশাম্বী-নরেশ চণ্ড প্রদ্যোৎ, মগধের নাগরিকবৃন্দ, বুদ্ধদেব ও অন্যান্য বৌদ্ধভিক্ষুদের চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই সময় তিনি ধীরে ধীরে বুদ্ধ ও তাঁর ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে বুদ্ধের উপাসক হন। পালি শাস্ত্র ত্রিপিটকে তার নাম জীবক কুমারভচ্চ উল্লিখিত আছে ও এও লেখা আছে যে তিনি সে সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ছিলেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের বেশ কয়েকবার চিকিৎসা করেছিলেন, এমনকি অস্ত্রোপচারও করেন। রাজগৃহ নগরীতে তাঁর আম্রবন তিনি বুদ্ধ ও ভিক্ষু সংঘকে দান করেছিলেন যা পালি শাস্ত্রে "জীবক অম্ববন" নামে উল্লিখিত হয়েছে। 



জ্ঞানবৃক্ষ- ৮ সুরমায়া
এক দেশে এক ব্য়াধ ছিল। কিন্তু সে মানুষটা যত ভাল ছিল, সে হিসেবে তীরন্দাজ তেমন ছিল না। একদিন এক হরিণের পেছনে ধাওয়া করতে করতে সে বনের অনেক গভীরে চলে যায়। হঠাৎ হরিণ অদৃশ্য় হয়ে যায় কিন্তু তার কানে ভেসে আসে এক অপরূপ মনমাতানো সুর। কে গায়? সুর লক্ষ্য় করে গিয়ে দেখে এক সাধক একমনে গেয়ে চলেছেন, আশেপাসের মানুষজন, পশুপাখি সব একত্রে বসে সে সুরের মূর্ছনা উপভোগ করছে। ব্য়াধ ভাবে, এ জন্মে আর তো কিছু পেলাম না, এই স্বর্গীয় সংগীত যদি কিছুটাও শিখতে পারি, জীবন ধন্য় মনে করব। সে সাধকের পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে সুরের ভিক্ষা চাইল।
অনেক সাধ্য়সাধনার পর সুরের সাধক, যাঁর নাম শার্ঙ্গদেব, শেখাতে রাজি হলেন। নাড়া বেঁধে গুরুগৃহে থেকে ব্য়াধ বীণা শিখতে শুরু করল। বহুকালের সাধনার পর গুরু বললেন, বৎস, তোমার শিক্ষা শেষ, এবার লোকালয়ে ফিরে যেতে পার। তবে আমার শিষ্য় হিসেবে আশা করব যে এই শিক্ষার তুমি কোন দুরুপযোগ করবে না। ব্য়াধ প্রণাম করে চলে গেল।
সংগীতের শিক্ষা তো পেল, কিন্তু তখনকার সমাজের বর্ণাশ্রম প্রথা অনুযায়ী ব্য়াধ শুধু প্রাণীহত্য়া, মাংসবিক্রির কাজই করতে পারত, অন্তত: জীবিকার জন্য়ে আর কোন উপায় ছিল না। এখন সে বিয়েও করেছে, আর একা নয়। তার যা শরসন্ধান, শিকার করা ক্রমেই দুরূহ হতে লাগল তার কাছে। স্ত্রীও গঞ্জনা দেয়- বীণা বাজালে কি পেট ভরবে- ইত্য়াদি! অগত্য়া জীবন আর জীবিকা নির্বাহের জন্য়ে ব্য়াধ এক অদ্ভুত কাজ করল। সেদিন সকালে তার বীণায় ফুটে উঠল স্বর্গীয় যত সুর। বীণাস্বরে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে এল বনের এক হরিণ, ভয় ভুলে মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল বীণা। এমন সময় বীণা থেমে গেল, ব্য়াধের হাতে উঠে এসেছে ধনুর্বাণ। মুহূর্তে হরিণের প্রাণনাশ হল। মুমূর্ষু মৃগ গেয়ে উঠল-
"একটি পত্র যবে কেঁপে ওঠে বনে,
ছুটে যাই সিংহল দ্বীপ
তোমার বীণার সুরে সেই আমি আজ
শিরকে দিলাম বকশিস।
শির কেটে মোর দেয়ালে সাজাও
মাংস খাবে তো খাও,
মোর মৃগছালে তুমি আসন করে
সদা বসে বীণা বাজাও।"
সহসা একি পরিবর্তন এল ব্য়াধের মনে, এ আমি কী করলাম, এই কি ছিল আমার গুরুর শিক্ষা! সেও কাঁদতে লাগল এই বলে-
"আর কি বাজবে হায় বীণা?
ছিন্ন হল যে সব তার।
এমন শ্রোতা যদি বিদায় নিল
বীণা কি বাজবে বল আর!"



জ্ঞানবৃক্ষ- ৯
আচার-বিধির জন্ম
গুরুদেবের প্রধান শিষ্য় পুণ্ডরীকের মাতৃদায়, আজ শ্রাদ্ধের যজ্ঞ হবে, সকাল থেকেই গুরুকুল তোলপাড়। পুণ্ডরীকের বিশেষ অনুরোধে গুরুদেব দায়িত্ব নিয়েছেন যজ্ঞের, গুরুভায়েরা যোগাড়-যন্তর নিয়ে ছোটাছুটি করছে, কারো নি:শ্বাস ফেলার সময় নেই। গুরুদেব অনেকক্ষণ হল পুরোহিতের সঙ্গে আসন নিয়ে বসে আছেন, এইবার স্বস্তিবচন দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেই হয়। কিন্তু ওদিকে এত দেরি হচ্ছে কেন? পুণ্ডরীকের উদ্দেশ্য়ে একটা হাঁক দিলেন গুরু।
-'এই যে গুরুদেব, হয়ে এল। বটগাছের তলে ভাত-ডাল মেখে রেখে এসেছি, সাতটা কুকুরও এসে পড়েছে। ব্য়স, আর দুটো কুকুরও এসে পড়ল বলে!'
-'এই হতচ্ছাড়া, কুকুর দিয়ে কী হবে রে?' গুরু রেগে বললেন।
-'কেন গুরুদেব, আপনার মাতৃশ্রাদ্ধের দিনে যে ঈশানকোণের একটা বটগাছের তলায় ন'টা কুকুরের জন্য়ে খাবারের আয়োজন করেছিলেন! আমার সব মনে আছে। যতক্ষণ যজ্ঞ চলেছিল, কুকুরগুলোকে খাইয়ে গেছি আমরা। আর আপনিই তো বলেছিলেন, সব ক্রিয়া-পদ্ধতি ভাল করে দেখেশুনে শিখে রাখতে, এখন নিজেই ভুলে গেলেন?'
এইবার গুরুর ধৈর্যচ্য়ুতি ঘটল। 'হ্য়াঁ, বলেছিলাম তো। কুকুরগুলো খুব জ্বালাতন করছিল বলে বলেছিলাম ওদেরকে দুটো ডাল-ভাত দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখতে। এখানে কোন ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট নেই বলে তোরা সেসব উৎপাত বয়ে আনবি? এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোদের!'
তারপর একটু সুর নরম করে বললেন, 'যা হয়েছে, হয়েছে। আয় এবার আসন পেতে বোস। ব্য়াটা কোনটা যজ্ঞের অঙ্গ আর কোনটা নয়, তাও তোরা বুঝতে শিখলিনা এখনও, এটুকু কাণ্ডজ্ঞান হলনা!'
সত্য়ি কথা, আমাদের বিয়ে-পৈতে-যাগ-যজ্ঞে এত যে আচার-অনুষ্ঠান, তার বেশীরভাগই কিন্তু এসেছে ঐ কুকুর তাড়াবার নাম করে- এসব ভেবে দেখার এখন সময় এসেছে।



জ্ঞানবৃক্ষ-১০

দিব্যজ্ঞান।


সর্বজ্ঞ ত্রিকালদর্শী মহাপণ্ডিত গুরুদেব শিষ্যদল নিয়ে পরম সুখে গুরুকুল চালান। তাঁর গুরুকুল নিছক চতুষ্পাঠি নয়, সর্বশাস্ত্র পঠন-পাঠনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বললেই চলে। আশেপাশের শতাধিক গ্রামের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে তাঁর কাছে আসে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্ভার নিয়ে। গুরুদেব কাউকেই ফেরান না, গুরুকুলের সাহাযার্থে কিছু দান-দক্ষিণা নিয়ে তাদের সমস্যার যথাবিহিত সমাধান করেন।

এহেন গুরুদেবের কাছে নিকটবর্তী নগরের এক শ্রেষ্ঠী এসেছেন হন্তদন্ত হয়ে। 'গুরুদেব, আমার কি উপায় হবে?' 'কেন, কি করলি আবার'- গুরুর প্রশ্ন। 'মহাপাপ করেছি, গুরুদেব। আজ সকালে অনবধানে একটা মাকড়সা মেরে ফেলেছি। আমার কি হবে গুরুদেব?'

'তাইত!' গুরুদেব গম্ভীর হয়ে বললেন। 'মাকড় মারলে যে ধোকড় হয়। সে বড় ভয়ংকর ব্যাপার।'
'এর কোনও কাটান নেই, গুরুদেব?' শ্রেষ্ঠীর ব্যাকুল প্রশ্ন।
'আছে, চিন্তা করিস না, তবে তা একটু ব্যয়সাপেক্ষ।'
'করব গুরুদেব, আপনি বলুন। ঈশ্বরের কৃপায় আমার অর্থের অভাব নেই।'
'একটা স্বস্ত্যয়ন করতে হবে, পাপস্খালনের জন্যে ব্রাহ্মণকে এক কলস স্বর্ণমুদ্রা দান আর দরিদ্র-ভোজন করাতে হবে।' গুরুদেব বিধান দিলেন। শ্রেষ্ঠী গুরুদেবকেই এই কাজের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে খুশী হয়ে চলে গেলেন।

এক শিষ্য উদ্‌গ্রীব হয়ে সব ঘটনা দেখে যাচ্ছিল। সে আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করল- 'গুরুদেব, কাল সন্ধ্যায় প্রার্থনাশেষে বটবৃক্ষ থেকে একটা মাকড়শা আপনার জানুতে এসে পড়ে। আপনি তৎক্ষণাৎ সেটিকে পিষে মেরে ফেলেন। আপনার তাহলে কি হবে?'
'কি আর হবে, ধোকড় হবে!'
'একটু খোলসা করে বলুন না গুরুদেব। ধোকড় বস্তুটা কি? সাংঘা্তিক কিছু?'
'ওরে বোকা, ধোকড় মানে কিছুই না। মাকড় মারলে আর কি হবে, কিছুই হবে না! তবে অন্যে যদি মারে, আর সেখান থেকে কিছু পাওয়ার আশা থাকে, তাহলে এই ধোকড়েরই সাংঘাতিক কিছু মানে দাঁড়ায়।'

শিষ্য তখনও ভ্যাবাচ্যাকানন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে গুরুর একটু মায়া হল। তিনি নরম সুরে বললেন,  'দ্যাখ, আমাদের ত আর কিছুই নেই বাবা। যুদ্ধ করতে পারি না, ব্যবসা-বাণিজ্য জানিনা, চাষ-বাসেরও তেমন জ্ঞান নেই- এই পৈতে, কিছুটা সত্যে-মিথ্যেয় মেশানো শাস্ত্রজ্ঞান আর প্রাচীন মুনি-ঋষিদের দেওয়া বর্ণাশ্রমের অধিকারটুকুই সম্বল। তাই দিয়েই ত করে খেতে হবে, তাই না!'

শিষ্যের দিব্যজ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান?) ঘটল। সে ভক্তিভরে গুরুদেবের পায়ের ধূলো নিল।

.

জ্ঞানবৃক্ষ- ১১

মানে না যে!


ঝিঙেটোলার জমিদার চণ্ডীচরণবাবু মস্ত কালীভক্ত মানুষ। তিনি নিজের জমিদারিতে কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিত্যপূজা হয় সেখানে। সকালে স্নান সেরে পূজাশেষে মায়ের প্রসাদান্ন নিয়ে তাঁর উপবাসভঙ্গ হয়, তার আগে জলস্পর্শ করেন না তিনি। অঞ্চলের লোক তাঁকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে আবার তাঁর রক্তচক্ষুকে ভয়ও করে কম না। 

এহেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার কিন্তু পরাস্ত একজনের কাছে যে আবার তাঁর নিজের প্রজা না হলেও তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুরারিমোহনবাবু। মুরারি আধুনিক বিজ্ঞান আর ইংরেজি জানেন, হিন্দু আর পাশ্চাত্য দর্শনও পড়েছেন কিছুটা। কিন্তু বেদান্ত-দর্শনের চেয়ে লোকায়ত দর্শনই তাঁর বেশি প্রিয়, আর সেখানেও তাঁর মনোভূমি দখল করে বসে আছেন যাঁরা তাঁদের নাম ঋষি চার্বাক, জাবালি আর বোধিসত্ত্ব। মা কালী বা কোন দেবদেবীরই স্থান নেই সেখানে। জমিদারের সঙ্গে এ নিয়ে তাঁর তর্ক হয় মাঝে মাঝেই, কিন্তু কোন বিরোধে না গিয়ে অনায়াস তাচ্ছিল্যে সব কিছু এড়িয়ে যান বলে তিনি কিছু বলতেও পারেন না মুরারিবাবুকে।  ফলে একটা জাতক্রোধ থাকলেও কিছু করা হয়ে ওঠে না, শুধু মনে মনেই ফুঁসতে থাকেন।

ইতিমধ্যে একদিন এক ধামাধরা শিক্ষক এসে খবর দিলেন সেদিন নাকি মুরারিবাবু নীতিশিক্ষার পাঠে ছোট ছোট ছাত্রদের বুঝিয়েছেন যে পুণ্যের লোভ না রেখেও ভাল কাজ যেমন পরোপকার, জনসেবা এসব করা যায়। স্বর্গ-নরক বলে পৃথিবীর বাইরে নাকি কিছু নেই, ভাল কাজ করে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার নামই নাকি স্বর্গ। সেবাই নাকি সবচেয়ে বড় ধর্ম, শিব-দুর্গা-কালীর পুজো না করলেও কোন ক্ষতি হয় না। পুজো-টুজো নাকি সব ভড়ং, লোক-দেখানো, লোক ঠকানোর ধান্দা। 

নাস্তিকতা যদি বা মানতে পারতেন চণ্ডীবাবু, কালীপুজোর বিরুদ্ধে কথা বলা নিয়ে রাগে ক্ষেপে গেলেন তিনি। আজ অমাবস্যা, ঠিক করলেন মা-কে পুজোয় সন্তুষ্ট করে এর একটা বিহিত করতে হবে। আবার মুরারি লোকটা নাস্তিক হলেও গ্রামের বিপদে-আপদে বুক পেতে দেন, লোকের যে কোন সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য আর সেবা করেন, পড়ানও ভাল, বিশেষ করে গরীব আর মেধাবী ছাত্রদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান- তাই তিনি গ্রামের সবার প্রিয়। তাই হঠাৎ করে কিছু করতে গেলে লোকে অসন্তুষ্ট হবে, জমিদারেরও বদনাম হবে। অগত্যা শ্যামা মা-ই ভরসা। ১০৮খানা জবাফুল দিয়ে তিনি আজ পুজো করে অঞ্জলি দিলেন।

রাত্রে ঘুমের মধ্যে চণ্ডীচরণ স্বপ্নে দেখলেন মা কালী এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর পাশে। 'কী রে, আজ যে পুজোর বড় ঘটা, কী চাই বল দেখি তোর?'
- 'মা, মুরারিটার বড্ড বাড় বেড়েছে, কী করি বল তো?'
- 'হুম, সব জানি। তা দে না ব্যাটাকে তাড়িয়ে রাজ্য থেকে। তোরই তো পাঠশালা!'
- 'সেটা কি ভাল হবে মা? অন্য প্রজারা, গ্রামের লোকে পাঁচটা কথা বলবে। জমিদার বলে তো যা খুশি করতে পারি না।'
- 'তাইতো! কী করা যায় তাহলে?'
- 'মা, তুমি তো সর্বশক্তিমান। একটা কিছু কর না যাতে ও নিজে থেকেই ভয় পেয়ে পালায়। বা অন্য লোকজন ওর উপর ক্ষেপে গিয়ে মেরে তাড়ায়। সব চেয়ে ভাল হয় মা ওকে তুলে নিলে, তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়।'
- 'না রে, আমার দ্বারা কিছু হবে না। যা করার তোকেই করতে হবে।'

এবার স্পষ্টতঃই অবাক হলেন চণ্ডীবাবু। এটা কী এমন কাজ যে মায়ের পক্ষেও অসম্ভব! তিনি থাকতে না পেরে শুধিয়েই ফেললেন কথাটা।

- 'বুঝি রে ব্যাটা, খুব অবাক লাগছে। কিন্তু আমাদের শক্তি তাদের উপরেই খাটে যারা আমাদের বিশ্বাস করে। একবার রণরঙ্গিনী রূপ ধরে সামনে এলেই ভয়ে অক্কা পায়। কিন্তু মুরারি তো আমাকে মানেই না। শুধু আমাকে কেন, স্বর্গ-নরক, পাপ-পুণ্য, ভূত-ভগবান-জন্মান্তর কিচ্ছু মানে না। ওর আমি করবটা কী? আমাদের যত জারিজুরি সব ভক্ত আর ভণ্ডদের উপর, নাস্তিকের কোন ক্ষতি করতে পারার ক্ষমতা নেই আমার। তাই যা করার সব তোকেই করতে হবে।' এই বলে মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলেন চণ্ডীবাবু। বসে ভাবতে লাগলেন। কী করবেন? ফলাফলের কথা না ভেবে মুরারিকে তাড়িয়ে দেবেন? মায়ের পূজা বন্ধ করে দেবেন? মুরারির কাছে নাস্তিক্যের দীক্ষা নেবেন? না কি যেমন চলছে তেমনই চলতে দেবেন?

আপনারা কি পারবেন চণ্ডীচরণবাবুকে একটু সাহায্য করতে???     


জ্ঞানবৃক্ষ- ১২

এক যে ছিল গাধা!

এক ধোপার এক গাধা ছিল। গাধাটা বুড়ো হয়ে গেছিল বলেই বা অন্য কোন কারণে, ক্রমেই কুঁড়ে আর অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিল, সেই সুকুমার রায়ের নাকওলা সাহেবের গাধার মতো-

"ডাইনে বললে যায় সে বামে
তিন পা যেতে দু'বার থামে।
দেখতে দেখতে থেকে থেকে,
খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে।"

একদিন কিন্তু রাসভ-নন্দন সত্যিই একটা অগভীর শুকনো পাতকুয়োয় পড়ে গেল। ধোপা ভাবল, যাকগে, ব্যাটা কাজ করে না, শুধু খায় আর ঘুমোয়। থাক পড়ে, উঠতে পারে উঠুক, নয়ত মরুক। ও রেগেমেগে বাড়ি চলে এল।
সন্ধেয় গাধা বাড়ি আসে না দেখে ধোপা ওর ছেলেকে নিয়ে কুয়োর ধারে এসে দেখে তখনও গাধা নেতিয়ে শুয়ে আছে। বেঁচে আছে না মরে গেছে ভাল বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেকে বলল, 'ওরে গাধাটা মনে হচ্ছে মরেই গেছে। ভালই হয়েছে, চল দুজনে মিলে ওটাকে কবর দিই। আমি মাটি খুঁড়ছি, তুই কুয়োতে ফেলে যা।'
তাই হ'ল। তখন অন্ধকার ছেয়ে এসেছে, গর্তে গাধাকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছেনা। তবু তারই মধ্যে ঝুড়ি ঝুড়ি মাটি ফেলে বাপ-ব্যাটায় যখন ভাবছে যে গাধার কবর হয়েছে, হঠাৎ দেখে মূর্তিমান লাফিয়ে গর্তের বাইরে। আসলে কী হয়েছে, উপর থেকে মাটি পড়তে শুরু হওয়ায় গাধা ভাবে ওকে উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে, সে পিঠে পড়া মাটি নীচে ঝেড়ে ফেলে তার উপরে উঠে দাঁড়াতে থাকে। এভাবে ধীরে ধীরে মাটির স্তুপ ওর পায়ের তলায় জমতে থাকে আর তিনি ওপরে উঠতে থাকেন- শেষে একলাফে বাইরে। ধোপা আর কী করে, গাধাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
এবার গাধা ভাবতে থাকে ধোপা ওর প্রাণ বাঁচিয়েছে, কৃতজ্ঞতায় সেও মন দিয়ে তার সেবা করতে থাকে। ধোপা খুশি। কিন্তু আমাদের মাথায় এখন অনেক প্রশ্ন।

১) বলি বটে গাধা, কিন্তু তার মাথায় এত বুদ্ধি! বিপদে পড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কি জন্ম-বোকাদেরও মাথা খুলে যায়?
২) মুর্খ আর ফাঁকিবাজ বলে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এই নেতিমূলক ভাবনাটা তার মাথাতেই আসে না। তাই কি সে বিপদকে সুযোগে পরিবর্তিত করে ফেলে।
৩)তাহলে কি সময়বিশেষে বুদ্ধি বা জ্ঞান কম থাকাটাই কাজে দেয়, যাকে ইংরেজিতে বলে- 'Ignorance is bliss'?
৪) ধোপা চেয়েছিল গাধাকে মারতে, কাজ করে না বলে। ভ্রমক্রমে তাকে বাঁচিয়ে ফেলে লাভ কিন্তু দু'জনেরই হল।
৫) গাধা কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝল না, সাধে কি বলে গাধা!
৬) এই গল্পের কি কোন শিক্ষা আছে? আমার তো মাথায় ঢুকছে না, কেউ আমায় বোঝাতে পারেন?  



জ্ঞানবৃক্ষ- ১৩

"দরদস্তুর"



'মরিচ কাটা বেনে' কথাটা শুনেছ? বেনে বা বণিকরা জাত হিসেবে কতটা কঞ্জুষ হয় জানি না, তবে 'ছাঁদাবাঁধা বামুন', 'বদ্যিদের কুটুম', 'স্যাঁকরাদের হরিনাম' এসব যেমন কথায় কথায় চলে আসছে, তেমনি বেনেদের কেউ ভালমানুষ হলেও এই অপবাদটা তাদের প্রায়ই সইতে হয়। কথাটা এল কোত্থেকে? সে কোন এক বেনে দোকানদার ভুল করে আধখানা শুকনো লঙ্কা ওজনে বেশি দিয়ে ফেলেছিল। ব্যাপারটা কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হতেই সে খদ্দেরের পিছনে মাইলখানেক ছুটে গেছিল ওই কাটা মরিচখানা ফেরৎ আনতে।  

এক গ্রামে এরকমই এক হাড়কিপটে বণিক ছিলেন ধনঞ্জয় সাহা। নিমকের ব্যবসায় তাঁর দেশজোড়া খ্যাতি, তবে তাঁকে দেখে সেসব বোঝার উপায় নেই। টাকাপয়সা তাঁর সিন্দুকে ঢোকার পর পারতপক্ষে আর বাইরের হাওয়া খায়না। এহেন সাহামশাই যে অম্লশূলে ভুগলেও বড় ডাক্তার দেখাবেন না, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সেদিন রাত্রে মৌরলার ঝাল আর আমড়ার টক খাবার পর আর পেটের ব্যথায় ঘুমোতে পারেন না, ছটফট করতে থাকেন। হঠাৎ দেয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারে মা কালীর ছবিতে চোখ পড়তেই কি ভেবে যেন মানত করে বসেন- 'মাগো, এই অম্লশূলের ব্যথা সারিয়ে দাও মা, এবার কালীপুজোয় তোমাকে জোড়া মোষ বলি দিয়ে পুজো দেব।' 

মা এর মন্দিরে বলিতে আজকাল মোষ আর খুব একটা পড়ে না, তাই মা কালী মনে হয় এই মানতে একটু খুশি হয়েই ধনঞ্জয়ের শূলের ব্যথা সারিয়ে দিলেন। ধনঞ্জয় ভাবলেন, যাক, ব্যথা এমনিই সেরে গেছে- মানতের কথা তাঁর আর মনে রইল না।

এদিকে মা কিন্তু কিছুই ভোলেন নি। কালীপুজোয় মোষ না পেয়ে তিনি স্বপ্নে দেখা দিলেন ধনঞ্জয়কে- 'কী রে, জোড়া-মোষ মানত করেছিলি, ভুলে গেলি?'
- 'মা, ব্যথা তো আমার নিজে থেকেই সেরে গেল, আবার মোষ কেন?'

মা আর কিছু বললেন না। পরদিন রাত্রে শুরু হল দ্বিগুণ ব্যথা। ছটফট করতে করতে মা কালীকে ডাকাডাকি করতেই তিনি হাজির।
- 'কী, ব্যথা এমনিই সেরে গেছিল, না!'
- 'মা গো তুমি ঠাট্টাও বোঝোনা। তবে মা গো, মোষ আজকাল আর কোথায় কে দেয়? পরের অমাবস্যায় আমি তোমায় বরং জোড়া পাঁঠা দেব।'
- 'বেশ তাই দিস।' মা অদৃশ্য হলেন। ধনঞ্জয়ের ব্যথাটাও বেশ খানিকটা কমল।

অমাবস্যা পেরোল। কোথায় পাঁঠা? আবার মা এলেন স্বপ্নে।
- 'মা গো, ব্যবসায় ভীষণ টানাটানি যাচ্ছে, পাঁঠা পারবনা, বরং তুমি জোড়া হাঁস নাও।'
- 'ঠিক আছে তাই দিস।'
এ যাত্রা গেল। কিন্তু হাঁস আর আসে না। শেষে পরের বার নেমে হল জোড়া পায়রা। তাও দেয়না ধনঞ্জয়। এইবার মা গেলেন  প্রচণ্ড রেগে। ব্যথা আবার ফিরে এল। 'মা, মরে যাব মা, ব্যবসা একদম চলছে না। দুটো পায়রা কিনে যে বলি দেব তার পয়সাও নেই।'
- 'কিন্তু মানত তো রাখতেই হবে, নয়ত নরকে যাবি রে ব্যাটা!'
- 'মা, তাহলে বরং দুটো ফড়িং দেব তোমাকে। দোহাই, পয়সা খরচ করতে পারব না, দয়া কর।'
- 'বেশ তাই দিস।'

আরো গোটা দুই অমাবস্যা পেরোল। ফড়িংয়েরও দেখা নেই। আবার অম্লশূল ফিরে এল। ডাকতেও হল না, মা এবার রণরঙ্গিনী মূর্তি নিয়ে এসে দেখা দিলেন।
- 'পাপিষ্ঠ, তোর এত সাহস, আমাকে কথা দিয়ে তার খেলাপ করিস! একজোড়া ফড়িং পর্যন্ত দিতে পারিস না?'

এবার মায়ের পায়ের উপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়লেন ধনঞ্জয়। মা গো, তুমি কেমন দেবতা, দুটো ফড়িংএর জন্যেও ভক্তকে এমন কষ্ট দাও। ওই তো বাইরে কত উড়ে বেড়াচ্ছে, ধরে খেয়ে নাও না মা যত খুশি!'  
  
মা কালী জীবনে বোধহয় এমন জব্দ হননি।  'সাধে কি বলে মরিচ-কাটা বেনে'- এই বলে তিনি চিরকালের জন্যে অদৃশ্য হলেন।






জ্ঞানবৃক্ষ- ১৪

"ইতি ইতি, নেতি নেতি"

এই? না এ নয়!

''চিন্তাভাবনাসহ যা কিছু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা দিয়ে গঠিত হয় ‘ইহা’ আমাদের ইন্দ্রিয় মনের নাগালের বাইরে যা আছে অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় আর মানসাতীত তা দিয়ে হয় ‘উহা’র গঠন”, গুরু বললেন বুদ্ধিমান শিষ্য এই বিমূর্ত ধারণাটি মানতে রাজি নন। কিন্তু গুরুদেব”, গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে সে প্রতিবাদ করে,যা বাস্তব নয় তা নিয়ে আমরা কেন আমাদের মনকে বিভ্রান্ত করব?”

 গুরু হেসে বললেন, “তুমি এখানে আমাকে এমন কিছু দেখাতে পার যা বাস্তব?” “অবশ্যই”, শিষ্য জবাবে ছাত থেকে ঝুলন্ত একটি ঘন্টার দিকে ইশারা করে বলল, “যেমন ধরুন, এই ঘণ্টাটা। আমি মনে করি এটি বাস্তব তবে আপনি যদি এখানে নেই এমন একটি দ্বিতীয় ঘণ্টার থাকায় বিশ্বাস করতে বলেন, সেটা আমার পক্ষে কঠিন হবে”।

গুরু এবার হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি এই ঘণ্টাটিকে আসল বলছ?”

শিষ্য।। কেন আমি তো এটাকে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!

গুরু।। ধর তুমি অন্ধ হয়ে গেছতাহলে এই ঘণ্টাটি কি অবাস্তব হয়ে উঠবে না?”

শিষ্য।। মোটেও নয়, কারণ এখনও আমি এর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছি
গুরু।। ধর তুমি বধির

শিষ্য।।তবুও আমি এর আকার আর গঠন অনুভব করতে পারি আমার হাত দিয়ে স্পর্শ করে
গুরু।। ধর তোমার স্পর্শের অনুভূতিও নষ্ট হয়ে গেল তাহলে কী হবে?
 এবার শিষ্য যেন কিছুটা ধন্দে পড়ল, “হ্যাঁ, এতে যুক্তি আছে”

তাহলে প্রসঙ্গে ফিরি”, গুরু বললেন, পরিস্থিতিটাকে এবার একটু উল্টো দিক থেকে দেখা যাক। মনে কর তুমি একটি মৃতদেহ যার কোন ইন্দ্রিয়ানুভূতিই নেইঘণ্টার কেন, কোন কিছু বোঝারই তোমার সাধ্য নেই। এবার তোমাকে একটি মাত্র অনুভূতি প্রদান করা হল- স্পর্শের। তুমি এখন স্পর্শ করে ঘণ্টাটি অনুভব করলে আর এটা তোমার কাছে সত্য হয়ে উঠল  আমি এরপর তোমাকে আর একটি অনুভূতি ফিরিয়ে দিচ্ছি, শ্রবণের।তুমি এখন ঘণ্টার শব্দ শুনতে পাচ্ছ এটি কি আরও বাস্তব হয়ে ওঠে না? এখন যদি আমি তোমায় পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই ফিরিয়ে দিই, তোমার জন্যে ঘণ্টাসম্পূর্ণ বাস্তবহয়ে উঠবে কী, সহমত?”

শিষ্য মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ
তবু এ অযৌক্তিক”, গুরু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তুমি কিভাবে অনুমান করলে যে এখানে কেবল পাঁচটি উপলব্ধি আছে? ধর আমি তোমাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিচ্ছি এটি কি ঘণ্টার বাস্তব অস্তিত্বের স্বপক্ষে সম্পূর্ণ এক নতুন মাত্রা যুক্ত করে না? কিম্বা ধর আমি তোমাকে একটি সপ্তম....দশম….. অনুভূতির সহস্রতম ইন্দ্রিয় দিলাম। তাতেও কি ঘণ্টার বাস্তবতা পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়?”

শিষ্যের মুখে আর কথা সরে না, সে নীরব সম্মতিতে আত্মসমর্পণ করে
 “পুত্র!”, গুরু বলেন,  “চিন্তাসহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির প্রকাশ যাতে তাকে আমরা বলি ‘ইহা’ (ইদম্‌) ইন্দ্রিয়ের নাগালের বাইরে যা, অবাঙ্‌মানসগোচর তার নামতাহা’ (তদাঃ) সমগ্র বেদান্ত ‘ইহা’ আর ‘তাহা’ নিয়ে।”

এইবার গুরু ঈশ্বর-বিশ্বাসের বিষয়ে শিষ্যকে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বকে তুমি অস্বীকার করতে পার না কারণ তুমি তাঁকে নিজের সীমিত ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবে না ঈশ্বর ‘তাহা’। নিজের বোধগম্যতার সীমা বুঝতে পারলে মানুষের মনে একপ্রকারের বৌদ্ধিক নম্রতা জন্মায় বিশ্বাস নম্রতার দ্বারা লব্ধ এই জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত আমাদের সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ানুভূতি দিয়ে আমরা যা বুঝতে পারি তা ' বাস্তবের এক সূক্ষ্ম ভগ্নাংশমাত্র এই ‘তদাঃ’ তোমার কল্পনারও নাগালের বাইরে, কারণ  কল্পনা তোমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিরই মধ্যে মূলীভূত, তার বাইরে কিছু নয় তদাঃ’এর বাস্তবতায় কল্পনা কীভাবে  ব্যর্থ হয় তা কল্পনা করতে গেলেও বুঝতে হবে যে,  সমস্ত সংজ্ঞা বা পরিভাষা ‘ইদম’এর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ঈশ্বরের সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।

তাই এতে কোন আশ্চর্য নেই যে আমাদের ঋষিরা ঈশ্বর বা ব্রহ্মের বর্ণনায় সকলে একটি কথাই বলেছেন- নেতি, নেতি (ন-ইতি, ইহা নয়)।





No comments:

Post a Comment