ইতিবাচক।
এক পথচারী একবার জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলে। গোটা রাত্রি ঘুরে ঘুরে ভোরবেলায় জঙ্গলের প্রান্তে এক নদীর ধারে সে এসে পৌঁছোয়। সে দেখল, জায়গাটা অপরূপ সুন্দর। দূরে পাহাড়ের মাথায় সূর্যোদয় হচ্ছে, তার বর্ণময় রশ্মি নদীপারের গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে নদীর জলে চুঁইয়ে পড়ছে, দেখে আনন্দে পথিক তার দুশ্চিন্তা, পথশ্রমের কথা ভুলে গেল। সে নদীতীরে একটা গাছের তলায় এসে বসল।
বড় ক্লান্ত, এক গ্লাস শরবত পেলে বেশ হত। ওমা, ভাবামাত্র পথিক দেখে তার পায়ের কাছে ট্রেতে সুসজ্জিত একগ্লাস মিষ্টি সুগন্ধি শরবত। একটু ভয়ে ভয়ে সে সেটা খেয়ে নিল।
আহা, কি সুন্দর জায়গা, কি মনোরম প্রাকৃতিক শোভা। এমন যায়গায় একটা বাংলোবাড়ি থাকলে কে আর শহরে ফিরে যায়? পথিক মনে মনে ভাবতে লাগল। যেই না ভাবা, অবাক কাণ্ড, মুহূর্তে নদীর তীর ঘেঁসে একটা চমৎকার বাগানবাড়ি তৈরি হয়ে গেল, তার চাবি ছন করে পথিকের পায়ের কাছে এসে পড়ল।
আরে, মনে মনে ভাবলাম আর সত্যি হয়ে গেল! তাই ত, কিন্তু এত সুন্দর বাড়ি ভোগ করব একা আমি। বিয়ে ত করি নি, একটা বৌ পেলে এসময় মন্দ হত না। ভাবতেই তাকিয়ে দেখে, একটি সুন্দরী কন্যা মাথা নীচু করে তার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে তার বরমাল্য।
এবার পথিক সত্যিই বেশ ভয় পেল। কি হচ্ছে এসব, এই নদীতীরে, এই গাছের তলায় কোনও মায়াবী জাদুকর নেই ত? কে জানে যদি কোন দৈত্য বা রাক্ষস আমার সাথে ছলনা করছে...এই রে! আমাকে ত খেয়ে ফেলবে তাহলে।
যেই ভাবা, মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত এক দৈত্য, মস্ত হাঁ করে হাসতে হাসতে সে এসে টপ করে গিলে ফেলল পথিককে। আমার গল্প এখানেই শেষ। গণেশপুরী আশ্রমের গুরুমাঈ চিতবিলাসানন্দ গল্পটি শেষ করে থামলেন। এবার ভক্তরা বল, কি বুঝলে? সবাই চুপ।
গুরুমাঈ নিজেই বোঝালেন শেষে- বৎসগন, এই মানবজীবন এক কল্পতরু। তুমি এখানে বিশ্বাসের সাথে যা চাইবে তাই পাবে। ভাল চাইলে ভাল, খারাপ চাইলে খারাপ। কোনও কিছু এখানে অসম্ভব নয়। তাই নেতিবাচক চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ইতিবাচক ভাব, জীবন সুখে ও শান্তিতে কাটবে। তা নইলে রাক্ষসের পেটে!
জ্ঞানবৃক্ষ- ২
মরণ রে!
জটাবুড়ির বয়েস - তা আশি ত হবেই। শরীর নড়বড়ে, হাত পা চলে না, চোখে দেখে না বুড়ি। এই বয়েসে দরকার ছিল ছেলে-বউয়ের সেবার, তা ছেলেও ত বৌ নিয়ে কেটে পড়েছে শহরে, এখন আর টাকাও দেয়না একটা। কিন্তু পেট ত চালাতে হবে। ঘরদোর ভেঙে পড়ছে, আবোল-তাবোলের বুড়ির বাড়ির মত কোনমতে কাঠি-কুটি গুঁজে আটকে রেখেছে। সারাদিন মাঠে জঙ্গলে কাঠকুটো কুড়িয়ে মাথায় করে নিয়ে যায় গঞ্জের হাটে, বিক্রী করে যা হাতে আসে তাতে একটা পেটচলে যায় কোনোক্রমে।
তবে আজ আর পারছে না জটাই। পরশু রাত থেকে জ্বর ছিল, আজ সকালে জ্বর ছাড়লেও শরীর দুর্বল। কিন্তু বাড়িতে যে একটা দানাও পড়ে নেই, তাই বাধ্য হয়েই কাঠ কুড়োতে বেরোল বুড়ি।
ঘন্টাদুই ধরে খুঁজে অনেক কাঠ পাওয়া গেছে। এবার বোঝা তুলে হাটে যাওয়ার পালা। কিন্তু কোমরে বড়ই ব্যথা, শরীর যে আর চলে না। 'হে ভগবান, আর কত কষ্ট দেবে গো এ বয়সে। আর যম মুকপোড়াও বলিহারি, আমাকে তুলে নেবার কতা ভুলে মেরে দিয়েচে! ওগো যমরাজা, কোতায় তুমি, এস বাবা আমায় এবার তুলে নাও।'
যমরাজ বোধহয় যমলোকে সোমপান করতে করতে বুড়ির হাহাকার শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি গেলাস নামিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন। 'কি গো বুড়ি, আমায় ডাকাডাকি করছিলে যে বড়! কি সব তোলার কথা হচ্ছিল। কি চাই?'
'তুমি কে বাবা?'
'আমি যম। তুমি ত আমাকেই ডাকছিলে গো। এখন বল, কি চাও তুমি আমার কাছে?'
' যমরাজা! পেন্নাম হই গো। বাবা, বড় বেপদে পড়েচি। শরীলে বড্ড ব্যতা। তা এলেই যখন, এট্টু বোঝাটা তুলে দাওনি মাতায়।'
'আমার মরণও নেই' কথাটা তো অনেকেই বলে, সত্যি মরতে কে চায়?
জ্ঞানবৃক্ষ- ৩
সকলই তোমারি ইচ্ছা।
'হে মা কালী, দয়া কর। আমার ছেলেরই যেন চাকরিটা হয়। তোমার পুজোয় এবার একটা আস্ত পাঁঠা দেব, হেই মা গো!' স্বপ্নের মধ্যেই যেন মা কালী এসে দেখা দিয়েছেন সিভিল কন্ট্রাক্টার ক্ষেত্রবাবুকে। ছেলে সার্ভেয়ারের কাজের ইন্টারভিউ দিয়েছে পিডাব্লুডিতে। ক্ষেত্রবাবু ভালভাবেই জানেন যে সেটা সোনার খনি। একবার ঢুকতে পারলে একদিন সুপারভাইজার হবেই, তারপর- দুহাতে টাকা। তাই আজ মা কালীকে ছাড়া চলবে না।
হঠাৎ যেন মা কথা কয়ে উঠলেন।
'সে কি রে! অমন একটা চাকরির বদলে শুধু একটা পাঁঠা! ইঞ্জিনীয়ার মদন পাণ্ডে তার ছেলের জন্যে জোড়া পাঁঠা, তাছাড়া সোনার চেন মানত করেছে। তা চাকরিটা তার ছেলে পাবে না কেন?'
'মা, শেষ পর্যন্ত তুমি পাণ্ডের তাঁবেদারি করলে! কে না জানে ওর ঘুসের টাকা!' এবার একটু উষ্মা প্রকাশ পায় ক্ষেত্রবাবুর গলায়, 'আমার পাওনার দশ পারসেন্ট ওর পকেটেই ত যায়।'
'তাহলে বাটপাড়িয়ার ভাই চাকরিটা পাবে না কেন বল? ও একটা মন্দির বানিয়ে দেবে বলেছে বটতলার মোড়ে।'
'মা, মারোয়াড়ি ব্যবসাদারদের অনেক টাকা। তার ভাইএর চাকরির কি দরকার বল? আমি যে মধ্যবিত্ত, দিন আনি দিন খাই।'
'তাহলে বরং তোর কথামত সিঙ্গাড়াওলা পঞ্চাননের নাতিটাকেই চাকরিটা করে দিই কি বল? ও মাত্র পাঁচ সিকের পুজো দিয়েছে। বেচারা এত গরীব, এর বেশী আর পারল না।'
এবার স্পষ্টতঃই মেজাজ হারিয়ে ফেললেন ক্ষেত্রবাবু। আর কোন যুক্তি নেই তাঁর কাছে। ঠাকুর-দেবতারা যে উকিলের মত জেরা করবেন তাঁর সাথে এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি, অথচ আজকের স্বপ্নে তাই ঘটে যাচ্ছে। 'তাহলে মা, তোমার যা ইচ্ছে তাই কর- আমার কিছু বলার নেই', তিনি অগত্যা বললেন।
'ওরে আমি ত তাই করি যা আমার ইচ্ছে হয়। তোরাই মিছে মিছে মানত-মন্দির-ধর্ণা এসব নিয়ে ছোটাছুটি করিস'- এই বলে মা কালী অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক!
'গুরুদেব, স্বর্গ কী এবং নরকই বা কী? কেউ কেউ বলেন- মানুষেরই মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর, কথাটা কি সত্যি?' শিষ্য একদিন গুরুকে এই প্রশ্নটা করেই ফেলল।
তাঁরা দুজন একটা ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। খোলা জানলা দিয়ে শিষ্যকে দেখতে বললেন ভেতরের দৃশ্য।
খামখা আপনার শিষ্যত্ব নেবে?'
- 'তাহলে বৎস গুরুবন্দনা স্মরণ কর-
অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।
তদ্পদং দর্শিতং যেন তস্মৈঃ শ্রীগুরবে নমঃ।।
গোলাকার পাত্রে সুখাদ্য সর্বত্রই সাজানো আছে, তবু লোকে খেতে পায় না, মারামারি করে মরে। তদ্পদং দর্শিতং, মানে ওই মুখে চামচে ধরে পরস্পরকে খাওয়ানোর বুদ্ধিটা কে দেয় তাহলে!!'
জ্ঞানবৃক্ষ- ৫
চিকিৎসা (১)
গুরু ভেষজাচার্য ধন্বন্তরীর গুরুকুল আশ্রমে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নে রত ছাত্রেরা। অধ্যয়নের সাথে সাথে হাতে-কলমে শিক্ষার পাঠের দিকেও গুরুর নজরে কিন্তু ঘাটতি নেই। তিনি সবসময় বলে থাকেন ভেষজশাস্ত্র, শল্যচিকিৎসা যতটা না বিজ্ঞান, তারচেয়েও কিছু বেশি ব্যবহারবিধি আর মনোবিদ্যা। চিকিৎসা শুধু ওষুধ বা কাটাছেঁড়া দিয়ে হয় না, প্রয়োজনে রোগীর মনের গভীরে ঢুকতে হবে চিকিৎসককে। এই বলে তিনি রোগীর মানসিক অবস্থা, পারিবারিক শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি, সংস্কার এগুলোর গুরুত্ব নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ বোঝালেন। অন্যেরা বুঝলেও একটি ছাত্রের কিন্তু সংশয় যায় না। 'গুরুদেব, একটা অন্ততঃ নিদর্শন আমি নিজের চোখে দেখে বুঝতে চাই, আমাকে সে সুযোগটা দিন।'
- 'ঠিক আছে। বিকেলে আমি বাসায় বসে যখন রোগী দেখি, আমার সঙ্গে থাকবি কটা দিন, দেখবি আমি কিভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলি, কেমন ব্যবহার করি।' শিষ্য সম্মত হল। গুরু রোগী দেখেন, চিকিৎসা করেন, শিষ্য ওষুধের পুরিয়া তৈরি করে, বোতলে তরল আসব ঢালে আর গুরুকে লক্ষ্য করতে থাকে। কয়েকদিন পরে এক মধ্যবয়সী শ্রেষ্ঠী এল, তার একটা ছোট ঘা সারে না, বারবার মূত্র হয়। 'হুঃ, শর্করাধিক্য হয়েছে, বহুমূত্রের লক্ষণ স্পষ্ট। এখন দু'দাগ ওষুধ দিচ্ছি, তিনদিন পরে আবার এসো।'
তিনদিন পরে শ্রেষ্ঠী এলে আচার্য তাকে শুধোন, 'খুব মিষ্টি খাও, না?' 'আজ্ঞে হ্যাঁ, মিষ্টান্ন ছাড়া কিছু খাবারে রুচি হয় না আমার।'
- 'শোন হে শ্রেষ্ঠী। আজ থেকে সবরকম মিষ্টি বাদ, শর্কর, গুড়, মিষ্টফল, আখের রস একদম ছোঁবে না যদি বাঁচতে চাও। বুঝলে?'
-'আজ্ঞে হ্যাঁ', শ্রেষ্ঠী সম্মত হল, তারপর আচার্যকে নমস্কার করে বাড়ি ফিরে গেল।
শিষ্য এতক্ষণ দেখছিল মনোযোগ দিয়ে। এবার সে আর থাকতে পারল না। বলল, 'গুরুদেব, শ্রেষ্ঠী প্রথম যেদিন এল, সেদিন আপনি কিছু বললেন না, ওষুধের নামে সামান্য খানিকটা যবক্ষারচূর্ণ দিয়ে বিদায় করলেন। আজ সে কী এমন নতুন কথা জানাল যে তাকে মিষ্টি খেতে মানা করলেন? এ কাজ তো সেদিনও করতে পারতেন!'
- 'না রে, পারতাম না। মনে করে দেখ সেদিন আমার এই ঘরে কাঁচের বোয়ামে সাজানো ছিল মিশ্রী আর বাতাসা, ঘরের কোণায় রাখা ছিল গুড়ের বস্তা। এই অবস্থায় তাকে যদি শর্করা ত্যাগ করতে বলতাম, সে কী শুনত? না, আমাকে দ্বিচারী ভাবত! গতকাল সব শর্করজাতীয় দ্রব্য এ ঘর থেকে স্থানান্তরিত করেছি, তবে শ্রেষ্ঠীকে পুনর্বার ডেকেছি। জানিস তো, শাস্ত্রে বলে 'আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও। বুঝলি?'
শিষ্য বুঝল। তবু গুরু বললেন, 'এখনও মনস্তত্ত্বের আরেকটা শিক্ষা বাকি আছে। কিছুক্ষণ আগে যে রাজ-করণিক ডাকতে এসেছিল তার ছেলেকে দেখতে যাবার জন্যে, সেখানে তুই যাবি আমার সঙ্গে সহায়ক হিসেবে, ঠিক আছে?'
যে আজ্ঞে গুরুদেব, শিষ্য বলে।
জ্ঞানবৃক্ষ- ৬
চিকিৎসা (১)
গুরু ভেষজাচার্য ধন্বন্তরী তাঁর গুরুকুল আশ্রমে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নরত ছাত্রদের মধ্যে একজনকে আর কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না যে রোগীর আচার আচরণ, পারিবারিক অবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষা আর মনস্তত্ব বুঝে তবেই তার চিকিৎসা করা উচিত। তাতে সুচিকিৎসা হয় আর কবিরাজের পসারও বাড়ে। তিনি ঠিক করেছেন ক'দিন নিজের সঙ্গে রেখে রোগী দেখার সময় তাকে সঙ্গী করে হাতে-কলমে সব শেখাবেন।
পথে শিষ্য গুরুকে ধরেছে- 'কিভাবে কী জানলেন গুরুদেব? কাঁচা পেয়ারার কথাও কি নাড়ি দেখে টের পাওয়া যায়? ওই বিদ্যাটা আমাকে শিখিয়ে দিতেই হবে।'
'ওরে মুর্খ, নাড়ি দেখে কি পেয়ারা বোঝা যায়? চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। আমি ঘরটাতে গিয়ে প্রথমেই চারপাশটা একবার দেখে নিই ভাল করে। তারপর নাড়ি দেখার সময় কায়দা করে হাতড়ে একটা কাঁচা পেয়ারা পাই বালিশের তলে। রোগীকে এসব দিয়ে একটু চমকে দিতে পারলে চিকিৎসকের উপর ভরসা বাড়ে, তাতে রোগী চিকিৎসার পদ্ধতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে আর তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে। বুঝলি?'
সর্বজ্ঞ ত্রিকালদর্শী মহাপণ্ডিত গুরুদেব শিষ্যদল নিয়ে পরম সুখে গুরুকুল চালান। তাঁর গুরুকুল নিছক চতুষ্পাঠি নয়, সর্বশাস্ত্র পঠন-পাঠনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বললেই চলে। আশেপাশের শতাধিক গ্রামের ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে তাঁর কাছে আসে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্ভার নিয়ে। গুরুদেব কাউকেই ফেরান না, গুরুকুলের সাহাযার্থে কিছু দান-দক্ষিণা নিয়ে তাদের সমস্যার যথাবিহিত সমাধান করেন।
এহেন গুরুদেবের কাছে নিকটবর্তী নগরের এক শ্রেষ্ঠী এসেছেন হন্তদন্ত হয়ে। 'গুরুদেব, আমার কি উপায় হবে?' 'কেন, কি করলি আবার'- গুরুর প্রশ্ন। 'মহাপাপ করেছি, গুরুদেব। আজ সকালে অনবধানে একটা মাকড়সা মেরে ফেলেছি। আমার কি হবে গুরুদেব?'
'তাইত!' গুরুদেব গম্ভীর হয়ে বললেন। 'মাকড় মারলে যে ধোকড় হয়। সে বড় ভয়ংকর ব্যাপার।'
'এর কোনও কাটান নেই, গুরুদেব?' শ্রেষ্ঠীর ব্যাকুল প্রশ্ন।
'আছে, চিন্তা করিস না, তবে তা একটু ব্যয়সাপেক্ষ।'
'করব গুরুদেব, আপনি বলুন। ঈশ্বরের কৃপায় আমার অর্থের অভাব নেই।'
'একটা স্বস্ত্যয়ন করতে হবে, পাপস্খালনের জন্যে ব্রাহ্মণকে এক কলস স্বর্ণমুদ্রা দান আর দরিদ্র-ভোজন করাতে হবে।' গুরুদেব বিধান দিলেন। শ্রেষ্ঠী গুরুদেবকেই এই কাজের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে খুশী হয়ে চলে গেলেন।
এক শিষ্য উদ্গ্রীব হয়ে সব ঘটনা দেখে যাচ্ছিল। সে আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করল- 'গুরুদেব, কাল সন্ধ্যায় প্রার্থনাশেষে বটবৃক্ষ থেকে একটা মাকড়শা আপনার জানুতে এসে পড়ে। আপনি তৎক্ষণাৎ সেটিকে পিষে মেরে ফেলেন। আপনার তাহলে কি হবে?'
'কি আর হবে, ধোকড় হবে!'
'একটু খোলসা করে বলুন না গুরুদেব। ধোকড় বস্তুটা কি? সাংঘা্তিক কিছু?'
'ওরে বোকা, ধোকড় মানে কিছুই না। মাকড় মারলে আর কি হবে, কিছুই হবে না! তবে অন্যে যদি মারে, আর সেখান থেকে কিছু পাওয়ার আশা থাকে, তাহলে এই ধোকড়েরই সাংঘাতিক কিছু মানে দাঁড়ায়।'
শিষ্য তখনও ভ্যাবাচ্যাকানন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে গুরুর একটু মায়া হল। তিনি নরম সুরে বললেন, 'দ্যাখ, আমাদের ত আর কিছুই নেই বাবা। যুদ্ধ করতে পারি না, ব্যবসা-বাণিজ্য জানিনা, চাষ-বাসেরও তেমন জ্ঞান নেই- এই পৈতে, কিছুটা সত্যে-মিথ্যেয় মেশানো শাস্ত্রজ্ঞান আর প্রাচীন মুনি-ঋষিদের দেওয়া বর্ণাশ্রমের অধিকারটুকুই সম্বল। তাই দিয়েই ত করে খেতে হবে, তাই না!'
শিষ্যের দিব্যজ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান?) ঘটল। সে ভক্তিভরে গুরুদেবের পায়ের ধূলো নিল।
এহেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদার কিন্তু পরাস্ত একজনের কাছে যে আবার তাঁর নিজের প্রজা না হলেও তাঁরই প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুরারিমোহনবাবু। মুরারি আধুনিক বিজ্ঞান আর ইংরেজি জানেন, হিন্দু আর পাশ্চাত্য দর্শনও পড়েছেন কিছুটা। কিন্তু বেদান্ত-দর্শনের চেয়ে লোকায়ত দর্শনই তাঁর বেশি প্রিয়, আর সেখানেও তাঁর মনোভূমি দখল করে বসে আছেন যাঁরা তাঁদের নাম ঋষি চার্বাক, জাবালি আর বোধিসত্ত্ব। মা কালী বা কোন দেবদেবীরই স্থান নেই সেখানে। জমিদারের সঙ্গে এ নিয়ে তাঁর তর্ক হয় মাঝে মাঝেই, কিন্তু কোন বিরোধে না গিয়ে অনায়াস তাচ্ছিল্যে সব কিছু এড়িয়ে যান বলে তিনি কিছু বলতেও পারেন না মুরারিবাবুকে। ফলে একটা জাতক্রোধ থাকলেও কিছু করা হয়ে ওঠে না, শুধু মনে মনেই ফুঁসতে থাকেন।
নাস্তিকতা যদি বা মানতে পারতেন চণ্ডীবাবু, কালীপুজোর বিরুদ্ধে কথা বলা নিয়ে রাগে ক্ষেপে গেলেন তিনি। আজ অমাবস্যা, ঠিক করলেন মা-কে পুজোয় সন্তুষ্ট করে এর একটা বিহিত করতে হবে। আবার মুরারি লোকটা নাস্তিক হলেও গ্রামের বিপদে-আপদে বুক পেতে দেন, লোকের যে কোন সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য আর সেবা করেন, পড়ানও ভাল, বিশেষ করে গরীব আর মেধাবী ছাত্রদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান- তাই তিনি গ্রামের সবার প্রিয়। তাই হঠাৎ করে কিছু করতে গেলে লোকে অসন্তুষ্ট হবে, জমিদারেরও বদনাম হবে। অগত্যা শ্যামা মা-ই ভরসা। ১০৮খানা জবাফুল দিয়ে তিনি আজ পুজো করে অঞ্জলি দিলেন।
- 'সেটা কি ভাল হবে মা? অন্য প্রজারা, গ্রামের লোকে পাঁচটা কথা বলবে। জমিদার বলে তো যা খুশি করতে পারি না।'
- 'তাইতো! কী করা যায় তাহলে?'
- 'মা, তুমি তো সর্বশক্তিমান। একটা কিছু কর না যাতে ও নিজে থেকেই ভয় পেয়ে পালায়। বা অন্য লোকজন ওর উপর ক্ষেপে গিয়ে মেরে তাড়ায়। সব চেয়ে ভাল হয় মা ওকে তুলে নিলে, তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়।'
"ডাইনে বললে যায় সে বামে
তিন পা যেতে দু'বার থামে।
দেখতে দেখতে থেকে থেকে,
খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে।"
১) বলি বটে গাধা, কিন্তু তার মাথায় এত বুদ্ধি! বিপদে পড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কি জন্ম-বোকাদেরও মাথা খুলে যায়?
২) মুর্খ আর ফাঁকিবাজ বলে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এই নেতিমূলক ভাবনাটা তার মাথাতেই আসে না। তাই কি সে বিপদকে সুযোগে পরিবর্তিত করে ফেলে।
৩)তাহলে কি সময়বিশেষে বুদ্ধি বা জ্ঞান কম থাকাটাই কাজে দেয়, যাকে ইংরেজিতে বলে- 'Ignorance is bliss'?
৪) ধোপা চেয়েছিল গাধাকে মারতে, কাজ করে না বলে। ভ্রমক্রমে তাকে বাঁচিয়ে ফেলে লাভ কিন্তু দু'জনেরই হল।
৫) গাধা কিন্তু আসল ব্যাপারটা বুঝল না, সাধে কি বলে গাধা!
৬) এই গল্পের কি কোন শিক্ষা আছে? আমার তো মাথায় ঢুকছে না, কেউ আমায় বোঝাতে পারেন?
জ্ঞানবৃক্ষ- ১৩
মা এর মন্দিরে বলিতে আজকাল মোষ আর খুব একটা পড়ে না, তাই মা কালী মনে হয় এই মানতে একটু খুশি হয়েই ধনঞ্জয়ের শূলের ব্যথা সারিয়ে দিলেন। ধনঞ্জয় ভাবলেন, যাক, ব্যথা এমনিই সেরে গেছে- মানতের কথা তাঁর আর মনে রইল না।
এদিকে মা কিন্তু কিছুই ভোলেন নি। কালীপুজোয় মোষ না পেয়ে তিনি স্বপ্নে দেখা দিলেন ধনঞ্জয়কে- 'কী রে, জোড়া-মোষ মানত করেছিলি, ভুলে গেলি?'
মা আর কিছু বললেন না। পরদিন রাত্রে শুরু হল দ্বিগুণ ব্যথা। ছটফট করতে করতে মা কালীকে ডাকাডাকি করতেই তিনি হাজির।
- 'কী, ব্যথা এমনিই সেরে গেছিল, না!'
অমাবস্যা পেরোল। কোথায় পাঁঠা? আবার মা এলেন স্বপ্নে।
- 'মা গো, ব্যবসায় ভীষণ টানাটানি যাচ্ছে, পাঁঠা পারবনা, বরং তুমি জোড়া হাঁস নাও।'
- 'ঠিক আছে তাই দিস।'
এ যাত্রা গেল। কিন্তু হাঁস আর আসে না। শেষে পরের বার নেমে হল জোড়া পায়রা। তাও দেয়না ধনঞ্জয়। এইবার মা গেলেন প্রচণ্ড রেগে। ব্যথা আবার ফিরে এল। 'মা, মরে যাব মা, ব্যবসা একদম চলছে না। দুটো পায়রা কিনে যে বলি দেব তার পয়সাও নেই।'
এবার মায়ের পায়ের উপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়লেন ধনঞ্জয়। মা গো, তুমি কেমন দেবতা, দুটো ফড়িংএর জন্যেও ভক্তকে এমন কষ্ট দাও। ওই তো বাইরে কত উড়ে বেড়াচ্ছে, ধরে খেয়ে নাও না মা যত খুশি!'
এই? না এ নয়!
''চিন্তাভাবনাসহ যা কিছু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তা দিয়ে গঠিত হয় ‘ইহা’। আমাদের ইন্দ্রিয় ও মনের নাগালের বাইরে যা আছে অর্থাৎ অতীন্দ্রিয় আর মানসাতীত তা দিয়ে হয় ‘উহা’র গঠন”, গুরু বললেন। বুদ্ধিমান শিষ্য এই বিমূর্ত ধারণাটি মানতে রাজি নন। “কিন্তু গুরুদেব”, গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়ে সে প্রতিবাদ করে, “যা বাস্তব নয় তা নিয়ে আমরা কেন আমাদের মনকে বিভ্রান্ত করব?”
গুরু এবার হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কি এই ঘণ্টাটিকে আসল বলছ?”
শিষ্য।। কেন আমি তো এটাকে আমার চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!
গুরু।। ধর তুমি অন্ধ হয়ে গেছ। তাহলে এই ঘণ্টাটি কি অবাস্তব হয়ে উঠবে না?”
শিষ্য।। মোটেও
নয়, কারণ এখনও আমি এর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে
পাচ্ছি।
গুরু।। ধর
তুমি বধির।
শিষ্য।।তবুও আমি এর আকার আর গঠন অনুভব
করতে পারি আমার হাত
দিয়ে স্পর্শ করে।
গুরু।। ধর
তোমার স্পর্শের অনুভূতিও নষ্ট হয়ে গেল। তাহলে
কী হবে?
এবার
শিষ্য যেন কিছুটা ধন্দে পড়ল, “হ্যাঁ, এতে যুক্তি আছে”।
“তাহলে প্রসঙ্গে ফিরি”,
গুরু বললেন, “পরিস্থিতিটাকে
এবার একটু উল্টো দিক থেকে
দেখা যাক। মনে কর তুমি একটি
মৃতদেহ যার কোন ইন্দ্রিয়ানুভূতিই নেই। ঘণ্টার
কেন, কোন কিছু বোঝারই তোমার সাধ্য নেই। এবার
তোমাকে একটি মাত্র অনুভূতি প্রদান করা হল- স্পর্শের।
তুমি এখন স্পর্শ করে ঘণ্টাটি অনুভব করলে আর
এটা তোমার কাছে সত্য
হয়ে উঠল। আমি এরপর তোমাকে আর একটি
অনুভূতি ফিরিয়ে দিচ্ছি, শ্রবণের।তুমি এখন ঘণ্টার শব্দ
শুনতে পাচ্ছ। এটি
কি আরও বাস্তব হয়ে
ওঠে না? এখন যদি আমি তোমায় পাঁচটি
ইন্দ্রিয়ই ফিরিয়ে দিই, তোমার জন্যে
ঘণ্টা ‘সম্পূর্ণ বাস্তব’ হয়ে উঠবে।
কী, সহমত?”
শিষ্য মাথা নেড়ে
বলল, “হ্যাঁ”।
“তবু
এ অযৌক্তিক”, গুরু গম্ভীর হয়ে
বললেন, “তুমি কিভাবে অনুমান
করলে যে এখানে কেবল
পাঁচটি উপলব্ধি আছে? ধর আমি
তোমাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিচ্ছি। এটি
কি ঘণ্টার বাস্তব অস্তিত্বের স্বপক্ষে সম্পূর্ণ এক নতুন
মাত্রা যুক্ত করে না?
কিম্বা ধর আমি তোমাকে
একটি সপ্তম....দশম…..
অনুভূতির সহস্রতম ইন্দ্রিয় দিলাম। তাতেও কি
ঘণ্টার বাস্তবতা পূর্ণরূপে প্রকাশ
পায়?”
শিষ্যের মুখে আর কথা সরে না, সে নীরব
সম্মতিতে আত্মসমর্পণ করে।
“পুত্র!”,
গুরু বলেন, “চিন্তাসহ
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতির প্রকাশ
যাতে তাকে আমরা বলি ‘ইহা’ (ইদম্)। ইন্দ্রিয়ের
নাগালের বাইরে যা, অবাঙ্মানসগোচর তার
নাম ‘তাহা’ (তদাঃ)। সমগ্র
বেদান্ত ‘ইহা’ আর ‘তাহা’ নিয়ে।”
এইবার গুরু ঈশ্বর-বিশ্বাসের বিষয়ে
শিষ্যকে নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। ঈশ্বরের
অস্তিত্বকে তুমি অস্বীকার
করতে পার না কারণ
তুমি তাঁকে নিজের সীমিত
ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবে
না। ঈশ্বর
‘তাহা’। নিজের বোধগম্যতার
সীমা বুঝতে পারলে মানুষের মনে একপ্রকারের
বৌদ্ধিক নম্রতা জন্মায়।
বিশ্বাস নম্রতার দ্বারা লব্ধ এই
জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত।
আমাদের সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ানুভূতি দিয়ে আমরা যা বুঝতে
পারি তা হ'ল
বাস্তবের এক সূক্ষ্ম ভগ্নাংশমাত্র। এই
‘তদাঃ’ তোমার কল্পনারও নাগালের বাইরে, কারণ কল্পনা তোমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অনুভূতিরই
মধ্যে মূলীভূত, তার বাইরে কিছু নয় ।
‘তদাঃ’এর বাস্তবতায় কল্পনা কীভাবে ব্যর্থ হয় তা
কল্পনা করতে গেলেও বুঝতে হবে যে, সমস্ত
সংজ্ঞা বা পরিভাষা ‘ইদম’এর রাজ্যের
অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ঈশ্বরের
সংজ্ঞা দেওয়া যায় না।
তাই এতে কোন আশ্চর্য নেই যে আমাদের ঋষিরা ঈশ্বর বা ব্রহ্মের বর্ণনায় সকলে একটি কথাই
বলেছেন- নেতি, নেতি (ন-ইতি, ইহা নয়)।
No comments:
Post a Comment