Wednesday, February 15, 2017

Bengali Story- ঘটোৎকোচ (অফিসের গল্প- ৫)

ঘটোৎকোচ ।।

'বানানটা ভুল লিখলাম, তাই না? উপায় নেই, ইনি তো ভীমপুত্র ঘটোৎকচ নন। সুজন ঘটককে অনায়াসে দুর্জন বলে গালাগাল দেওয়া যেতে পারত, তাহলে এই ঘটোৎকোচ নামটা কেন? তাও যখন কিনা তাঁর ঘটে বা মাথায় কচ, মানে চুল যথেষ্টই আছে!'
আমাদের তেল কোম্পানীর ক্যান্টিনে আড্ডা হচ্ছিল সহকর্মীদের মধ্যে। আড্ডার মধ্যমণি হলেন সিন্‌হাদা। এই সিন্‌হাদার জন্ম বিদেশে, মানে দিনাজপুরে। সেখান থেকে সত্তরে ম্যাট্রিক পাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইংলিশবাজারে চলে আসেন ও পরে উত্তরবঙ্গ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। এই দুই দেশের অভিজ্ঞতার জোরে তাঁর গল্পের ঝুলি পূর্ণ, তাই সময় আর সুযোগ পেলেই ঝুলি উপুড় করে হামেশাই কিছু দিয়ে থাকেন। সেদিন কথা হচ্ছিল সরকারি কাজে ঘুষ আর দুর্নীতি নিয়ে। এই জিনিষটাকে যে শিল্পের উৎকর্ষে পৌঁছে দেওয়া যায় তারই প্রসঙ্গে সুজন ঘটক ওরফে ঘটোৎকোচের নাম উঠে এল।
'সেই ঘুষখোর কেরানিবাবুর গল্পটা শুনেছ? লোকটা উপরি না নিয়ে কোন কাজই করত না, মানে করতে পারতই না। কর্তৃপক্ষ থেকে কতবার তাঁর মাইনে আটকে দেয়া হয়েছে, তাও তিনি নিয়মিত অফিস গেছেন, আর বছর শেষে একখানা মোটরগাড়ি কিনে ফেলেছেন। তখন সাহেবি আমল, ইংরেজ উপরওয়ালা শেষে বিরক্ত হয়ে তাঁকে সমুদ্রতীরের এক জনশূন্য গ্রামে, যেখানে শুধু কিছু মৎস্যজীবি আছে, বদলি করে দিলেন, তাঁকে কাজ দেওয়া হল উদয়াস্ত শুধু সমুদ্রের ঢেউ গোনার। ভাবলেন বুঝি খুব শাস্তি দেওয়া হল।'
'ঠিক এক বছর পরে বড়সাহেব গেছেন কেরানিবাবুর খোঁজ নিতে। গিয়ে দেখেন, সমুদ্রতীরে ধু ধু বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে আছে এক চমৎকার দোতলা বাড়ি আর তার বাগানে ইজিচেয়ারে বসে তিনি দু'শ বার, দু'শ তের করে ঢেউ গুনে যাচ্ছেন। সাহেব তো থ। স্থানীয় মহলে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি তাঁর কাজের পরোয়ানা দেখিয়ে মাছধরার নৌকোগুলোকে নোটিস দিয়েছেন যে তাদের জন্যে তাঁর ঢেউ গোনার কাজের ব্যাঘাত ঘটছে, অতএব সবরকম নৌকোচলাচল সেখানে নিষিদ্ধ করা হল। শেষে গরীব জেলেদের সাথে নৌকাপ্রতি প্রতিক্ষেপে পাঁচটাকা করে রফা হল। বড়সাহেব বুঝলেন যে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও সে ধানই ভানবে।'
'আমাদের ঘটকমশাইও ছিলেন তেমনি এক গুণী ব্যক্তি। পেশায় ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার বলে আমাদের পণ্ডিচেরি অফিসে ওকে দেওয়া হয়েছিল ড্রিল-সাইটের এয়ার-কন্ডিশনারগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। কিন্তু দায়িত্ব নেবার পরেই সব এসি-গুলো একধার থেকে বিগড়ানো শুরু করল, আর প্রায় প্রতিটার কম্প্রেশার বদলানো হতে লাগল। সেখান থেকে সরিয়ে কলোনীর টাউন মেন্টেনান্সে পোস্টিং দিতেই রাস্তার নিয়নলাইটগুলো ঘনঘন খারাপ হলে লাগল। প্রজেক্ট ম্যানেজার আর কি করেন? অগত্যা ড্রিলসাইটের ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন বিভাগে তাকে পাঠানো হল। কাজ হচ্ছে সিস্মিক অনুসন্ধান পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে মাটির নীচে যেখানে তেল থাকতে পারে, সেই জমি সরকারি পয়সায় ইজারা নেওয়ার কাজ। ইলেকট্রিকের সঙ্গে কোনও সম্বন্ধ নেই, তাছাড়া এখানে পার্টিকে টাকা দিতে হবে, খাওয়ার প্রশ্নই নেই।'
'পরের বছর ঘটক একদিন বিশাল এক অডি গাড়ি নিয়ে অফিস এল। প্রজেক্ট ম্যানেজারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেই সন্ধ্যায় তাঁকে একটা বারে পানাহারের নিমন্ত্রণ জানাল। দেখে ত সবাই হাঁ।'
আমরাও এতক্ষণ হাঁ হয়ে শুনছিলাম। কাপের চা কখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। 'কিন্তু দাদা, আমরা কিছুই ত বুঝলাম না, গ্রামের জমির মালিকেরা শুদুমুদু তাঁকে জমির টাকার ভাগ দিতে যাবে কেন?' আমি শুধোলাম।
'তোমাদের দোষ নেই, ফীল্ডে গিয়ে তদন্ত না করলে আমিও বুঝতাম না। যে জমি লিজ নেওয়া হবে তার মালিককে সুজন আগেভাগে গিয়ে বুদ্ধি দিয়ে আসত শ'দুই নারকেল গাছের চারা লাগাতে সেই জমিতে। চারাপ্রতি পঞ্চাশ টাকা করে সে নিজে অগ্রিম দিয়ে আসত। এরপর জমির ইন্সপেকশনের সময় চাষের জমি দেখিয়ে প্রতি গাছের জন্যে পাঁচশো টাকা দাবি করার কথাও সে শিখিয়ে দিত, ফিফটি-ফিফটির কড়ারে।'
- দাদা, বানান ভুলের কথা কি যেন বলছিলেন, ভীমের ছেলের সাথে সুজন ঘটকের কি সম্পর্ক?
না হে, তোমাদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। যে কোম্পানিতে সুজন ঘটকের মত মহাপুরুষ আছে সেই একই কোম্পানিতে তোমরাও কাজ কর ভাবতেও লজ্জা লাগছে। ঘটোৎকোচের সন্ধিবিচ্ছেদ হল ঘটা + উৎকোচ, অর্থাৎ ঘটা করে যে উৎকোচ গ্রহণ করে, বহুব্রীহি সমাস। এবার কি উৎকোচ মানেটাও বলে দিতে হবে!

No comments:

Post a Comment