Friday, February 24, 2017

গল্প- "মেয়ে-ছেলে"

মেয়ে-ছেলে।


এপ্রিলে স্কুলের নতুন সেশন শুরু হল। ফোর্থ স্ট্যান্ডার্ডের ক্লাসে সেকশান বি তে ঢুকেই ক্লাস টিচার মিস তপাদারের চক্ষুস্থির। কো-এড স্কুল হলেও এখানে ছেলে আর মেয়েদের আলাদা সেকশন, কখনও তার অন্যথা হয় না। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের একটু গোঁড়ামি রয়ে গেছে আজকের দিনেও। কিন্তু ফার্স্ট বেঞ্চের বাঁ-দিকে যে দুজন বসে আছে তারা কি ধরণের মেয়ে? স্কুল ইউনিফর্মই পরেছে, তবে প্যান্ট-শার্ট। 'এ কি, তোমরা এখানে কেন? এ-সেকশানে যাও।' তিনি ভাবলেন, ভুল করে এসে পড়েছে, সেশনের গোড়ার দিকে এরকম হয়েই থাকে। 'সেকশন-এ খুঁজে পাবে কি, নয় আমি পৌঁছে দিচ্ছি, চল।'

'মিস্‌, আমার নাম বি-সেকশানে আছে, এই দেখুন।' ভাইস প্রিনসিপালের সই করা কাগজ দেখাল একজন । 'হুঁ, ফাল্গুনী রায়। মেয়েদের নাম রেখেছে মা-বাবা, ভিপি আর কি করবেন!'
'মিস্‌, অর্জুনের নাম ছিল ফাল্গুনী।' ছেলেটি ব্যাখ্যা করে। নিজের অজ্ঞতায় লজ্জা পেলেও মুখে সেটা প্রকাশ করেন না মিস্‌ তপাদার। উলটে অন্য ছেলেটিকে নাম জিগ্যেস করেন।'সবিতা, মিস্‌, সবিতা সিন্‌হা। সূর্যের এক নাম সবিতা'- অন্যজন জ্ঞান জাহির করে।
'ঠিক আছে, ঠিক আছে', পরিস্থিতিটা সামাল দেবার চেষ্টা করেন শিক্ষিকা। 

রোল কল করার পর কিছুক্ষণ গল্পগাছা চলল এই নিয়ে। ঠিকই ধরেছেন তিনি। খালি সীটগুলো ভরার জন্যে প্রতিবছর একটা ইন্টারভ্যু হয়, বেশ কিছু আবেদন পড়ে। সবিতা আর ফাল্গুনী সেলেক্ট হবার পর ভিপি ওদের নাম দেখে মেয়ে ভেবে পাঠিয়ে দেন বি-সেকশানে, আর সেখান থেকেই গোলযোগের শুরু। যাক গে, পরে প্রিন্সিপালকে বলে শুধরে নেওয়া যাবে, মিস তপাদার পড়ানো শুরু করলেন।

রিসেসে প্রিন্সিপালকে কথাটা জানাতেই তিনি ত হাঁ। ভাইস প্রিন্সিপাল মিসেস পানওয়ালাকে ডেকে পাঠালেন। ইনি আবার পার্শি সম্প্রদায়ের মানুষ, তবে বাঙলা লেখাপড়া ভালই জানেন। কিন্ত হিন্দু পুরাণের ইনি আর কতটুকু জানবেন, হিন্দুরাই অত খবর রাখেনা যেখানে। তিনি বুঝলেন, একটা বড় ভুল হয়ে গেছে, কিন্তু ছেলেদের সেকশান ত ফুল- অতিরিক্ত ছাত্র নিতে ম্যানেজমেন্টই আপত্তি করবে। তাছাড়া ব্যাপারটা নিয়ে জল ঘোলা হলে সবারই বদনাম। অগত্যা প্রিন্সিপাল বললেন, 'মিস্‌ তপাদার, যতদিন না মেয়েরা বা তাদের গার্জেনরা অভিযোগ করছে, ততদিন এরকম চলতে দিন। সেকশন-এ তে সীট খালি হোক, তখন দেখা যাবে।

যাদেরকে নিয়ে এত কাণ্ড, এদিকে তারা কিন্তু গোকূলে বেড়েই চলেছে। মেয়েরা কয়েকদিনের মধ্যেই আবিষ্কার করল যে সবিতার মাথা অঙ্কে খুব পরিষ্কার, আর ফাল্গুনী খুব মজার ছেলে- জোক আর মজার গল্পের ভাণ্ডারী। মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই মাথায় অঙ্কের কচকচি ঢুকত না, সবিতা ধৈর্যধরে তাদের সব বুঝিয়ে দেয়। টিচারও অবাক, গাধা মেয়েগুলোও প্রতিটা হোমটাস্ক করে আনছে কি করে আজকাল। আর টিফিনের সময়টা অল-ফাল্গুনী'স টাইম। সেদিন ও সুকুমার রায়ের 'অসি-লক্ষণ পণ্ডিত' গল্পটা বলছে, গলা নাকি করে 'তঁলোয়াঁরটাঁ কেঁমন ছিঁঁল' বলতেই মেয়েরা সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে। দেখা গেছে টিচাররাও কদিন দরজার বাইরে থেকে আড়ি পেতে পাগলা দাশুর গল্প শুনছে।

এভাবেই একটা বছর কেটে গেল। পরের বছর চেষ্টা-চরিত্র করে ছেলেদের সেকশানে দুটো সীট খালি রাখা হল। ঠিক হল, ফাল্গুনী-সবিতা এবার থেকে সেকশান-এ তে বসবে। সব ঠিক ছিল, বাদ সাধল ক্লাসের মেয়েরা। সবাই তখন ওদের ফ্যান। দু-চারজনের আবার বাড়ি থেকেও রিকোয়েস্ট এল। এবার অবাক হওয়ার পালা প্রিন্সিপালের। তাঁর দীর্ঘ শিক্ষিকা-জীবনে অনেক রকম সমস্যার সমাধান করেছেন তিনি, কিন্তু এ যে একেবারে নতুন ধরণের। তড়িঘড়ি বোর্ডের মিটিং কল করলেন তিনি।

আজ স্কুলে একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবার থেকে আর ছেলে-মেয়ের আলাদা বিভাগ থাকবে না। অর্ধেক সংখ্যক মেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়া হল সেকশন-এ তে, সেখান থেকে ছেলেদের আনা হল বি-তে। কি আশ্চর্য, অভিভাবকরাও কেউ আপত্তি করলেন না। আর এ সব সম্ভব হল দুটি ছেলের জন্যে, যাদেরকে সবাই মেয়ে ভেবেছিল!

No comments:

Post a Comment