যাচ্ছেতাই।।
(৩)
আমি, সুজয় আর কানু তিনজনে একত্রে আড্ডায় বসলেই কিভাবে জানি না কিছুক্ষণের মধ্যেই আড্ডা অবধারিতভাবে বিশুমামার প্রসঙ্গে মোড় নিত। সেদিন এমনি বসে আছি যাদবের চা-এর দোকানে, কানুর হাতে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও। খবর পেয়েছি একটা বাস দুর্ঘটনায় বিশুমামা গুরুতর আহত হয়েছেন। 'খবরটা কি এইমাত্র রেডিওতে জানান হল- ওটা নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছিস যে!'- সুজয়ের প্রশ্নে কানু গোমড়া-মুখেই হেসে ফেলল।
-না রে, অত ফেমাসও নয় আমাদের বিশুমামা। তবে বছর দশেক আগে এই রেডিওতেই ওর সাথে আমাদের ভালভাবে পরিচয় হবার কথা ছিল।
- গল্পটা কি রে সলিল, সুজয় জিগ্যেস করল। ও পরে এসেছে পাড়ায়, বিশুমামার গোড়ার দিকের গল্পগুলো তেমন জানে না।
- কি আর, বিশুমামা তখন বিশ্বভারতী সংগীতভবনে শেখে। একদিন একটা পোস্টকার্ড এল মায়ের কাছে-'দিদি, অমুক তারিখে সন্ধ্যে আটটায় আমাদের একটা প্রোগ্রাম দেবে কলকাতা-ক থেকে, শান্তিদেবের পরিচালনায়। গানের দলে আমিও আছি, পারলে শুনিস। তারপর নির্দিষ্ট দিনে আমরা রেডিও খুলে বসে আছি, কোনও অনুষ্ঠানই নেই। গুলবাজ বলে তখন ইতিমধ্যেই একটু খ্যাতি ছড়িয়েছে বিশুমামার, সেটাই কায়েম হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। তখন রেডিও সবার বাড়িতে থাকত না, অনেকেই ভীড় করেছেন আমাদের বাসায়। সবাই মিলে মামার পিণ্ডি চটকানো হচ্ছে, এমন সময় সুশীলকাকুর প্রবেশ। ঢুকেই বলেন, 'উঃ, কি গলা হয়েছে রে আমাদের বিশুর, শান্তিদেবকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে, এমন হেঁড়ে। তবে অনুষ্ঠান কিন্তু জমেছিল।' এদিকে আমরা সবাই অবাক। জিগ্যেস করলাম 'কাকু, আমরা তো তাই শুনতেই বসে আছি, কই হল, কখন?' জানা গেল ওটা সকাল আটটায় হয়ে গেছে। তখন রেডিওতে সব প্রোগ্রাম লাইভ হত, আর রিপিট হওয়ার ত প্রশ্নই ছিল না।
সত্যই তখন বিশুমামা বাড়িতে এলে উৎসব লেগে যেত। রবিবার হলে বাবা চলে যেতেন মাংস আনতে। দাদু বারান্দায় বসে আছেন, বিশুমামা তাঁকে গিয়ে প্রণাম করত। সেখানে মামার আবার অন্য রূপ। আমার দাদু ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, কিন্তু খুবই কম কথা বলতেন। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম বিশুমামা এলে দাদুও কেমন উচ্ছল, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন। নানারকমের প্রশ্ন করতেন মামা।
- মেসোমশাই, টপ্পা নিয়ে একদিন আমাদের খুব তর্ক হচ্ছিল। টপ্পা নামটা কিভাবে এল একটু বোঝাবেন?
- ঘোড়া যখন ছোটে, তার পায়ের 'টপ-টপ' শব্দ অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর বা তার উল্টোটা যেমন হয়, মূলতঃ পাঞ্জাবের এই গায়ন-রীতিতে গমক ও বিস্তারগুলো তালের সাথে সংগতি রেখে সেভাবেই ছুটে চলে বলে একে টপ্পা বলে ।
- তাহলে টপ্পায় তাল থাকে? কিন্তু টপ্পা-অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত তো কেউ তালে গান না!
- টপ্পার তাল বেশিরভাগই মধ্যমান বা আড়াঠেকা হয়। কেন, দিনু ঠাকুর, শান্তিদেব, রাজেশ্বরী, কানা কেষ্ট- এঁরা তো তালেই টপ্পা গাইতেন। তবে রবি ঠাকুর শেষ বয়েসে টপ্পা-জাতীয় গান বিনা তবলাসংগতে গাইতে স্বচ্ছন্দ-বোধ করতেন, সেই থেকেই বোধহয় রীতিটা চালু হল। তাছাড়া টপ্পা ও টপ-খেয়াল তালে গাওয়া খুব কঠিনও বটে।
- টপ্পা পঞ্জাবী গান বলছেন, তাকে বাংলায় আমদানী করলেন কি রবীন্দ্রনাথ?
- তোমার কাছে এ প্রশ্ন আশা করিনি বিশু। নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তই প্রথম বাংলায় টপ্পা লেখেন ১৭৮০ সাল নাগাদ। তাঁর বানীই ছিল-'নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা?'
বলা বাহুল্য, এ সংলাপের অধিকাংশই তখনও বুঝবার বয়স আমার হয়নি। তাই যতশীগ্গির সম্ভব মামাকে দাদুর কবল থেকে ছাড়িয়ে আমরা দখল করে বসাতাম। শুরু হত গান নিয়ে গান গান খেলা। 'ওরে ওরে আমার মন মেতেছে', 'ভালমানুষ নইরে মোরা', 'বেড়াল কয় মাছ খাবো না', 'আমার হরিনামে রুচি- কারণ পরিনামে লুচি' - মামার এসব গানের সাথে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম।
- কি হল, কোথায় হারিয়ে গেলি আবার? কি হয়েছে বিশুমামার, খুলে বলবি? বেঁচে আছে তো?
- মামার একটা দোষ আছে, যাকে তাকে যা তা কথা দিয়ে বসার। এক ছাত্রীর আকাশবাণীতে অডিশান ছিল। ছাত্রীর বাবাকে জব্বর এক আশ্বাস দিয়ে বসেছে বিশুমামা- 'আরে ভাববেন না, দ্বিজেনদাকে বলা আছে, অডিশানের দিনে সন্তোষ সেনগুপ্তকে একটা চিঠি দিয়ে দেব, সব ঠিক হয়ে যাবে।' গতকাল মেয়েটার বাবা চিঠি আনতে রানীগঞ্জ থেকে দুর্গাপুর আসছেন আর মামা তাঁকে দেখতে পেয়েই অন্য একটা চলন্ত বাসে উঠে পালাতে গেছে।
- তারপর?
- তারপর সে এক কাণ্ড, স্লিপ করে পড়ে বাসের পেছনের চাকায় কোমরে ধাক্কা লেগে সাংঘাতিক অবস্থা। আজ সকালে দুর্গাপুর স্টীলের হাসপাতালে একটা অপারেশন হওয়ার কথা।
মামা পরে বেঁচে ওঠেন ঠিকই, তবে প্যানক্রিয়াসে আর ইউরেথ্রাতে একটা স্থায়ী বিকৃতি থেকে যায়। হারিয়ে যায় বিশুমামার সেই নায়কোচিত চেহারা আর গুল দেওয়ার সেই স্বতঃস্ফুর্ত ক্ষমতা।
(৩)
আমি, সুজয় আর কানু তিনজনে একত্রে আড্ডায় বসলেই কিভাবে জানি না কিছুক্ষণের মধ্যেই আড্ডা অবধারিতভাবে বিশুমামার প্রসঙ্গে মোড় নিত। সেদিন এমনি বসে আছি যাদবের চা-এর দোকানে, কানুর হাতে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও। খবর পেয়েছি একটা বাস দুর্ঘটনায় বিশুমামা গুরুতর আহত হয়েছেন। 'খবরটা কি এইমাত্র রেডিওতে জানান হল- ওটা নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছিস যে!'- সুজয়ের প্রশ্নে কানু গোমড়া-মুখেই হেসে ফেলল।
-না রে, অত ফেমাসও নয় আমাদের বিশুমামা। তবে বছর দশেক আগে এই রেডিওতেই ওর সাথে আমাদের ভালভাবে পরিচয় হবার কথা ছিল।
- গল্পটা কি রে সলিল, সুজয় জিগ্যেস করল। ও পরে এসেছে পাড়ায়, বিশুমামার গোড়ার দিকের গল্পগুলো তেমন জানে না।
- কি আর, বিশুমামা তখন বিশ্বভারতী সংগীতভবনে শেখে। একদিন একটা পোস্টকার্ড এল মায়ের কাছে-'দিদি, অমুক তারিখে সন্ধ্যে আটটায় আমাদের একটা প্রোগ্রাম দেবে কলকাতা-ক থেকে, শান্তিদেবের পরিচালনায়। গানের দলে আমিও আছি, পারলে শুনিস। তারপর নির্দিষ্ট দিনে আমরা রেডিও খুলে বসে আছি, কোনও অনুষ্ঠানই নেই। গুলবাজ বলে তখন ইতিমধ্যেই একটু খ্যাতি ছড়িয়েছে বিশুমামার, সেটাই কায়েম হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। তখন রেডিও সবার বাড়িতে থাকত না, অনেকেই ভীড় করেছেন আমাদের বাসায়। সবাই মিলে মামার পিণ্ডি চটকানো হচ্ছে, এমন সময় সুশীলকাকুর প্রবেশ। ঢুকেই বলেন, 'উঃ, কি গলা হয়েছে রে আমাদের বিশুর, শান্তিদেবকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে, এমন হেঁড়ে। তবে অনুষ্ঠান কিন্তু জমেছিল।' এদিকে আমরা সবাই অবাক। জিগ্যেস করলাম 'কাকু, আমরা তো তাই শুনতেই বসে আছি, কই হল, কখন?' জানা গেল ওটা সকাল আটটায় হয়ে গেছে। তখন রেডিওতে সব প্রোগ্রাম লাইভ হত, আর রিপিট হওয়ার ত প্রশ্নই ছিল না।
সত্যই তখন বিশুমামা বাড়িতে এলে উৎসব লেগে যেত। রবিবার হলে বাবা চলে যেতেন মাংস আনতে। দাদু বারান্দায় বসে আছেন, বিশুমামা তাঁকে গিয়ে প্রণাম করত। সেখানে মামার আবার অন্য রূপ। আমার দাদু ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, কিন্তু খুবই কম কথা বলতেন। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম বিশুমামা এলে দাদুও কেমন উচ্ছল, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন। নানারকমের প্রশ্ন করতেন মামা।
- মেসোমশাই, টপ্পা নিয়ে একদিন আমাদের খুব তর্ক হচ্ছিল। টপ্পা নামটা কিভাবে এল একটু বোঝাবেন?
- ঘোড়া যখন ছোটে, তার পায়ের 'টপ-টপ' শব্দ অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর বা তার উল্টোটা যেমন হয়, মূলতঃ পাঞ্জাবের এই গায়ন-রীতিতে গমক ও বিস্তারগুলো তালের সাথে সংগতি রেখে সেভাবেই ছুটে চলে বলে একে টপ্পা বলে ।
- তাহলে টপ্পায় তাল থাকে? কিন্তু টপ্পা-অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত তো কেউ তালে গান না!
- টপ্পার তাল বেশিরভাগই মধ্যমান বা আড়াঠেকা হয়। কেন, দিনু ঠাকুর, শান্তিদেব, রাজেশ্বরী, কানা কেষ্ট- এঁরা তো তালেই টপ্পা গাইতেন। তবে রবি ঠাকুর শেষ বয়েসে টপ্পা-জাতীয় গান বিনা তবলাসংগতে গাইতে স্বচ্ছন্দ-বোধ করতেন, সেই থেকেই বোধহয় রীতিটা চালু হল। তাছাড়া টপ্পা ও টপ-খেয়াল তালে গাওয়া খুব কঠিনও বটে।
- টপ্পা পঞ্জাবী গান বলছেন, তাকে বাংলায় আমদানী করলেন কি রবীন্দ্রনাথ?
- তোমার কাছে এ প্রশ্ন আশা করিনি বিশু। নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তই প্রথম বাংলায় টপ্পা লেখেন ১৭৮০ সাল নাগাদ। তাঁর বানীই ছিল-'নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা?'
বলা বাহুল্য, এ সংলাপের অধিকাংশই তখনও বুঝবার বয়স আমার হয়নি। তাই যতশীগ্গির সম্ভব মামাকে দাদুর কবল থেকে ছাড়িয়ে আমরা দখল করে বসাতাম। শুরু হত গান নিয়ে গান গান খেলা। 'ওরে ওরে আমার মন মেতেছে', 'ভালমানুষ নইরে মোরা', 'বেড়াল কয় মাছ খাবো না', 'আমার হরিনামে রুচি- কারণ পরিনামে লুচি' - মামার এসব গানের সাথে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম।
- কি হল, কোথায় হারিয়ে গেলি আবার? কি হয়েছে বিশুমামার, খুলে বলবি? বেঁচে আছে তো?
- মামার একটা দোষ আছে, যাকে তাকে যা তা কথা দিয়ে বসার। এক ছাত্রীর আকাশবাণীতে অডিশান ছিল। ছাত্রীর বাবাকে জব্বর এক আশ্বাস দিয়ে বসেছে বিশুমামা- 'আরে ভাববেন না, দ্বিজেনদাকে বলা আছে, অডিশানের দিনে সন্তোষ সেনগুপ্তকে একটা চিঠি দিয়ে দেব, সব ঠিক হয়ে যাবে।' গতকাল মেয়েটার বাবা চিঠি আনতে রানীগঞ্জ থেকে দুর্গাপুর আসছেন আর মামা তাঁকে দেখতে পেয়েই অন্য একটা চলন্ত বাসে উঠে পালাতে গেছে।
- তারপর?
- তারপর সে এক কাণ্ড, স্লিপ করে পড়ে বাসের পেছনের চাকায় কোমরে ধাক্কা লেগে সাংঘাতিক অবস্থা। আজ সকালে দুর্গাপুর স্টীলের হাসপাতালে একটা অপারেশন হওয়ার কথা।
মামা পরে বেঁচে ওঠেন ঠিকই, তবে প্যানক্রিয়াসে আর ইউরেথ্রাতে একটা স্থায়ী বিকৃতি থেকে যায়। হারিয়ে যায় বিশুমামার সেই নায়কোচিত চেহারা আর গুল দেওয়ার সেই স্বতঃস্ফুর্ত ক্ষমতা।