Monday, December 28, 2015

Jachchhetai-3

যাচ্ছেতাই।।
(৩)

আমি, সুজয় আর কানু তিনজনে একত্রে আড্ডায় বসলেই কিভাবে জানি না কিছুক্ষণের মধ্যেই আড্ডা অবধারিতভাবে বিশুমামার প্রসঙ্গে মোড় নিত। সেদিন এমনি বসে আছি যাদবের চা-এর দোকানে, কানুর হাতে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও। খবর পেয়েছি একটা বাস দুর্ঘটনায় বিশুমামা গুরুতর আহত হয়েছেন। 'খবরটা কি এইমাত্র রেডিওতে জানান হল- ওটা নিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে আছিস যে!'- সুজয়ের প্রশ্নে কানু গোমড়া-মুখেই হেসে ফেলল।
-না রে, অত ফেমাসও নয় আমাদের বিশুমামা। তবে বছর দশেক আগে এই রেডিওতেই ওর সাথে আমাদের ভালভাবে পরিচয় হবার কথা ছিল।
- গল্পটা কি রে সলিল, সুজয় জিগ্যেস করল। ও পরে এসেছে পাড়ায়, বিশুমামার গোড়ার দিকের গল্পগুলো তেমন জানে না।
- কি আর, বিশুমামা তখন বিশ্বভারতী সংগীতভবনে শেখে। একদিন একটা পোস্টকার্ড এল মায়ের কাছে-'দিদি, অমুক তারিখে সন্ধ্যে আটটায় আমাদের একটা প্রোগ্রাম দেবে কলকাতা-ক থেকে, শান্তিদেবের পরিচালনায়। গানের দলে আমিও আছি, পারলে শুনিস। তারপর নির্দিষ্ট দিনে আমরা রেডিও খুলে বসে আছি, কোনও অনুষ্ঠানই নেই। গুলবাজ বলে তখন ইতিমধ্যেই একটু খ্যাতি ছড়িয়েছে বিশুমামার, সেটাই কায়েম হয়ে গেল বলে মনে হচ্ছে। তখন রেডিও সবার বাড়িতে থাকত না, অনেকেই ভীড় করেছেন আমাদের বাসায়। সবাই মিলে মামার পিণ্ডি চটকানো হচ্ছে, এমন সময় সুশীলকাকুর প্রবেশ। ঢুকেই বলেন, 'উঃ, কি গলা হয়েছে রে আমাদের বিশুর, শান্তিদেবকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে, এমন হেঁড়ে। তবে অনুষ্ঠান কিন্তু জমেছিল।' এদিকে আমরা সবাই অবাক। জিগ্যেস করলাম 'কাকু, আমরা তো তাই শুনতেই বসে আছি, কই হল, কখন?' জানা গেল ওটা সকাল আটটায় হয়ে গেছে। তখন রেডিওতে সব প্রোগ্রাম লাইভ হত, আর রিপিট হওয়ার ত প্রশ্নই ছিল না।

সত্যই তখন বিশুমামা বাড়িতে এলে উৎসব লেগে যেত। রবিবার হলে বাবা চলে যেতেন মাংস আনতে। দাদু বারান্দায় বসে আছেন, বিশুমামা তাঁকে গিয়ে প্রণাম করত। সেখানে মামার আবার অন্য রূপ। আমার দাদু ছিলেন সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, কিন্তু খুবই কম কথা বলতেন। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম বিশুমামা এলে দাদুও কেমন উচ্ছল, প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন। নানারকমের প্রশ্ন করতেন মামা।
- মেসোমশাই, টপ্পা নিয়ে একদিন আমাদের খুব তর্ক হচ্ছিল। টপ্পা নামটা কিভাবে এল একটু বোঝাবেন?
- ঘোড়া যখন ছোটে, তার পায়ের 'টপ-টপ' শব্দ অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর বা তার উল্টোটা যেমন হয়, মূলতঃ পাঞ্জাবের এই গায়ন-রীতিতে গমক ও বিস্তারগুলো তালের সাথে সংগতি রেখে সেভাবেই ছুটে চলে বলে একে টপ্পা বলে ।
- তাহলে টপ্পায় তাল থাকে? কিন্তু টপ্পা-অঙ্গের রবীন্দ্রসংগীত তো কেউ তালে গান না!
- টপ্পার তাল বেশিরভাগই মধ্যমান বা আড়াঠেকা হয়। কেন, দিনু ঠাকুর, শান্তিদেব, রাজেশ্বরী, কানা কেষ্ট- এঁরা তো তালেই টপ্পা গাইতেন। তবে রবি ঠাকুর শেষ বয়েসে টপ্পা-জাতীয় গান বিনা তবলাসংগতে গাইতে স্বচ্ছন্দ-বোধ করতেন, সেই থেকেই বোধহয় রীতিটা চালু হল। তাছাড়া টপ্পা ও টপ-খেয়াল তালে গাওয়া খুব কঠিনও বটে।
- টপ্পা পঞ্জাবী গান বলছেন, তাকে বাংলায় আমদানী করলেন কি রবীন্দ্রনাথ?
- তোমার কাছে এ প্রশ্ন আশা করিনি বিশু। নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তই প্রথম বাংলায় টপ্পা লেখেন ১৭৮০ সাল নাগাদ। তাঁর বানীই ছিল-'নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা?'

বলা বাহুল্য, এ সংলাপের অধিকাংশই তখনও বুঝবার বয়স আমার হয়নি। তাই যতশীগ্‌গির সম্ভব মামাকে দাদুর কবল থেকে ছাড়িয়ে আমরা দখল করে বসাতাম। শুরু হত গান নিয়ে গান গান খেলা। 'ওরে ওরে আমার মন মেতেছে', 'ভালমানুষ নইরে মোরা', 'বেড়াল কয় মাছ খাবো না', 'আমার হরিনামে রুচি- কারণ পরিনামে লুচি' - মামার এসব গানের সাথে আমরা হেসে গড়িয়ে পড়তাম।

- কি হল, কোথায় হারিয়ে গেলি আবার? কি হয়েছে বিশুমামার, খুলে বলবি? বেঁচে আছে তো?
- মামার একটা দোষ আছে, যাকে তাকে যা তা কথা দিয়ে বসার। এক ছাত্রীর আকাশবাণীতে অডিশান ছিল। ছাত্রীর বাবাকে জব্বর এক আশ্বাস দিয়ে বসেছে বিশুমামা- 'আরে ভাববেন না, দ্বিজেনদাকে বলা আছে, অডিশানের দিনে সন্তোষ সেনগুপ্তকে একটা চিঠি দিয়ে দেব, সব ঠিক হয়ে যাবে।' গতকাল মেয়েটার বাবা চিঠি আনতে রানীগঞ্জ থেকে দুর্গাপুর আসছেন আর মামা তাঁকে দেখতে পেয়েই অন্য একটা চলন্ত বাসে উঠে পালাতে গেছে।
- তারপর?
- তারপর সে এক কাণ্ড, স্লিপ করে পড়ে বাসের পেছনের চাকায় কোমরে ধাক্কা লেগে সাংঘাতিক অবস্থা। আজ সকালে দুর্গাপুর স্টীলের হাসপাতালে একটা অপারেশন হওয়ার কথা।

মামা পরে বেঁচে ওঠেন ঠিকই, তবে প্যানক্রিয়াসে আর ইউরেথ্রাতে একটা স্থায়ী বিকৃতি থেকে যায়। হারিয়ে যায় বিশুমামার সেই নায়কোচিত চেহারা আর গুল দেওয়ার সেই স্বতঃস্ফুর্ত ক্ষমতা।

Saturday, December 5, 2015

বাংলা ছোটগল্প- হা ঈশ্বর

হা ঈশ্বর ।।
(সব চরিত্র কাল্পনিক)



-‘বাবা, দেখেছ আজকের নবজীবন টাইমসে ডাঃ গোডবোলের লেখাটা? লিখেছেন, ‘হে ঈশ্বর, আমার অপরাধ নিয়ো না। যদি তুমি থেকেই থাক কোথাও, আমার এ বিদ্যে-বুদ্ধি, জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা সব তোমারই দান। সেই বিদ্যে-বুদ্ধি দিয়ে আমি তোমার অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে পারছি না, সে অক্ষমতার দায় কিন্তু তোমার।‘ একেবারে নতুন ধরণের কথা, তাই না?’

সদ্য জার্নালিজমে দীক্ষিত মেয়ের সঙ্গে ভাল তর্ক করতে পারেন না বরোদার অবধেশ মন্দিরের পুরোহিত প্রধান কৈলাশপতি ত্রিবেদী। তাই তিনি সোজা কথা বলে দিলেন- ‘পিপীলিকা পক্ষ ধরে মরিবার তরে। এই ঔদ্ধত্যের শাস্তি ঈশ্বরই তাকে দেবেন।‘
-‘বাবা, কথাটা কিন্তু ওরিজিনালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তাঁর ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসের নাস্তিক নায়কের উক্তি। তবে একটা কথা, ডাঃ গোডবোলে কিন্তু নাস্তিক নন। তিনি ঈশ্বর মানেন। কিন্তু মানেন না দেবতা, স্বর্গ-নরক, পুনর্জন্ম, পাপ-পুণ্য বা এ বিষয়ে বেদ-উপনিষদে যা বলা হয়েছে সে সব। তিনি কলকাতার বিখ্যাত দার্শনিক ডাঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের ছাত্র ছিলেন। তাই মনে করেন যে বেদ-বেদান্তে যে অসংখ্য দেবতার বর্ণনা আর যজ্ঞ-প্রণালীর বর্ণনা আছে তা মানুষের খাদ্য ও অন্যান্য জাগতিক সমস্যা বা সৃষ্টি রহস্যের একটা কাল্পনিক সমাধান।’
-‘দেখো মা, দর্শন-টর্শন আমিও একটু-আধটু পড়েছি। শঙ্করের অদ্বৈতবাদের আমি বিরোধী নই। তবে ঐ নাস্তিক বাঙ্গালিগুলোর সাথে থেকে একজন মারাঠা ব্রাহ্মণের মতিচ্ছন্ন হবে একথাও মেনে নেওয়া যায় না।‘
-‘কিন্তু বাবা, উনি প্রতিটি কথার যুক্তি দিয়ে...'
- ‘থামো’, এবার গর্জে উঠলেন কৈলাশপতি। ‘ওই বিধর্মীগুলোকে আমার জানতে বাকি নেই। জানো, টেগোর ব্রাহ্ম ছিলেন আর সুকুমারী খৃষ্টান? ওরা তো সনাতন ধর্মের কুৎসা করবেই। তাছাড়া বাঙালি জাতটার তো কোনকালেই বর্ণভেদ, খাদ্যাখাদ্য নিয়ে কোনও সংস্কার ছিল না। ওরা গোমাংস খায়, ওদের ব্রাহ্মণরা, বিধবারা পর্যন্ত আমিষ খায়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর আর ডিরোজিও সাহেব এদের মাথাটি খেয়েছেন। ওরা আবার সনাতন হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে কী কথা বলবে! আমি বলছি গোডবোলে শাস্তি পাবে, বিধাতার চরম শাস্তি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে।‘
বাবার মেজাজ দেখে আর কথা বাড়াল না শৈলজা। ভয়েই চুপ করে গেল।

ইদানীং কদিন ধরে মন্দিরের গুপ্তকক্ষে মাথায় লাল কাপড় বাঁধা কিছু উগ্র আর গোঁড়া হিন্দুভক্তের আসা-যাওয়া, বাবার সঙ্গে দিনের পর দিন তাদের পরামর্শ কিন্তু শৈলজার নজর এড়ায় না। ইতিমধ্যে গোডবোলে নবজীবন পত্রিকা ও মহারাষ্ট্র টাইমসে লিখে ফেলেছেন আরো গোটাতিনেক বলিষ্ঠ রচনা, সবই ধর্মের ধ্বজাধারী দালালদের উদ্দেশ্যে। তাতে বাদ যায়নি ভণ্ড সাধুদের কাণ্ডকারখানা, ধার্মিক সংগঠনগুলোর কালো টাকার পরিমাণ, গণেশ-মূর্তির দুগ্ধপান থেকে মাহিমে সমুদ্রের জলের মিষ্টতার রহস্য বা মক্কায় হজযাত্রীদের স্ট্যাম্পীডের ঘটনা- কোন কিছুই।

সাপের লেজে পা দিলে সাপ কি ছেড়ে কথা কয়? একদিন সকালে জগিং-এ বেরিয়েছিলেন ডাঃ গোডবোলে, ঘরে ফিরল তাঁর মৃতদেহ পুলিশের গাড়ি চড়ে। দুজন মোটোর-বাইক আরোহী পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে তাঁর কপালে।

সেদিন বিকেলে নবজীবনের সম্পাদকের ফোন এল শৈলজার কাছে। ‘মিস ত্রিবেদী, এই ঘটনাটার উপর একটা স্পেশ্যাল রিপোর্ট চাই। পরপর তিনজন রেশনালিস্ট খুন হলেন দেশের বিভিন্ন জায়গার, প্রকাশ্য দিবালোকে। ডাঃ দাভোলকার, ডাঃ কালবুর্গি, ডাঃ গোডবোলে তো বটেই, প্রয়োজনে বাংলাদেশের সম্প্রতি-নিহত ব্লগারদের আর শ্রীলঙ্কার যুক্তিবাদী ডাঃ কোভুরের কেসটাও তুলনায় নিয়ে এসো। পারলে কলকাতার যুক্তিবাদী প্রবীর ঘোষের সাথেও কথা বলে দেখো।‘ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে এডিটার ফোন রাখলেন।

উত্তেজিত শৈলজা নিজেও। অল্প দিনের সাংবাদিক জীবনে এরকম হাই-প্রফাইল কেস সে কখনও হ্যান্ডেল করেনি। সেই সন্ধ্যেতেই সে ছুটল সয়াজীবাগের ধার ঘেঁষে ডাঃ গোডবোলের বাসায়। তাকে অভ্যর্থনা জানালেন এক সৌম্য সুদর্শন যুবক, নাম জানা গেল মুকুন্দ গোডবোলে। তিনি নিজেই জানালেন যে তিনি মহারাজা সয়াজীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক স্বর্গত ডাঃ মধুসূদন গোডবোলের কনিষ্ঠ পুত্র, বছর তিন হল এম-এস-ইউ তে সংখ্যাতত্বের শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেয়েছেন।

-‘বাবার পরিচয় তো নিশ্চয় আপনার অজানা নয়’, সোজাসুজি মূল প্রশ্নে এসে পড়লেন মুকুন্দ, ‘আর তদন্ত যা করার সে তো পুলিশেই করবে। তাহলে আপনার ভূমিকাটা এখানে কিসের?’
-‘আপনার কথা ঠিক। আমার কাজ খুনের তদন্ত করা নয়, যদিও সেটা জানা বা লোককে জানানোটা আমাদের নৈতিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তবে আমাদের মেন কনসার্ন হল যেভাবে একের পর এক যুক্তিবাদী যিনি ধর্মান্ধতা বা অন্ধবিশ্বাস, তথাকথিত ধর্মগুরুদের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেওয়ার কাজে ব্রতী হয়েছেন তাঁদেরকে এক এক করে খুন করা হচ্ছে- এ আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? আমরা কি এখনও নিজেদেরকে সভ্য-পরিচয় দেওয়ার যোগ্য আছি, না প্রস্তর-যুগের অসভ্য-বর্বরতার দিকে ফিরে যাচ্ছি?’
-‘না মিস ত্রিবেদী, নিওলিথিক-চ্যাল্কোলিথিক মানুষদের অসভ্য-বর্বর বলার কোনও অধিকার আমাদের নেই। তারা হত্যা করত নিতান্তই জৈব প্রয়োজনে। তাদের ধর্ম বলে কিছু ছিল না, তাই ধর্মান্ধতার কোনও প্রশ্নই আসে না। জানেন, আমার বাবা টেগোর থেকে পড়ে শোনাতেন-
‘ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।.......
পূজাগৃহে তোলে রক্তমাখানো ধ্বজা-
দেবতার নামে এ যে শয়তান ভজা!‘ ‘

-‘তবু কারা আপনার বাবাকে মেরেছে বলে আপনার মনে হয়?’
- ‘তা বলতে পারব না, তবে দুজনেরই মাথায় লাল ফেট্টি আর কপালে সিঁদুরের টিপ ছিল।‘
চকিতে চমকে ওঠে শৈলজা। মনে পড়ে মন্দিরে কিছু সন্দেহজনক লোকের আনাগোনা। মুহূর্তে সবকিছু যেন পরিষ্কার হয়ে যায় চোখের সামনে। কোনমতে একগ্লাস জল চায় সে মুকুন্দের কাছে।
- ‘আমি স্ট্যাটিস্টিক্সের কিছুই বুঝিনা, প্রফেসার গোডবোলে, কিন্তু সামান্য পরিচয়ে আপনাকে যেটুকু দেখলাম তাতে মনে হল আপনি আপনার বাবার একজন যোগ্য উত্তরসূরী, গর্ব করতে পারেন তাঁকে নিয়ে। আমার কিন্তু সে সৌভাগ্য হল না‘- শৈলজা কথাটা বলেই ফেলল।
- ‘ তা কেন, আপনি একজন শিক্ষিতা মহিলা, সঙ্গত কারণেই আপনার যুক্তিবাদী হওয়ার, গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে ওঠার অধিকার আছে। আর এ ব্যাপারে আমি যদি বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারি, সে আমার সৌভাগ্য বলে মনে করব। আপনি প্লীজ এ ব্যাপারে কোনও দ্বিধা রাখবেন না।‘

বাড়িতে ফিরে ভারাক্রান্ত মনে শুয়ে পড়ল শৈলজা। পরদিন ঘুম ভাঙ্গল রোজকার মত বাবার গলায় সন্ত নরসি মেহেতার রচিত ভজন শুনে-
“বৈষ্ণব জন তো ত্যয়ন কহিয়ে জে
পীড় পরায়ে জানে রে -
পরদুখে উপকার করে তোয়ে
মন অভিমান না আন রে।।“

আজ কিন্তু বাবার গলায় এই গান তার কাছে ভণ্ডামির নামান্তর বলেই মনে হল। প্রবলপ্রতাপ পুরোহিত কৈলাশপতি ত্রিবেদী এখনও জানেন না যে দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের জন্ম হয়েছে তাঁরই অজ্ঞাতসারে, তাঁরই চোখের সামনে। আর ক'দিন পরে বুঝি বা তার জন্যেও কিছু শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ ঈশ্বরকে বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তো তাঁরই।

গল্প তবু গল্প নয়- 'মহাপ্রভু'


গল্প তবু গল্প নয়।

মহাপ্রভু।


'রাজা বললেন, যে আমার মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে পারবে তার সাথেই আমার মেয়ের ‘বিয়ে দেব‘- রামাই বলল। পরমুহূর্তেই তার অনুযোগ, ‘দেখুন ঠাকুর কেষ্টা হুঁ দিচ্ছে না!’
- ‘ওরে কেষ্টা, হুঁ বলরে ব্যাটা’, মহাপ্রভু কেষ্টাকে মৃদু ভর্ত্‌সনা করায় কেষ্টা অস্ফুট-স্বরে ‘হুঁ’ বলল। গল্প আবার শুরু হল।
তবে গল্পেরও গল্প থাকে। কে এই মহাপ্রভু? কারাই বা রামাই আর কেষ্টা- জানতে হলে আমাদের একটু কাশীপুর-পঞ্চকোট রাজবাড়ির ইতিহাসের পাতায় উঁকি দিতে হবে। তবে প্রসঙ্গতঃ জানাই যে এ ইতিহাস কোনও বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ অবস্থায় হয়ত পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন স্থানীয় লোকের স্মৃতিচারণে আর ১৯২৮ সালে পাটনার প্রকাশিত একটি সরকারি গেজেটের সূত্র ধরেই এ কাহিনীর অবতারণা।

মানভূম-পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজাদের কথা বাংলার ইতিহাসে আছে। সেখানে গৌড়বঙ্গের প্রাচীনতম শিখর-বংশীয় রাজত্বের পত্তন হয় ২১০০ বছর আগে পুরুলিয়ার ঝালিদহ বা ঝালদা গ্রামে মধ্যভারতের ধার রাজ্যের মহারাজা জগদ্দেওয়ের ভ্রমবশতঃ পরিত্যক্ত ও অনার্য সর্দারদের দ্বারা পালিত পুত্র দামোদর শেখর দ্বারা। তারপরের ১৯০০ বছর কাল ধরে রাজধানীই স্থানান্তরিত হয় সাতবার, ৮১ জন রাজপুরুষ সিংহাসনে আসীন হন। মহারাজ কীর্তিনাথ শিখর ৯২৮ খৃষ্টাব্দে পঞ্চকোট পাহাড়ের তলদেশে রাজধানী স্থাপনা করেন ও উনবিংশ শতাব্দীতে বর্গীদের আক্রমণে সে গড় ধ্বংস হলে রাজধানী নিয়ে আসা হয় কাশীপুরে।

আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কাঞ্চীর আয়েঙ্গারবংশীয় ত্রিলোচন আচার্য নামে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ তীর্থ-ভ্রমণকালে পঞ্চকোট পাহাড়ের তলে একটি মন্দিরে কিছুদিন বিশ্রাম করেন। তাঁর শরীর থেকে নির্গত দিব্য-জ্যোতির কথা লোকমুখে শুনে পঞ্চকোটের তখনকার রাজা শত্রুঘ্ন ওরফে গরুড় নারায়ণ সিংহদেও তাঁকে দর্শন করতে আসেন ও তাঁর শিষ্যত্ব নিতে চান। আচার্য রাজী না হলেও তাঁর ভাইকে একাজের জন্যে মনোনীত করেন। এভাবেই ১৬৫১ সালে কাঞ্চীর আয়েঙ্গারবংশের শ্রী রঙ্গরাজ রাজগুরু হিসেবে পঞ্চকোট আসেন। অচিরেই তিনি পরিবার ও বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজন তামিলনাডু থেকে পাঞ্চেত নিয়ে আসেন। নিকটস্থ বেরো পাহাড়ের পাদদেশে বেরো বা গদিবেরো নামক ৫৭ ১/২ খানি মৌজা নিয়ে তৈরি গ্রামটি দেবোত্তর স্বীকৃতি দিয়ে তাঁদেরকে থাকার জন্যে উৎসর্গ করা হয় ও তাঁরা এখানে অধিষ্ঠিত দেবতা কেশব রায় জিউর সেবাইত নিযুক্ত হন। এই বংশের পুরুষরা মহাপ্রভু নামে বংশানুক্রমে বেরো গ্রামে থেকে আসছেন ও ঠাকুর কেশব রায় জিউর মন্দিরে মোহান্তরূপে কাজ করে আসছেন।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে যখন মহারাজা নীলমণি সিংদেও পঞ্চকোট থেকে কাশীপুরে রাজধানী নিয়ে আসেন তখন মহাপ্রভু বংশের মহান্ত রাজগোপাল আচারি গোস্বামী ছিলেন গুরুদেব। ইনি পরোপকারি, দয়ালু ও আত্মভোলা মানুষ হিসেবে অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ছিলেন, তিনিই বেরোয় প্রথম উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনা করেন ও পরবর্তীকালে মেয়েদের শিক্ষারও প্রসার ঘটান। আমাদের এই কাহিনী মহাপ্রভু রাজগোপাল আচারিকে নিয়েই, না উনি গভর্ণর জেনারেল চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারির কেউ হতেন না। বরং ততদিনে আয়েঙ্গার গুরুবংশের এই বাহ্মণ পরিবার ও চল্লিশেরও বেশী তাদের আত্মীয়স্বজনের পরিবার তামিল ভাষা ভুলে মানভুমের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছেন। শুধু তাঁদের যাজ্ঞিক ক্রিয়াকর্ম, পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠান এখনও কাঞ্চীর বৈদিক নিয়মমতে হয়ে থাকে। এমনকি বিয়ের কনেও আসে তামিলনাডু থেকে যিনি হয়ত একবর্ণও বাংলা বা মানভুমের ভাষা বোঝেন না, চরম নিগ্রহ ভোগ করতে হয় তাঁকে তার ফলে।

আপাততঃ তাহলে ফিরি আমাদের গল্পে। আমাদের এই আপনভোলা মহাপ্রভুটির দুটি নেশা ছিল, এক আফিমের ও দুই গল্প শোনার। প্রতি সন্ধ্যায় ঈশ্বরনাম শেষে শুরু হত তাঁর মৌতাত। কেষ্টা নামে ভৃত্যের দায়িত্ব ছিল আফিম আর অনুপান হিসেবে ঘন করে জ্বাল দেওয়া সর-পূর্ণ দুধের বাটির যোগান দেওয়ার। তেলেঙ্গানা থেকে আমদানি করা ধূর্ত ভৃত্য রামাইএর কাজ ছিল প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্যে প্রতি সন্ধ্যায় গল্প শোনানোর। সে গল্প হয়ত এভাবেই শুরু হত।
- ‘নে রামাই, এবার ধর। খবর্দার, একগাদা দুক্‌খু-টুক্‌খু আনবি নে কিন্তু বলে দিচ্ছি।‘ প্রভু বলতেন।
- ‘না আজ্ঞে, তাই কি করি! তবে কেষ্টাকে বলে দিন যেন প্রতি কথার শেষে হুঁ দেয়। না হলে আমার গল্প-বলার মেজাজ আসবে না কিন্তু, বলে দিচ্ছি।‘
- ‘সে ভাবিস নে। কেষ্টার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে যে হুঁ দেবে না!’
গল্প শুরু হয়। এক অজানা দেশের রাজার সবরকম সমৃদ্ধির মাঝে থেকেও এক অদ্ভুত বেদনার উপাখ্যান। রাজার একমাত্র মেয়ের অতুল রূপরাশি, শিক্ষা-দীক্ষাতেও অসামান্যা, অথচ কথা বলতে পারেন না। রাজা কী করেননি মেয়ের মুখে কথা ফোটাতে! ডাক্তার-বদ্যি, সাধু-সন্ন্যিসি, তাগা-তাবিজ, জলপড়া-মন্ত্রপড়া কিছুই বাদ দেন নি । তবু সবই বৃথা।
-‘এইবার তুই মার খাবি রামাই। মানা করলেম না এমন দুঃখের গল্প বলতে।‘ রামাই দেখে প্রভুর দুচোখে জল।
-‘তা যদি বলেন, মহাপ্রভু, অন্য গল্প বলি?’
-‘তা কি হয় রে ব্যাটা! শুরু করেছিস যখন শেষ তো করতেই হবে। তা হ্যাঁরে, রাজা আমাদের কেশব জিউএর থানে মানত করে নাই?’
-‘তা তো জানি না ঠাকুর, কি জানি ওরা হয় তো কেশব জিউএর নামই শোনে নি।‘
- ‘দাঁড়া একটু’, এই বলে প্রভু ঘরের ভেতর থেকে পাঁচটি সিকি এনে দেন রামাইএর হাতে ‘যা তো কাউকে পাঠিয়ে দে, এক্খুনি একটা পুজো দিয়ে মানত করে আসুক বাবার মন্দিরে।‘ ধূর্ত রামাইএরই লাভ, যদিও কেষ্টাটাকে চার আনা বখরা দিতে হবে, সে জানে।
- ‘তারপর কি হল রে, রামাই?’ প্রভুর আদেশে রামাইকে আবার গল্প শুরু করতে হয়।
- ‘তারপর হুজুর, বহু চিকিৎসা, বহু পুজো-আচ্চা করেও যখন কিছু হল না, মহারাজ একটা পুরস্কার ঘোষণা করলেন। যে রাজকন্যের মুখে কথা ফোটাতে পারবে তার সাথে রাজকন্যার বিয়ে দেওয়া হবে। দেখুন ঠাকুর, কেষ্টা হুঁ দিচ্ছে না, কিন্তু!’
- ‘হুঁ, হুঁ,’ কেষ্টা চোখ রগড়ে বলে ওঠে, রামাই খুশি।
- ‘বহু লোক এল, গেল, অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু ফল কিছুই হল না। রাজকন্যে অমনি উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে। শেষে একদিন রাজার বাড়িতে একটা চোর ঢুকল।‘
-‘বলিস কি রে, রাজবাড়িতে চোর! পাহারা ছিল না?’
- ‘সে আমি কি জানি। পাহারাদার হয়ত আফিম খেয়ে ঝিমোচ্ছিল’- বলেই জিভ কাটল রামাই। ভাগ্যিস প্রভু কথাটা খেয়াল করেন নি। ‘না না, চোর ব্যাটা ছিল মহা ধূর্ত। সবার চোখ এড়িয়ে সে সিঁধ কেটে ঢুকল রাজকন্যার শোবার ঘরে।‘
- ‘কেন, রাজকন্যের শোবার ঘরে কেন? ওরে রামাই, তোর পেটে পেটে শয়তানি আমি জানি। রাজার মেয়ের যদি কোনও ক্ষতি হয়, নীলমণিকে বলে তোকে তাড়াব আমি।‘
- ‘তার আমি কি জানি ঠাকুর। চোর কি আমায় বলে ঢুকেছে!’
- ‘হেই নে বাপ, আমার এই আংটিখান। চোরকে বল এটুকু নিয়ে সরে পড়তে। দেখিস বাবা রাজকন্যের যেন কোনও ক্ষতি না হয়।‘
রামাইয়ের তো আজ পোয়াবারো, তার লাভের পর লাভ।

- ‘ঠিক আছে ঠাকুর। তা আপনার আশীর্বাদে চোর রাজকন্যাকে কিছু করল না। তার শোবার ঘরের লাগোয়া ছিল ঠাকুর ঘর, ও সেদিকেই এগিয়ে গেল। এদিকে রাজকন্যার ঘুম ভেঙে গেছে কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না। তার সামনে দিয়েই চোর ঢুকে গেল ঠাকুরঘরে। তারপর ধীরে ধীরে - ও ঠাকুর, কেষ্টা চুপ করে আছে, আমি আর বলব না’- রামাই চেঁচিয়ে ওঠে।
- ‘কেষ্টা, তুই এবার মার খাবি হারামজাদা! হুঁ দিস না ক্যানে?’ অনেক হাতে পায়ে ধরে এ যাত্রা উদ্ধার পেল কেষ্টা।
- ‘চোর তারপর গৃহদেবতার সোনার মুকুটখানি খুলে নিয়ে পালাতে গেল রাজকুমারীকে পার করে।‘
-‘তারপর’- রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করেন মহাপ্রভু।
- ‘তারপর হঠাৎ কোত্থেকে কি হয়ে গেল রাজকন্যা চোর চোর বলে চিৎকার করে উঠল।‘
- ‘বলিস কি রে! তারপর?’
- ‘তারপর তো লোকজন ছুটে এল। তারা তো প্রথমেই চোরকে ধরে বাঁধতে গেল। তারপর অবাক হয়ে দেখে রাজকন্যা কথা বলছেন। রাজা-রানী ছুটে এলেন। সবার চোখে আনন্দে জল চলে এল।‘
- ‘ভগবান আছেন, বুঝলি রে রামাই, ভগবান আছেন। বড় জাগ্রত ঠাকুর আমাদের কেশব রায় জিউ।‘ মহাপ্রভু পরম বিশ্বাসে বললেন।
- ‘কিন্তু ঠাকুর, একটা সমিস্যে হল তারপর, সেটা কেউ সমাধান দিতে পারছে না। কথা হল রাজা কি এখন চোরকে শাস্তি দেবেন না তাকে নিজের জামাই করবেন? ওনারা এখনও ভাবছেন গুরুজি! এখন আপনি যদি এর একটা বিহিত করেন।‘
- ‘তাই তো রে, আমি পূজারি পণ্ডিত, আমি এসব সামাজিক সমিস্যের কি জানি। ঠিক আছে, কাল সকালে রাজা নীলমণিকে একবার তলব দিস তো, দেখা যাক কি বলেন।‘
পাঠকরা জেনে রাখুন গুরুদেবের ডাকে রাজার না এসে থাকার ক্ষমতা ছিল না, যতই তিনি শিশুর মত আপনভোলা মানুষ হন না কেন। পরদিন সকালে রাজা এসে মহাপ্রভুকে প্রণাম করলেন। গুরুদেবের প্রশ্নের উত্তরে সমস্যার একটা সমাধানও তিনি দিলেন। তাঁর মতে চোর যখন চুরির উদ্দেশ্যে রাজবাড়িতে ঢুকেছে ও হাতেনাতে ধরা পড়েছে, শাস্তি তার পাওনা। তবে চুরি করতে পারেনি বলে তাকে মোটামুটি দু-বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়াই উচিৎ।
-‘তার পরে?’
- ‘তার পর কথামত সেই চোর হবে রাজার জামাতা। চোর বলে রাজা তো তাঁর কথার খেলাপ করতে পারেন না।

গুরুদেব অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ডাকলেন, ‘মহারাজ’।
- ‘আজ্ঞা করুন গুরুদেব।‘
- ‘আমি যদি বেতাল হতাম, তোমাকে আজ বিক্রমাদিত্যের উপাধি দিতাম। তা যখন হবার নয়, আপাততঃ মন্দিরেই এসো, কেশবজিউএর পূজার প্রসাদ খেয়ে যাও।

আজ আর মহাপ্রভু নেই, নেই পঞ্চকোট বা কাশীপুরের সিংদেও রাজারা। রাজবংশের ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন পরিচয়ে। মহাপ্রভু বংশ ও কুটুম্বের লোকজনদের মধ্যে কেউ হয়েছেন পাটনা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল (ডাঃ গোবিন্দাচারি), বা কেউ বিখ্যাত নিউরো-সার্জন (ডাঃ এন কে আচারি), বা স্বাধীনতা-সংগ্রামী (শ্রী রাঘব আচারি) কিংবা সাংসদ (শ্রী বাসুদেব আচারি) ইত্যাদি। সব ঘটনার সাক্ষী পঞ্চকোট পাহাড় তো সদাই নীরব- শুধু দামোদর নদ কুলুকুলু শব্দে একমনে বয়ে চলেছে পশ্চিম থেকে পূর্বে।

মুম্বাই, ২৯শে অক্টোবর, ২০১৫।
-

বাংলা বিবিধ- যাচ্ছেতাই (২)

#বিশুমামা_জিন্দাবাদ

(গুল্প)

পরিচয়-পর্ব।

বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী ওরফে আমাদের বিশুমামার একটা প্রাথমিক পরিচয় আগের পর্বে (উলানবাটোরের ওস্তাদ) দিয়েছি। এবার একটু বাস্তব প্রসঙ্গে আসি। আমার বিশুমামা একটি রহস্যময় মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার, এবং পৃথিবীর যাবতীয় অর্থকরী কাজেই অকৃতকার্য। তবে তার জন্যে তাঁর মনে কোনও ক্ষোভ ছিল না। তিনি যখন তখন লোকালয় থেকে উধাও হয়ে যেতেন, কখনও পন্ডিচেরির অরবিন্দ-আশ্রমে, কখনও অযোধ্যা আবার কখনও বা হরিদ্বারের কনখলে মা আনন্দময়ীর আশ্রমে গিয়ে খুঁটি গেড়ে বসে থাকতেন পাঁচ-ছয় মাস। আবার ফিরে আসতেন অভিজ্ঞতার ঝুলিটি ভরে নিয়ে। সে সব দিনগুলো ছিল আমাদের কাছে বড় আনন্দের। তাঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল গানের গলাটি। বিশ্বভারতী সংগীতবিভাগে ডিপ্লোমা নিয়ে এখানে ওখানে বেশ কিছুদিন ক্লাস করে যখন বেশ খ্যাতি লাভ করেছেন, তখনই হঠাৎ নিরুদ্দেশ যাত্রা করলেন। ফিরে এসে কিছুদিন আমাদের বাড়িতে থাকলেন। জিজ্ঞেস করলে পলাতকের গান গেয়ে উত্তর দিতেন-
'খেয়াল-পোকা যখন আমার মাথায় নড়ে-চড়ে
আমার তাসের ঘরের বসতি যে অমনি ভেঙে পড়ে।
তখন তালুক ছেড়ে মুলুক ছেড়ে হই যে ঘরের বার, বন্ধু রে......।'

সেদিন বিকেলে কানু-সুজয় আসাতে প্রথম উনি এবার মুখ খুললেন।
- উঃ, এবার পণ্ডিচেরি আশ্রমে কাদের দেখলাম, তোরা বললে বিশ্বাস করবি না!
- বিশ্বাস করেছি কখনও? সুজয়ের উত্তরটা একটু বাঁকা শোনাল।
- একত্রে তিনমূর্তি- দিলীপ রায়, সাহানা দেবী আর নলিনীকান্ত।
- নলিনী গুপ্ত? আমি জানতে চাইলাম।
- না রে বোকা, ইনি সরকার। নজরুল, দিলীপ রায়দের বন্ধু, দাদাঠাকুরের জীবনী লিখেছিলেন। বন্ধু সজনী দাসের আগ্রহে ‘শনিবারের চিঠি’তে রেগুলার লিখতেন।
ভাবি, যে লোকটার এত জ্ঞান, তার গুল দেওয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে।
তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যেত সেই নমস্য ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ নিয়ে। মুখে জর্দাপান নিয়ে দিলীপবাবু ‘মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ বা ‘আজি এসেছি বঁধু হে’ কিভাবে গাইতেন, হুবহু নকল করে শোনাতেন বিশুমামা। সাহানা দেবী রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছাত্রী- রবীন্দ্রসংগীতের একজন দিক্‌পাল হয়েও কিভাবে দিলীপ রায়ের বন্ধু ও ভক্ত হয়ে উঠলেন, শোনাতেন সেসব অজানা কথা। জানিনা এর মধ্যে কতটা সত্যি থাকত। আমি মুম্বাইয়ে চাকরি করতে যাবার আগে উনি একজনের সাথে দেখা করতে বলেছিলেন। ভদ্রমহিলা ব্যালার্ড পিয়ারে থাকেন, হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল গানের শিক্ষিকা। আমি রাজী হতে বললেন, গিয়ে আমার নাম করবি, তবে ফোন করে যাস, লতাজি-আশাজিরাও তাঁর কাছে শেখেন কিনা!
বোঝো ব্যাপারখানা! আমি কিন্তু পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম যে সত্যিই ঐ নামে এক মহিলা থাকেন সেখানে, লতা-আশা অনেকেই তাঁর কাছে ক্লাসিকাল শেখেন। কিন্ত আমি আর ভয়ে সেদিক মাড়াইনি। যদি গিয়ে শুনতাম যে উনি বিশুমামাকে চেনেন, বোধহয় ততটা আশ্চর্য হতাম না, যেভাবে সারপ্রাইজ দিতে দিতে তার ‘প্রাইজ’টাই নষ্ট করে দিয়েছিলেন তিনি।
পরে বিশুমামা বিশ্বভারতী থেকে গানের ডিপ্লোমা নিয়ে ফেরেন ও দুর্গাপুরে একটি স্কুলে গান শেখাতে শুরু করেন। তবে বোহেমিয়ান জীবনযাপনের জন্যে বেশ কয়েকবার বিতাড়িত হয়েছেন, আবার দুটো মিথ্যে কথা বলে ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। বাচ্চাদের গান শেখানোর ওনার একটা সহজাত প্রতিভা ছিল। উনি ‘সাউণ্ড অফ ম্যুজিক’ স্টাইলে সা-রে-গা-মা শেখাতেন যেমন- সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা/ সা-নি-ধা-পা-মা-গা-রে-সা ‘র সুরে গেয়ে শোনাতেন- ‘ন-মো-ন-মো বী-না-পা-ণি/ ন-মো-বা-ণী-না-রা-য়-ণী’। একদিন এসেছেন শান্তিনিকেতনে ভিজিটিং প্রফেসার ডাঃ ভূপেন হাজারিকার কাছে একটা ওয়ার্কশপ করে। তারপর বলাকওয়া নেই, আমাদের ভাই-বোনদের নিয়ে উঠে পড়ে লাগলেন কলাবতী রাগ নিয়ে। গেয়ে শোনালেন ভূপেনের অপ্রকাশিত গান-
‘দু-দিনের জীবনে কি পাই কে জানে,
তাই সুরে-বেসুরে, তালে-বেতালে
গান গেয়ে আনন্দ পাই-
সা-ণি-ধা-পা, ণি-ধা-পা, ধা-পা-গা রে,
গেয়ে যাই।- এই দ্যাখ, কলাবতী জানিস না! সা-গা-পা-ধা-ণি-ধা-পা-র্সা, র্সা-ণি-ধা-পা, গা-পা-গা-সা-ণি্‌-ধা্‌-সা.....'.বলে শুরু করতেন ধনঞ্জয় স্টাইলে সলিলের গান - 'জানিনা কখন কোথায় তুমি থাক, জানিনা মনে রাখ কি না রাখ...'
-'জানিস, সলিলের সুরে সত্যেন দত্তের ‘পাল্কির গান’ এর আগে বেরিয়ে যায় ভূপেনজির ‘দোলা’ – অসমীয়া ভাষায়, সাড়া জাগায় কাব্যগীতি হিসেবে।' বলেই হারমোনিয়ম টেনে নিয়ে গেয়ে উঠতেন-
“হে দোলা,
অ্যাঁকাব্যাঁকা বাটে রে, করিআঁহু করিআঁহু
বর বর মানুহর দোলা।
হে আপোন করিলো বনুয়ার জিয়নক
দেহা ভাগোরাই তোলা হে দোলা।
হেই রেইয়া না, রেইয়া না, রেইয়া না।।‘
এই বিশুমামার সেই স্বতঃস্ফুর্ত উচ্ছ্বাসটা একদিন প্রায় হারিয়ে গেল একটা বিশ্রী দুর্ঘটনায়। বারান্তরে সেসব বলা যাবে।

Monday, August 31, 2015

Translation- Bengali to Hindi

"বলছি ওরে ছাগলছানা,
উড়িসনে রে উড়িসনে,
জানিসনে তোর উড়তে মানা-
হাত-পাগুলো ছুঁড়িস নে !"

(সুকুমার রায়)

ए बकरी का बच्चा,
उड़ना मत रे उड़ना मत,
पंख नहीं हैं तेरे
क्यों फेंकता है पांव-हाथ?

Bengali Humor- যাচ্ছেতাই ।।

যাচ্ছেতাই ।।
(১)


কিছু কিছু লোক আছেন যাঁরা মুখটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে এমন অনেক কথা বলে যাবেন, শুনে মনে হবে সেসব বিশ্বের গভীরতম রহস্য ও তার সন্ধান একমাত্র তিনিই জানেন। পরে একটু চিন্তা করলেই সব ভড়ং বোঝা যায় কিন্তু সেই মুহূর্তে অন্য কিছুই আর মাথায় আসেনা। এরকম একজন ছিলেন আমার বিশ্বেশ্বর ওরফে বিশুমামা।
বিশুমামার গানবাজনার খুব শখ ছিল। নিজে কতটা বুঝতেন জানি না, তবে আনকোরাদের ভড়কি দিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। 'সেবার রাজাভাতখাওয়া সংগীত উৎসবে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা'- এইরকম একেকটা চমক দিয়ে শুরু হত তাঁর গল্প। আমি হয়ত রাজাভাতখাওয়া জায়গাটা কোথায় তা জানতে চেয়েছি, কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে মামা বলতেন- 'সে এক মজার জায়গা। পৃথিবীর সব রাজাদের অন্নপ্রাশন হত সেখানেই। তা এরকম একটা জায়গার সংগীত সম্মেলন বলে কথা। ওস্তাদ আর পণ্ডিতদের বিশাল জমায়েত হয়েছে।'
- আচ্ছা মামা, এই ওস্তাদ আর পণ্ডিতের মধ্যে তফাৎ কি? দুজনেই তো গান গায়!
- হ্যাঁ, তফাত তো সুকুমারবাবুই বুঝিয়ে গেছেন, পড়িসনি? 'ওস্তাদেরা লেপমুড়ি দেয় কেন মাথায় ঘাড়ে,/ টাকের পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে?' ইতিমধ্যে কানু আমাকে বোঝাতে লেগেছে যে মুসলমান গায়কদের ওস্তাদ আর হিন্দু গায়কদের পণ্ডিত বলে। ব্যাপারটা বিশুমামার নজর এড়ায় নি। 'হ্যাঁরে কানু, ওস্তাদি করছিস, না পণ্ডিতি ফলাচ্ছিস? দুটোই কিন্তু এখানে নিষিদ্ধ।' যাক, ব্যাপারটা শেষমেষ ভালয়-ভালয় মিটে গেল। বিশুমামার গল্প আবার শুরু হল।
- সে অনুষ্ঠানে লোকজন কিন্তু ভালই হত। গায়ক-বাদকরা দূর দূর থেকে আসতেন। শুধু হিন্দুস্থানী নয় কর্ণাটকি পণ্ডিতরাও আসতেন দক্ষিণ দেশ থেকে।
আমি আবার জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলাম কর্ণাটকি নিয়ে কিছু একটা। সুজয় কানে কানে বলল, 'আরে করিস কি! এখনি বলে দেবে যারা নাটক করে তারাই কর্ণাটকি।' শুনে আমি চুপ করে গেলাম।
- সেবার এক পণ্ডিত এসেছেন উলানবাটোর থেকে। এদেশের শাস্ত্রীয়সংগীতে তাঁর বেজায় দখল। বলেন, ওঁদের গ্রামটা নাকি ধারোয়ারের কাছে, কর্ণাটকি আর হিন্দুস্থানী দুই ধারাই সমান চলে সেখানে। এতগুলো গায়ক-বাদক দেখে তো তিনি রেগে কাঁই। বলেন, 'আজীব বাত হ্যায়। একা আমিই তো রাতভর টানতে পারি, বাকিরা তবে কি করবে, হাঁ? এক-আধ ঘন্টে মে ক্যা হোতা হ্যায়? আরে ভাই শাস্ত্রীয় সংগীত কো ক্যা সমঝ রাখা হ্যায় তুমলোগ!'
এই শুনেই তো অর্গানাইজারদের হয়ে গেছে। সর্বনাশ! বিসমিল্লা, করিম খাঁ, শিবকুমারের মত তারকারা রয়েছেন আজ রাত্রে। তাঁরা তাহলে কি করবেন? যথারীতি বিনয়ের সাথে একটু ভেবে দেখতে বললেন তাঁরা। জবাবে পণ্ডিত কি বললেন ঠিক বোঝা গেল না। উনি শুধু বললেন, আমি রাগরাগিনী ঘড়ি ধরে গাই। সন্ধ্যার পূরবী দিয়ে শুরু করব, আর সেই রাগের সময় পেরিয়ে গেলে আর সেটা গাইব না। এই বলে তিনি পূরবীতে আলাপ শুরু করলেন।
- তারপর? আমরা তিনজন শ্রোতা একত্রে বলে উঠলাম।
- তারপর পূরবীর আলাপ শেষে ধরলেন ইমনকল্যাণ, মালকোশ। তারপর খাম্বাজে একটা বন্দিশ শেষ করে যখন বেহাগে তারানা ধরেছেন তখন রাত্রি দুটো। শেষপাতে যখন ভৈরবের পর আশাবরীর একটা তান দিয়ে শেষ করলেন, তখন সূর্য উঠে গেছে আর উদ্যোক্তারা মাথার চুল ছিঁড়ছেন।
- সে কি, আর অন্য ওস্তাদেরা?
- আরে সেটাই তো কেউ বুঝতে পারছে না যে সবাই এত শান্ত কেন। শেষে ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ তাঁর সানাইটা মাথায় ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'সমবেত শ্রোতাগণ, গত দু-ঘণ্টায় উলানবাটোরের পণ্ডিতজি আমাদের সন্ধ্যে থেকে সকালের চার প্রহরের আটটা বিভিন্ন রাগ গেয়ে শুনিয়েছেন। অাল্লাহ কা করিশ্মা দেখিয়ে, জেইসা রাগ ওইসা সময় দিখাই দিয়ে হামারি আউর আসমান কি ঘড়ি মেঁ।' সত্যি সবাই তাকিয়ে নিজের নিজের ঘড়িতে দেখে রাত্রি ন'টা বাজছে মাত্র। হল হাততালিতে ফেটে পড়ে।
হঠাৎ কি যেন একটা জরুরি কাজ মনে পড়ায় বিশুমামা চটপট উঠেই পিট্‌টান দিলেন।
আমরা তখনও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছি, কানু বলে উঠল, 'ইয়ার্কি পেয়েছে! একটা রাগের আলাপ থেকে অন্য রাগের মুখড়া, মালকোষের অন্তরার পরে খাম্বাজের তা্রানা। মালকোষ পঞ্চম বর্জিত রাগ, তবলা-তানপুরা সব মধ্যমে বাঁধতে হয়- ততক্ষণ পাবলিক হিপনোটাইজড হয়ে বসে থাকবে!'
- 'উলানবাটোর থেকে ওস্তাদ! উলানবাটোর ধারোয়ারের কাছে! গুল মারার আর জায়গা পায়নি। উলানবাটোর মঙ্গোলিয়ার ক্যাপিটাল- যেন আমরা জানিই না।' সুজয় বলে উঠল, ও আমাদের মধ্যে একটু সিরিয়াসলি পড়াশুনা করে।
- 'যদি জানতেই তবে বলতে পারলে না কেন, চাঁদ? নাকি তোমরাও হিপ্নোটাইজড হয়ে গেছিলে' - বলার পালা এবার আমার।
- 'হয়তো তাই'- আমরা সবাই একসাথে বলে উঠি।

মুম্বাই- ২৭শে আগস্ট, ২০১৫।

Wednesday, July 29, 2015

Bengali Poem- "আজব ভূগোল"

আজব ভূগোল ।।


'হিংলাজে' হিং চেয়ে লজ্জা কি কম বা?
'সিকিমে'তে টু সি কিম্‌? অষ্টটি রম্ভা!
'পণ্ডিচেরি'তে নাকি চেরি খুব সস্তা?
'জামনগরে'তে জাম দশ টাকা বস্তা!

আজব ভূগোলে ভাই লেখা আছে 'ভুটানে'
পা দুখানি ওঠে না, ভূ-অভিকর্ষ টানে।
'রাজাভাতখাওয়া' গিয়ে রাজা ভাত খায় কি?
মাল-দার সবলোক থাকে 'মালদা'য় কি!

শীতকালে গাছ থেকে পাতা যায় ‘ঝরিয়া’,
ভারতকে হকিতেও হারাল কী 'কোরিয়া’?
চিনি যদি নাই চিনি যাব কি 'চিন'-পানে,
‘যা পান আনগে’ বলে পাঠাবে কি 'জাপানে'?
লঙ্কায় ঝাল নেই, ঝাল কি 'শ্রীলঙ্কা'য়
'সিঙ্গাপুরে' সিঙা ফুঁকে মরে ভয়ে-শঙ্কায়।
'খাইবার পাস' থেকে পাশটি করে এসে
'পুরী' গিয়ে ভুরিভোজ খায় লুচি পায়েসে।

আর্মানি হার মানি জার্মানি ছোটে রে
কাতারে কাতারে লোক কাতারেই জোটে যে!
 'নাই রবি', তবু তা যে আঁধার নগরী নয়
'কে নিয়া' গেল বলে সে দেশ উদাস হয়। 
শহরেতে বাস করে ‘বন’বাসী কাহারা?
বে-সাহারা মরুভূমি, নাম তবু 'সাহারা'!
পুত্রের দেশ বলে 'পো-ল্যান্ড' কে জানি গো
জামাতার বলে তবে 'জামাইকা' মানি তো? 
যাও আর এসো শুনে গিয়ে দেখি 'গোআ'তে-
গেছে- জেনে পিণ্ডি কে দিয়ে এল 'গয়া'তে।।

(মুম্বাই, ৩০শে আগস্ট, ২০১৫)

Bengali From Diary - 'Smriti Satatai'



।। স্মৃতি সততই ।।



শিলচরে 'রাবিন্দ্রিকী' গোষ্ঠীর অন্যতম কর্ণধার শ্রীমতী মৈত্রেয়ী দামের কাছে আমার স্ত্রী তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতেন। স্বামী রূপক ও কন্যা সোহিনীকে নিয়ে বেশ একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ছিল গুরুচরণ কলেজ রোডের ঐ বাড়িটিতে। ওখানেই দেখেছি সাহিত্যিক দেবেশ রায়কে, 'তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত' উপন্যাসের জন্যে সদ্য তিনি তখন আকাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। দেখেছি গৌরী ঘোষকে, সাংবাদিক অশোক দাশগুপ্ত ও ঢাকার প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞা প্রফেসর সন্‌জিদা খাতুনকে। ১৯৯১র মে মাসের এক বৃষ্টির দিনে রবীন্দ্রজন্মবার্ষিকীর প্রস্তুতির ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা জমেছিল। রূপকদা ও কিশোর শিল্পী রাহুল দত্ত গেয়ে চলেছে একের পর এক বর্ষার গান। তখনই মৈত্রেয়ীদি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলে উঠলেন- 'রবি ঠাকুর কি সব একেকটা বর্ষাঋতুর উপর গান লিখেছেন, কিন্তু আমাদের ভাগ্যে জুটেছে একটিই'।
- 'সে আবার কি?' সবাই হৈ হৈ করে উঠি। 'আমাদের ভাগ্যে মানে?'
- 'আর কিতা! ওই 'ঝর ঝর বরিষে বারিধারা। হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা।' '
সবাই হো হো করে হেসে উঠলেও কথাটা যে কতটা সত্যি তা বোঝা গেল ২৫শে বৈশাখের অনুষ্ঠানের দিনেই। 'প্রভু আমার, প্রিয় আমার' নামে একটা গীতি-আলেখ্য চলছিল। রবি ঠাকুরের গানে যে প্রভু আর প্রিয়র মধ্যে বিশেষ ভেদ নেই, প্রেম আর পূজা পর্যায় কোথায় যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে, গানে গানে সেটাই যেন বোঝানো হচ্ছিল ইনিয়ে-বিনিয়ে। গিন্নী এই অনুষ্ঠানে নেই, তিনি বাপের বাড়িতে, আর আমি বসে দর্শক আসনে। এমন সময় রূপকদা হন্ত-দন্ত হয়ে এসে বল্লেন- 'ব্যস, কাম সারসে। শিলচরের দ্যাবতা হাতে-নাতে দেখাইয়া দিসেন- তাইনের 'প্রেমে আঘাত আছে, নাইক অবহেলা।'
- তার মানে?
- বরাক নদীর বাঁধ ভাঙিয়া বন্যা ছুটেছে......আইজকার প্রোগ্রামের এখানেই ইতি।
ব্যস, দশ মিনিটে হল খালি। জল ঢুকতে লাগলো হু হু করে। কোনোমতে স্কুটার চালিয়ে বাড়ি পৌছলাম। বাসায় শুধু মা ছিলেন, তাঁকে আর সে রাত্রে কিছু বললাম না।
পরদিন সকালে উঠেই দেখি ধুন্ধুমার কাণ্ড। সামনের রাস্তায়, তখনো ঠিক পাকা হয় নি, মোরাম-ঢালা ছিল, এক হাঁটু জল ও ক্রমশঃই বর্ধমান। পঞ্চায়েত রোডে আমাদের ভাড়া-বাড়ি, মালিক ব্যাঙ্কের অফিসার, নরসিংটোলায় থাকেন। সযত্নে বানানো বাড়ি্র বাগানটি রাস্তার লেভেল থেকে অনেকটা উঁচুতে, তারও আড়াই ফুট উঁচু বাড়ির প্লিন্থ। খুব বড়সড় বন্যা না হলে অতদূর জল ওঠা অসম্ভব, তাই বেশ নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু এর একটা অন্য দিক ছিল, সেটা এবার টের পেলাম। পনের মিনিটের মধ্যেই হুড়মুড় করে এসে পড়ল আমার ঠিকে ঝি, কাচ্চা-বাচ্চা, তোলা উনুন, কাপড়-চোপড় নিয়ে একেবারে সপরিবারে। এক্ষেত্রে না বলা সঙ্গত নয়, এটাই কাছাড়ের দস্তুর। তারপর বন্ধুবান্ধবরা স্কুটার রাখতে আসতে লাগলো। ধীরে ধীরে আটটি স্কুটার নিয়ে আমার বাড়িটি অচিরাত একটি স্কুটার গ্যারেজে পরিণত হল।

(২)

এইবার চিন্তা হল অফিস যাব কি ভাবে। ছুটি ডিক্লেয়ার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি কর্মীরই দায়িত্ব হল যেনতেনপ্রকারেন দপ্তরে পৌঁছিয়ে কাজ বন্ধ করাবার জন্যে দরবার করা। তারপর যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ দেখিয়ে হেডকোয়ার্টার থেকে ছুটি পাওয়া যায় তবে দুর্যোগ আর উপভোগে তফাৎ কতটুকু? এদিকে পাজামা গুটিয়ে বাজারের দিকে একটু এগিয়ে দেখে এলাম চ্যাং-কুড়ি রোডের কাঠের পুলটুকু বাকি আছে বটে, তবে দুপাশের রাস্তা জলমগ্ন। তাকিয়ে দেখি পাশের বাড়ি প্রফেসর রঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়ির বারান্দায় তিনি প্রফেসার বন্ধু শ্যামলদার সাথে বসে চা খাচ্ছেন। আজ কলেজ ছুটি, ওঁরা জানালেন। 'সে কি, আপনাদের কলেজ তো টিলার উপরে, জলে ডোবার তো কথা নয়' আমি বলি।

- আরে ভাইটি, গরু-বাছুরগুলো না আসতে পারলে আমরা চরাব কাদের?' শ্যামলদা বললেন। প্রসঙ্গতঃ জানাই যে গুরুচরণ কলেজকে ছাত্র-শিক্ষক নির্বিশেষে 'গরু-চরানো' কলেজ বলতেন মজা করে এবং ছাত্রেরা সেটা ঠিক পছন্দ না করলেও অধ্যাপকেরা নিজেদেরকে ব্রজের সেই রাখালরাজার সাথে তুলনা করে যারপরোনাস্তি আনন্দ পেতেন। কিম্বা হয়ত সিলেটিরা স্বভাবতঃই খুব বুদ্ধিমান প্রাণী, অন্ততঃ মানুষের থেকে তো বটেই, তাই কথাটার অসম্ভবতা অনুমান করেই মজা পেতেন। আমি তাঁদের দলে যোগ দেব কিনা ভাবছিলাম, এমন সময় দেখি, অঙ্কের অধ্যাপক যাদব ভট্টাচার্য ধুতিখানা গুটিয়ে সেদিকপানেই আসছেন। তিন ভট্টাচার্যের ত্র্যহস্পর্শ থেকে ত্রিপাদদোষ লেগে যেতে পারে ভেবে আমি আর সেদিকপানে এগোলাম না।
হঠাত মনে হল কেউ যেন গেট খুলছে। তাকিয়ে দেখি আমাদের সহকর্মী গৌরীশংকর দত্ত গুটিগুটি পায় ঘরে ঢুকছে। 'কি রে, তুই এখনও ঘরে বসে', দত্ত আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠল। 'কেন, তুই কি অফিস যাবার জন্যে নৌকো ভাড়া করে এনেছিস?' আমি জানতে চাই।
- ঠিক ধরেছিস তো! ডিঙ্গি নৌকোটা কাঠের পুলে বেঁধে রেখে এসেছি। সকালে জি-এমের ফোন এসেছে বাড়িওলা মারফত, বন্ধুবান্ধবরা বন্যায় কে কেমন আছে তার খোঁজখবর নেওয়ার জন্যে। তাই বেরিয়ে পড়েছি। তুই তো এখন ঝাড়া হাত পা, চল আমার সাথে।
আমি তো একপায়ে খাড়া। মাকে জানিয়ে ওর সাথে নৌকো করে বেরিয়ে পড়লাম।
প্রথমে কলেজ রোডে আশিস বিশ্বাসের বাড়ি। ঘরের একতলায় জল থৈ থৈ। ও থাকে দোতলায়। মালিক একতলায় ছিল, জল ঢুকতেই তিনিও উঠে পড়েছেন ওপরে। আমরা হাঁক-ডাক করতেই বিশ্বাস দোতলার বারান্দা থেকে মই ঝুলিয়ে দিল, আমরা তাই বেয়ে বাসায় ঢুকলাম। ওর চিন্তা ছিল স্কুটারখানা নিয়ে, গৌরি বলল, 'চ্যাটার্জির বাগানে অন্ততঃ সাতটা স্কুটার দেখে এলাম। চল সেখানেই রেখে আসি, চিন্তা নেই, কোনও ভাড়া লাগবে না'। 'ভাড়া কেন, কুলি খরচও লাগবে না, আমরা আছি তো, শিক্ষিত কুলি', আমি আশ্বস্ত করলাম। তারপর তিনজনে মিলে ধ্বস্তাধস্তি করে স্কুটারকে নৌকোয় চাপিয়ে আমার বাড়িতে নিয়ে এসে রাখা হল।
ফেরার সময় আবার একই পথ ধরলাম। এবার আমরা তিনজন। হঠাৎ খেয়াল হল, নীহারের খবর তো নেওয়া দরকার, ওর জ্বর ছিল দু-তিনদিন ধরে। যদিও ওরা থাকে কলেজের পেছনে টিলার ঢালু অংশটিতে, সেখানে কোনদিনই বন্যা আসবে না। তবু ওরা কেমন আছে খবরটা নেওয়া প্রয়োজন মনে করে আমরা রাস্তার ধারে নৌকো 'পার্ক' করে নীহার ব্যানার্জির বাসার কড়া নাড়ালাম।


 (৩)

নীহার বেরিয়ে এল, মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। আমরা ওকে স্মোক করতে কখনো দেখিনি। 'বুলা, তুমি নীহারকে সিগারেট ধরিয়েছ?' গৌরী হাঁক পাড়ল অন্তরালবর্তিনীর উদ্দেশ্যে।
'ওহ্‌, আমার কি ক্ষমতা ওকে কিছু ধরাই বা ছাড়াই! ওর ধারণা একটানা সিগারেট খেলে জল তাড়াতাড়ি নেমে যাবে'- বুলা দেবী এবার সরোষে প্রকট হলেন, হাতে ধূমায়িত কাপের ট্রে।
- আসলে আমার জলে একটা আতঙ্ক আছে...না, না কুকুরের কামড় থেকে নয়, ছোটবেলায় খড়গপুরে দেখা একটা ভয়াবহ বন্যার ঘটনা থেকে। পরের বছরও যদি এরকম দেখি, আমি এখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাব- নীহারের বক্তব্য।
আমি ছোটনাগপুরের পাহাড়ি শহরে মানুষ, বর্ষায় তোড়ে জল বয়ে যেতে দেখেছি। সেই সময় সাধারণ অবস্থায় লাফ দিয়ে পার হওয়া যায় এমন এক নালার জলের স্রোতে শুধু মানুষ নয়, আস্ত একটা বাস ভেসে যেতে দেখেছি চোখের সামনে দিয়ে। পুরো ঘটনাটা হৃদয়-বিদারক, তবে এটুকু বলতে পারি যে বাস ড্রাইভার ভাল অঙ্ক জানত না, ভেলোসিটি প্যারালেলোগ্রামের ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। যাক সে কথা। তবু একবার আরেক পাহাড়ি শিল্প-শহর জামসেদপুরের সোনারি অঞ্চলে বন্যা দেখেছিলাম সে কোন ১৯৭৪ সালে। সেও নেহাৎ শহুরে বাবুদের শখ-চরিতার্থের বন্যা। সুবর্ণরেখা-খড়কাই-এর সঙ্গমস্থলে হঠাৎ জল বেড়ে এক কাণ্ড, অপ্রস্তুত গৃহবাসীদের অবাক করে ফ্রীজ-সোফাসেট-আলমারি সব ভাসিয়ে নিয়ে এসেছিল ঘরের বাইরে, সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই হুজুগে দর্শনার্থীদের ভীড় লেগে গেল শহরের একপ্রান্তের এই অঞ্চলটিতে। সেই শ্রাবণে অনেকে পৌষমাস দেখে ফেলল, যেমন ফুচকা-অলা, বেলুন-বাঁশীওলা ইত্যাদি। রথ দেখা আর কলা-বেচা একসাথে চলতে থাকল। শুনেছিলাম একটা নাগরদোলাও নাকি এসেছিল, ভেজা মাঠে সাহস করে খুঁটি পুঁততে পারেনি বলে ফিরে যেতে হয়েছিল তাদের!
সেই আমার চোখের সামনে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে জল শুধু জল। আমার তো ভালই লাগছিল দেখতে, জানিনা নীহারের চিত্ত কেন হয়েছে বিকল। ওকে অনেক বলেও বাড়ি থেকে বের করা গেল না। অগত্যা আমরা এবার সৎসঙ্গ আশ্রমের জলপথ ধরলাম, সেখানে আছে দুই গুজরাটি পরিবার, হরিয়ানি আর উকিল। দুজনের নামেরই কোনও ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। ভরতভাই হরিয়ানির সাথে হরিয়ানার কোনো সম্বন্ধ নেই, আর মিঃ উকিল ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। যাই হোক, তাঁরা সপরিবারে ভালই আছেন, গুজুভাইদের বাসায় সর্বদা অন্ততঃ একমাসের চাল-ডাল-নুন-তেল স্টক করাই থাকে, তাই ওদের বিশেষ চিন্তা নেই। তবে ছেলেমেয়েরা কান্নাকাটি করছে, গুজরাটে একসাথে এত জল দেখা যায় না কিনা! আমরা অগত্যা ফিরলাম। এরপর আমাদের গন্তব্য বিবেকানন্দ রোড, স্বপন দাস এণ্ড কোং।


(৪)

শিলচরের বিবেকানন্দ রোড তখন ত্রিশ ফুট চওড়া একটি নদী। একপ্রান্তে রামকৃষ্ণ মিশন রোড ও তারাপুরের দিক থেকে ঢাল নেমেছে, অন্যদিকে অনুকুল ঠাকুরের সত্সঙ্গ আশ্রম রোড আর উত্তরে কলেজ রোড ঢালু হয়ে বিবেকানন্দ রোডের সাথে মিশেছে যে তেমাথায়, সেখানে একটি মাছ-সবজির বাজার বসে। আজ সেখানে বিশ বাঁও জলের আনুকূল্যে আর মরা নয়, জ্যান্ত মাছ ধরছে পাড়ার দুঃসাহসী ছেলেরা। সেখান থেকে নৌকোয় বিবেকানন্দ রোডে ঢুকেই বাঁদিকে প্রথমে পড়ল প্রদীপ মন্ডলের বাড়ি। ওর বিয়ের তখনও বর্ষপূর্তি হয় নি, বলতে গেলে হানিমুন কাপল। ওর বাড়িওলা জানালেন, কাল রাতে জল বাড়তে দেখেই প্রদীপ আজ ভোরে সস্ত্রীক এয়ারপোর্ট রওনা হয়ে গেছে, টিকিট পেলেই সোজা কলকাতা। বেচারা, একটা থ্রিলিং হনিমুন অন এ রিভার ক্রুজের চান্স মিস করলো! তার ওপাশের বাড়িতে থাকে আশিস বসাক। হুজুগে মানুষ, একটু ডাকাডাকি করতেই বৌয়ের গজগজানি কর্ণপাত না করে আমাদের 'বজরা'য় এসে বসল।
উল্টোদিকের একটা গলিতে একতলা বেশ বড় একখানা বাড়িতে স্বপন দাস থাকে বউ-বাচ্চা ও বাবা-মাকে নিয়ে। ওদের বাড়ি গিয়ে দেখি একতলার অর্ধেকের উপর জলের তলায়। ওরা গেল কোথায়? তখনই যেন স্বর্গ থেকে দৈববাণী হলো- 'নৌকোর মুখটা সোজা সিঁড়িঘরে ঢুকিয়ে দে'। ওপরে তাকিয়ে দেখি স্বপন নির্দেশ দিচ্ছে ছাদ থেকে। অগত্যা সেইভাবেই সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে এলাম।
স্বপনদের ছাদের উপরে এসে দেখি এলাহী কান্ড! তিনখানা তাঁবু পাতা হয়েছে বিশাল ছাদ জুড়ে। তার একটাতে তিন পরিবারের বারোয়ারী রান্না চড়েছে, খিচুড়ি আর ইলিশের ঝাল। পাওয়ার নেই বটে, তবে স্ট্যান্ড-বাই জেনারেটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেশ পিকনিকের মেজাজ।ইতিমধ্যে বাড়িওয়ালার বড়ছেলে সাইকেলে করে গোটা চার-পাঁচ ভিডিও ক্যাসেট নিয়ে এলো, রাতের খোরাক হিসেবে। রিমি আর স্বপন খেয়ে যাবার জন্যে অনুরোধ করছিল বার বার, লোভ যে হয়নি তাও নয়, কিন্তু আমরা তো কেউ একা নই, তাছাড়া বাসায় খবর যে পাঠাব, তখন এমন ঘরে ঘরে ফোন ছিলনা, মোবাইল তো দুরের কথা। অগত্যা সবিনয়ে তাদের প্রত্যাখ্যান করতে হল। মেসোমশাই অবশ্য অন্য একটা লোভ দেখাচ্ছিলেন। আমি থাকলে চারজন পার্টনার হয়ে যেত আর তাহলে বেশ ব্রিজ খেলা যেত খেয়ে-দেয়ে। কদিনের রসদ আর কদিনেরই বা আনন্দ! তবু ওদের মানিয়ে নেওয়া দেখে বেশ ভাল লাগলো। চা আর পকোড়ি খেয়ে ওখান থেকে বিদায় নিলাম।
'আজকের মত অনেক ঘোরা হল', এই বলে গৌরী আমাকে আর বসাককে যথাস্থানে নামিয়ে দিয়ে নৌকো নিয়ে মালুগ্রামে নিজের বাসায় রওনা দিল। আমার বাড়ির উল্টোদিকের দোতলা বিল্ডিংটা হল সরকারী বন্যা-নিয়ন্ত্রণ বিভাগের আঞ্চলিক হেড অফিস। দেখি সেখানে আলোর মালা সাজানো হচ্ছে। ওদের ইলেকট্রিসিয়ান দত্তগুপ্ত তদারকি করছে। জিজ্ঞেস করলাম- 'কি ভাই, আপনাদের এখন পৌষমাস নাকি?' ব্যঙ্গের খোঁচাটুকু মাঠে মারা গেল। উত্তর পেলাম- 'না দাদা, আমরার এনুয়াল ডে হইত আজ সৈন্ধায়, আইয়েন নিশ্চয়'।
এই বন্যা নিয়ন্ত্রণ অফিসটি বরাক-অববাহিকায় বন্যা প্রতিরোধ ও তত্কালীন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছিল কয়েকবছর আগে। কিন্তু দেখা গেল প্র্যাকটিক্যালি সেটি হয়ে দাঁড়িয়েছে 'বন্যা-আমন্ত্রণ বিভাগ' আর সেটা যে অমূলক নয় বন্যার সময় কর্মচারীদের মুখ-চোখের উদ্দীপ্ত ভাব থেকেই তা বোঝা যেত। ৯১-৯৩-৯৪ এর ক্রমবর্ধমান বন্যার থেকে শিক্ষা নিয়ে শুনেছি নাকি ১৯৯৫ সালে এই অফিসটি তুলে দেওয়া হয়। আমি শিলচরের পাট উঠিয়ে বদলি হয়ে পন্ডিচেরি চলে আসি ১৯৯৪-এ। বন্ধুদের মুখে শুনেছি তার পরে নাকি বরাকে তেমন উল্লেখনীয় বন্যা আসেনি- আজ পর্যন্ত !

(শেষ)

Saturday, July 25, 2015

New: Translated rhyme- Bengali to Hindi

New: Translated rhyme- Bengali to Hindi

"मान न मान"
सुकुमार रॉय  

सुनरे भैया गांव में मेरे ऐसा आदमी दीखा,
खाते समय वह दाल-चावल को मुंह के अंदर फेंका।   
सुना है उसे भूख भी लगती दिनभर जो न खाएं,  
आँखें बंद हो अपने आप ही नींद जैसे आये।  
चलते समय दो पैर उसके पड़ते हैं धरती पे, 
आँखों से वह देखता है सब, सुनता है कानों से।
मान न मान, वह सोता है सर सिरहाने पे रखके 
 ऐसा भी होता है क्या भला, चल आते हैं देखके!   

(मेरा अनुवाद, मूल बंगाली से)

"আরে ছি ছি রাম রাম কলকেতা শহরে
লাল ধুতি পরে মুদি তিন হাত বহরে।
মখমলে জামা গায় ঝকঝকে টোপরে,
খায় দায় গান গায় রাস্তার ওপরে।"

(সুকুমার রায়)


अरे छी छी राम राम का कहूँ रे भैया
कोलकाता जाके देखा हमार रमैया ।
मख़मली लाल धोती-कुर्ता टोपी सर पे
खाए-पिए-नाचे-गाये सड़कवा के मोड़ पे!


"কহ ভাই কহরে, আঁকাচোরা শহরে
বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না?
লেখা আছে কাগজে, আলু খেলে মগজে
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে, বুদ্ধি গজায় না।"
(সুকুমার রায়)


जानते हो मेरे भाई, जाके देखा मुंबई
वहां के हकीम कोई आलू नहीं खाता है!
लिखा है किताबों में, आलू से खोपड़ी में
दिमाग न उपजे रे, भेजा सुख जाता है ।



क्या कहूं मैं गया था हुगली
किसी से ना यह कहना,
दीखा मुझे तीन ऐसे सूअर
टोपी न किसीने पहना!



खामखा कुत्ते क्यों चिल्लाएं रात भर-
दांत के कीड़े रहे न टूटे दांत पर?
किसकी गलती से है पृथ्वी के दबे सर?
चल यार सोचते हैं छाओं में बैठकर !
(सुकुमार रॉय)
Original in Bengali:
'কেন সব কুকুরগুলো খামখা চেঁচায় রাতে-
কেন বল দাঁতের পোকা থাকেনা ফোক্‌লা দাঁতে?
পৃথিবীর চ্যাপ্টা মাথা কেন, সে কাদের দোষে?
এসো ভাই চিন্তা করি দুজনে ছায়ায় বসে ।'


पता क्या कह गया सीताराम मेहता-
आसमाँ मंहके जैसा खट्टा सा रायता ।
खटाई रहती नहीं, होने पर वर्षा,
चखकर देखा तब मीठा शक्कर सा ।


ए बकरी का बच्चा,
तू उडने काहे को चला?
पंख कहाँ रे तेरे -
कूदता-फिरता क्यों भला !


नन्द घोष की काली गाय भाग के गयी कहाँ-
गाँव-मुहल्ला नन्द घूमे, खोजता सारा जहाँ।
आधी रात को बेखबर
लौट अधमरा सा थककर,
अपने आंगन पहुँचके देखा गाय सोयी है वहाँ।


आसमान में सात रंगों के इन्द्रधनुष खिले बेजोड़
कितने लोग देखने को आये सारे काम काज को छोड़.
एक था बुड्ढा भला किसीका न देखे वह आदत से-
कहने लगा- 'रंग कच्चा है, टिकाऊ नहीं, पूछो मुझसे!'

जंगला गांव का पगला बुड्ढा मुझसे आकर उलझे,
ढाई बिघाभर समुन्दर में कटहल कितने उपजे?
मैंने भी कहा उसी अंदाज़ में सच कहूँ मैं कितने-
एक एकड़ मूली के खेत में झींगा फले हैं जितने।

आंगन में रक्खा था डब्बा, खीर था उसमें पड़ा,
कौए ने उसके लिए बूढे से जोर का लड़ा। 
जीत लड़ाई खुशी से कौए ने मुड़कर देखा क्या-
जाने कब खीर साफ कर गयी छोटी सी एक चिड़िया।   

बुड्ढे तुम हो आदमी अच्छे,
दिल से भी लगते हो सच्चे,
फिर भी क्यों तुम मुझे पसन्द आते नहीं?
कारण इसका मुझे क्या पता
सोचूं भी तो समझ न आता 
वजह न कोई तो भी दिल भाते नहीं।

Friday, July 24, 2015

Translation- Bengali to Hindi

"কহ ভাই কহরে, আঁকাচোরা শহরে
বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না?
লেখা আছে কাগজে, আলু খেলে মগজে
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে, বুদ্ধি গজায় না।"
(সুকুমার রায়)


जानते हो मेरे भाई, जाके देखा मुंबई
वहां के हकीम कोई आलू नहीं खाता है!
लिखा है किताबों में, आलू से खोपड़ी में
दिमाग न उपजे रे, भेजा सुख जाता है ।

(सुकुमाय रॉय)

"আরে ছি ছি রাম রাম কলকেতা শহরে
লাল ধুতি পরে মুদি তিন হাত বহরে।
মখমলে জামা গায় ঝকঝকে টোপরে,
খায় দায় গান গায় রাস্তার ওপরে।"

(সুকুমার রায়)


अरे छी छी राम राम का कहूँ रे भैया
कलकत्ते में जाके देखा हमार रमैया ।
लाल धोती मलमल के कुर्ता-टोपी डालकर
खाए-पिए-नाचे-गाये सड़कवा के मोड़ पर !



Tuesday, July 14, 2015

Bengali Short Story- কুবের, কন্দর্প ও কোয়টাস ।।

কুবের, কন্দর্প ও কোয়টাস ।।

(১)

'কোয়টাস !!'
কথাটা শুনে একটু অস্বস্তি নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকান সুন্দরমূর্তি। হ্যাঁ, ইনি সেই বিখ্যাত টেকনোসিস কোম্পানির মালিক ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মি: সুন্দরমূর্তি আয়ারই বটেন। কথা হচ্ছিল তাঁর সফটওয়ের বিভাগের মাথা দুর্দান্ত প্রতিভাবান হ্যান্ডসাম যুবক অনঙ্গ দেশাইয়ের সাথে। ছেলেটিকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। এই বয়েসেই যা সব ইনোভেটিভ গ্যাজেট তৈরী করে দুনিয়ার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে, তাতে তিনি অনঙ্গকে তাঁর কোম্পানির আদর্শ উত্তরাধিকারী রূপে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। অপুত্রক ও বিপত্নীক তিনি। নিজের বলতে একমাত্র কন্যা মালিনী। তিনি তো অনঙ্গকে বেশ কয়েকদিন ধরে চোখে চোখে রাখছেন, এখন তাঁর মেয়েটির এদিকে একটু নজর পড়তেই যা বাকি।

না, মেয়ে তাঁর পাগল বা কুরূপা নয়। টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট নিয়ে রীতিমত পড়াশুনা করে এসেছে আমেরিকা থেকে। এখন বাবার সাথে অফিসে বসে হাতে-কলমে কাজ শিখছে। আয়ার সাহেবের ইচ্ছে আছে মেয়ের বিয়ে দিয়ে মেয়ে জামাইকে একত্রে নিজের কোম্পানির দায়িত্ব ধরিয়ে দেন। কিন্তু মেয়ে তার কথায় আমল দিলে তো! তার নেশা মোবাইলে বসে শুধু বন্ধুদের সাথে হোয়াটস-অ্যাপ বা গুগলে চ্যাট করা। তাই বলে ভাববেন না যে সে তাদের কারো সাথে প্রেম করে। মালিনী হয়ত তার অর্ধেক বন্ধুর দিকে মুখ তুলে তাকায়ইনি কখনো। তাই এই মা-মরা মেয়েটিকে নিয়ে মি: আয়ারের চিন্তা হওয়ারই কথা। তবে এই অনঙ্গ ছেলেটিকে তিনি ছাড়তে রাজী নন। আপাত নির্লোভ আর সচ্চরিত্র হলেও যে কোনও চ্যালেঞ্জ নেওয়ার হিম্মত আছে অনঙ্গের। তাই অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা জয়ের একটা চ্যালেঞ্জের আভাস দিয়ে তাকে আটকে রেখেছেন কোনমতে, নইলে বিদেশী কোম্পানিগুলো তো ওকে লোফার জন্যে হাত উঁচু করেই আছে। তাই কিছুটা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য নিয়েই জানুয়ারি মাসের এক সুন্দর সকালে অনঙ্গকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর অফিসে মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে। কিন্তু হবু জামাই যে প্রথমেই 'কোয়টাস' বা যৌন-সঙ্গম জাতীয় কিছু একটা বলে বসবে সেকথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

'স্যার, আপনি যা ভাবছেন তা নয়', মিঃ আয়ারকে ভ্যাবাচ্যাকা খেতে দেখে এবার অনঙ্গের ব্যাখ্যা করার পালা, 'কোয়টাস একটা এপ্লিকেশন সফটওয়্যার, যার পুরো নাম 'ক্লোজার অফ ইন্টারনেট টেলিকম ইউজার্স সফটওয়্যারস' (Closure Of Internet Telecom Users' Softwares), যা বিশেষ ধরনের স্মার্ট ফোনের সাহায্যে ব্যবহার করা যায়। প্লিজ, এ ব্যাপারে এখন আর কিছু জানতে চাইবেন না, এখন এটা এক্সপেরিমেন্টাল স্টেজে আছে'।
'তবু ব্যাপারটা কি একটু বলবে তো, না কি নিজস্ব পেটেন্ট নিতে চাইছ?' একটু রসিকতার ছলেই বললেন আয়ার। তাঁর বিশ্বাস আছে ছেলেটির উপর।
'স্যার, এই টেকনোলজির যুগে মানুষ যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলো হারিয়ে ফেলতে বসেছে- যার জন্যে আজ পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোর জনসংখ্যা কমতে কমতে এলার্মিং অবস্থায় ঠেকেছে এসে, তার বিরুদ্ধে কাজ করবে এই অ্যাপ। এবার আপনি শুধু বলুন, মিস মালিনী সম্বন্ধে আপনার প্ল্যানটা কি? বাকি কাজটুকু আমার উপর ছেড়ে দিন।'

'দাঁড়াও, একটু ভাবা দরকার। তুমি বরং লাঞ্চের পর একবার এস।'

অনঙ্গ চলে গেলে এসি বন্ধ করে অফিসের জানালাটা খুলে দিলেন মিঃ আয়ার। অন্য আইটি ও কম্প্যুটার কোম্পানীগুলোর থেকে কিছুটা তফাৎ রেখেই বছর দশেক আগে এখানে হেড অফিস বানিয়েছিলেন তিনি, তখন শহরের প্রায় বাইরে ইয়ালাহাঙ্কাতে। স্যাটেলাইট টাউনশিপের ৩ নং ক্রশ রোডের এই অফিসের জানালায় দাঁড়ালে দেখা যায় নয় নম্বর জাতীয় সড়ক আর নিউ টাউন মেন রোডের শৃঙ্খলাবদ্ধ গাড়ির মিছিল, গ্রেটার বাঙ্গালোর ম্যুনিসিপাল কর্পোরেশনের তত্বাবধানে যার মধ্যে কোন ত্রুটি পাওয়াই ভার। যার ফলে তিনি মাল্লেশ্বরমে নিজের বাড়ি যাবার জন্যে নয় নম্বর হাইওয়ে না ধরে এ পথেই যাওয়া আসা করেন। নতুন এয়ারপোর্টটাও কাছে পড়ে। এখন ত পুরনো আই-টি পার্কের মালিকরা রীতিমত হিংসে করে তাঁকে আর মনে মনে তারিফ করে দূরদর্শিতার জন্যে। তবে মিঃ আয়ার জানেন যে হেড অফিসের অবস্থানের সাথে কোম্পানীর উন্নতির কোনও সম্বন্ধ নেই, তার জন্যে অনং নামের এই রত্নটিকে বেঁধে রাখতে হবে। কিন্ত কিভাবে? জানলার বাইরে তিন নম্বর ক্রস রোডে কি আছে এই সমস্যার সমাধান? তিনি চিন্তিতমনে মোবাইলে একের পর এক নম্বর ডায়াল করতে লাগলেন। তারপর একসময় টিফিন বাক্স বের করে হাল্কা লাঞ্চ সেরে নিলেন।

 
লাঞ্চ আওয়ারের পর অনঙ্গ এল দেখা করতে। তবে তারপর প্রায় আধঘন্টা ধরে ইয়ালাহাঙ্কার অফিসে বসে বাঙ্গালুরু সিলিকন সাম্রাজ্যের একজন অধীশ্বর আর তাঁর কোম্পানির 'মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলার'এর মধ্যে কি কথা হল তা আমরা কেউ কিছুই জানতে পারলাম না।



(২)

১৪ই ফেব্রুয়ারির বিকেল পাঁচটায় মি: আয়ার মেয়েকে নিজের অফিসঘরে ডেকে বললেন, 'মা, আমি আজ ইউনিয়ানের মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকব, ফিরতে অনেক রাত্রি হবে। তুই বরং অনঙ্গের সাথে অফিসের গাড়িটাতে করে চলে যা, ওকে মাল্লেশ্বরমে ড্রপ করে দিস। মেয়ে বাবাকে চেনে, তাই আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে চলে গেল অনঙ্গের অফিসের দিকে।

সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে ওরা দুজনে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে বাইরে আসতেই দেখে তিন নম্বর ক্রস রোড থেকে নিউ টাউন মেন রোডের রাস্তায় সবকটা গাড়ি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। সাধারণত: এ সময়টা একটু জ্যাম হয়, তা বলে এত। গাড়ি তো গেট ছেড়ে নড়তেই পারছে না। বাঁদিকে ঘুরতে পারলে একটা না একটা রেডিয়াল রোড অনায়াসে ধরা যায়, কিন্তু গাড়ি এগোলে তো! ড্রাইভার যথেষ্ট অভিজ্ঞ, সে পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয় স্যার, এখন ঘন্টা দুই মনে হচ্ছে বাঁদিকে এগোনো যাবে না, চলুন বরং ডানদিকে ঘুরে হাইওয়ে ধরি। কিন্তু সেখানেও বিপদ। শেষাদ্রিপুরম কলেজের কাছে এসে আর গাড়ি এগোয় না, এত ট্র্যাফিক। শেষে যেন কিছুটা নিরুপায় হয়েই অনঙ্গ বলল, 'ম্যাম, এখন আর গাড়িতে বসে কি হবে, চলুন সামনের সি-সি-ডি'তে গিয়ে ততক্ষণ আসল কলোম্বিয়ান কফির স্বাদ নিয়ে আসি'। 'চলুন', অনিচ্ছাসত্ত্বেই বলল মালিনী, তার চোখ তখনও মোবাইলের দিকে।

ওরা দুজনে কাফেতে গিয়ে বসেই আছে, যেন একে অপরকে চেনেই না। মালিনী নিবিষ্টমনে ফোন নিয়ে হোয়াটস-অ্যাপে চ্যাট করছে আর অনঙ্গ ওকে একমনে দেখে যাচ্ছে। ইস, এমনিভাবে যদি মালিনী ওকে দেখত! কনভেন্ট পড়া মেয়ে, নিশ্চয়ই অনঙ্গ কথাটার মানে জানে না। হঠাৎ কি খেয়াল হওয়ায় নিজের স্মার্টফোন বের করলো অনঙ্গ। 'এ কি এসময় নেট চলে গেল যে' - অবাক হয়ে বলল মালিনী। 'আমার তো সাবস্ক্রাইবার কানেকশন, সিটি ওয়াই-ফাই তো নয়!'
'আপনি বসুন, ম্যাম, আমি দেখছি, এদের ওয়াই-ফাই আছে কিনা', বলে উঠল অনঙ্গ।
'আপনি বসুন তো', এতক্ষণে বোধহয় মুখ তুলে তাকাল মালিনী অনঙ্গের দিকে। আরে, বেশ হ্যান্ডসাম ছেলেটি তো, নম্র, ভদ্রও বটে। 'কি ম্যাম ম্যাম করছেন তখন থেকে? আমার নাম মালিনী, আমি আপনার থেকে অনেক ছোট। এত তাড়া কিসের, নাহয় কিছুক্ষণ গল্পই করলে আমার সাথে', হাত ধরে টেনে ওকে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিল মালিনী। তারপরে ঘণ্টা দুয়েক যে কিভাবে কোথা থেকে কেটে গেল, কেউই তা টের পেল না। একে ত জেট-সাইবার যুগের ছেলেমেয়ে, তার উপরে ভ্যালেন্টাইনের সন্ধ্যা, কখন, কোথায়, কি হয়ে যায় তা কে জানে। রবি ঠাকুরের আমলে এই দিনটি থাকলে মনের কথাটি তারে বলার জন্যে আর ঘনঘোর বরষার অপেক্ষা না করলেও চলত।

পরদিন সকাল সকাল মিঃ আয়ারের চেম্বারে অনঙ্গ, সঙ্গে মালিনী, এই প্রথম একসাথে। 'স্যার, কনগ্রাচুলেট মি, স্যরি, মানে আমাদের দুজনকেই আশীর্বাদ করুন। আমরা সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আদর্শে দীক্ষা নিয়েছি গতকাল'। অনঙ্গ বলল । 'বাকি কাজটা এবার আপনার হাতে'। আনন্দ ও বেদনার যুগপৎ অনুভবে মিঃ আয়ারের মন ভরে উঠল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার থেকে।
'আমি আজ দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী বাবা', মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন মি: সুন্দরমূর্তি আয়ার। একফাঁকে একটু চোখ টিপে দিলেন অনঙ্গের দিকে তাকিয়ে।

ওরা দুজনে চলে গেল। এখন অনেক কাজ মি: আয়ারের। চিন্তা কি ছিল না! রেডিয়াল আর ক্রশ রোডের নেটওয়ার্ক দিয়ে ইয়েলাহাঙ্কা সার্কেলের প্ল্যানটাই এমনভাবে করেছে বাঙ্গালুরু কর্পোরেশন যে বিজিয়েস্ট আওয়ারেও কখনো জ্যাম হয় না। কাল সেটাও সম্ভব হয়েছে। সুতরাং আয়ার সাহেবের প্রথম কাজ হল ডি সি ট্রাফিকের বাসায় অন্তত: পাঁচলাখ টাকার একটা তোফা পাঠান- অবশ্যই অতি গোপনে, গতকাল তিন নম্বরের মুখ থেকে সবকটা ট্রাফিক পুলিশকে ঠিক সময়ে ঘন্টা তিনেকের জন্যে তুলে নেবার জন্যে। তারপর ক্যাফে কফি ডে'র ম্যানেজারকে হাজার দশেক, সার্ভিং-এ দেরী করানোর জন্যে। ড্রাইভারকে তার সুন্দর অভিনয়ের জন্যে একটা স্পেশ্যাল বোনাস দেওয়া যেতেই পারে, ব্যাটা এক্সপার্ট হয়েও বলে কিনা এগোনো যাবে না হুজুর!

আর অনঙ্গকে- তার 'কোয়টাস' এর জন্যে? তা আর বলতে! সে ছোঁড়াই তো সবচেয়ে বড় দাঁওখানা মারলো। তাহলে কুবের আর কন্দর্পের খেলায় জিতল কে? ছি ছি, জিতল কিনা একটা সফটওয়ার, যার কোনও ভূমিকা থাকারই কথা নয় এখানে!

Kuwait, 13th April, 2015.

Bengali Poem- Translated from Hindi- বসন্ত


वसंत

अखबार में नहीं छपता की वसंत आया
छपती हैं दंगे, कर्फ्यू और हिंसा की वारदातें.
अखबार में नहीं छपती तस्वीर खिले फूल की
छपती हैं तस्वीर जलते मकानों से उठते काले धुंए की.
वसंत की कहीं कोई चर्चा नहीं
वह चुपचाप आया है....
सूखी बिफरती हवाओं के बीच
कर रहा है इंतज़ार.
पुराने ज़र्द पत्तों के झरने का
नन्ही-सी कोंपल के उग कर
हरा बन जाने का.
कभी किसी दिन
चर्चा में आने का.
खूबसूरत खबर बन जाने का!

-अनीता प्रकाश

বসন্ত



কাগজে ছাপেনা বার্তা বসন্ত আসার
ছাপে যত তাণ্ডব ও দাঙ্গার খবর,
হিংসা-কার্ফু-মারামারি সংবাদ অসার
জীবন্ত লাশের কথা, সুখের কবর ।

কখনও ছাপেনা ছবি প্রস্ফুটিত ফুল
কোকিল-কূজিত-কুঞ্জ শুধু কি স্বপন?
বিষের ধোঁয়ায় ঝরে অস্ফুট মুকুল
বিষণ্ন বেহালা গাহে মৃত্যু-আলাপন ।

বসন্তের কথা হায়, কেউ তো বলেনা!
নিঃশব্দ-চরণপাতে এসে তরুমূলে,
রবে প্রতীক্ষায় কবে বর্ণহীন হেনা
ভিক্ষুবেশে দাঁড়াবে দু-বাহু অগ্রে মেলে ।

রিক্ত সহকার হবে পুনঃ মুকুলিতা
পলাশ-শিমূল বনে হবে হোলিখেলা,
বার্তাবহ ভ্রমরই তো জানাবে সে কথা
আকাশের গায়ে লেখা রবে দুই বেলা ।

অনুবাদঃ পল্লব চট্টোপাধ্যায়

Bengali Poem- ফলাফল ।

ফলাফল

আম মানে বারোয়ারী, বেল কভু হয় ফুল
জল যদি না ও পাই, জলপাই নয় ভুল;
কলাটি শিল্প যথা, বংশ যেমন কুল,
জামের শাসনকেই বলা হয় 'জামরুল'!!

দাড়ি যদি নাও পাকে, দাড়িম্ব বলি তাকে
না হয় বেদানা বল, দানা তো অনেক থাকে,
পেয়ারা মিষ্টি ফল, গুজরাতে 'জাম' ডাকে
আতাগাছে দেখেছ কি তোতা বসে ঝাঁকে ঝাঁকে?

কামের রঙেতে রাঙ্গা, কামরাঙ্গা টক তাই,
আমড়া ও আমলকি তাদেরি ভায়রাভাই।
আনা-দরে আনারস কত যেন কিনে খাই!
চালতা ও তেঁতুলের চাটনি কোথায় পাই?

এই রোদে মুসম্বি-কমলা খাও অঢেল,
জল নেই খালে-বিলে, আছে ডাব-নারকেল।
কপিত্থ-বিল্বকে, মোরা বলি কত-বেল;
দেখেছ কাঁঠাল গাছে? গোঁফেতে লাগাও তেল।

- পল্লব চট্টোপাধ্যায় ২৬ মে, ২০১৫।

Light Comedy- Bengali

নীচের লেখাটা একটা জোকের গ্রুপে পোস্ট করেছিলাম। সেখানে যখন লোকের ভাল লেগেছে, 'আড্ডা'র বন্ধুরা আশা করি এটা পড়বেন।
" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মমাস বৈশাখ। অনেকে অনেক রকম চর্চা করছে তাঁর সম্বন্ধে। আমি একটা নতুন তথ্য পেলাম, সবাইকে না জানিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। গান্ধীজী, চিত্তরঞ্জন ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সাথে ওনার ঘনিষ্ঠতার কথা প্রায় সবাই জানে। তবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যে তাঁর বন্ধু ছিলেন সেটা সম্প্রতি জানা গেল। একটা গানে আছে-
"তব নন্দনবন-অঙ্গনদ্বারে, মনোমোহন বন্ধু-
আকুল প্রাণে পারিজাতমালা সুগন্ধ হানে।।"

কোনও একসময় মনমোহন হয়ত রবি ঠাকুরের রুমমেট ছিলেন, রোজ সকালে মর্নিং-ওয়াক করতেন একসাথে! বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে কি কবিগুরু শুধু শুধুই লিখে গেছেন-
"মনোমোহন, গহন যামিনীশেষে
দিলে আমারে জাগায়ে।।"
শুধু কি তাই? কখনও কখনো এমনিতে ঘুম না ভাঙলে সেতার বা সরোদ বাজিয়েও শোনাতেন মনমোহন। তারও প্রমাণ আছে, আমি বিনা প্রমাণে কিছু বলি না-
"কী রাগিনী বাজালে হৃদয়ে, মোহন, মনোমোহন,
তাহা তুমি জান হে, তুমি জান।।"
উপরোক্ত গানের এই মোহনটি কে তা নিয়ে আমাদের একটু সংশয় আছে। ইনি কি মোহনদাস গান্ধী না মনোমোহনেরই ডাকনাম? এ নিয়ে ভবিষ্যতে কিছু রিসার্চ করা যাবে, কেমন?"

Bengali Poem- কোনিক

কোনিক ।।


আমি ছিলাম একটি বিন্দুর সঞ্চারপথ।
জীবনের কেন্দ্রে ছিল আর একটি বিন্দু, তিনিই বুঝি ঈশ্বর!
অর্ধেক জীবন আবর্তনে কেটে গেল,
ঈশ্বরের থেকে আমার দূরত্ব কিন্তু একই রয়ে গেল।

তারপর কেন্দ্রবিন্দু হল দুখানা, নাম দিলাম ফোকাস
দুটি রেখা, তাদেরকে বলা হল ডাইরেক্‌ট্রিক্স ।
ধর্মের চেয়ে আমি ঈশ্বরের বেশী কাছে এসেছি
দুই ঈশ্বরকে সূর্য মনে করে প্রদক্ষিণ করে চলেছি
এক উপবৃত্তীয় পথে। বুঝতে পারি না,
কোনটা জীবনের ধর্ম, আর কোনটা পাপ-পুণ্যের ।

তাই শেষে সরিয়ে দিলাম একটি করে বিন্দু ও রেখাকে।
ভাবি বুঝি এবার দেখা মিলবে কাঙ্ক্ষিতের ।
তা হল না, আমি চলতে থাকলাম-
ধর্ম ও ঈশ্বরের সাথে সমান দূরত্ব রেখে।
আমার নতুন নামকরণ হল 'প্যারাবোলা',
ঈশ্বর ও ধর্ম দুইই থাকল অধরা হয়ে।

ক্রমে ঈশ্বর থেকে আমার ব্যবধান বাড়তে থাকে।
নাস্তিকেরা উল্লসিত হতে থাকে-
বিশ্বাসীরা টিটকিরি দেয়্
ঐ যায় 'হাইপারবোলা' বলে।
তাই বুঝি আমি অনন্তেই মিলিয়ে গেলাম,
আর কখনও ফিরব না, মিলব না কারো সাথে।
কেউ কি পেয়েছ খুঁজে কেন্দ্রাভিমুখী পথটিকে?
আমায় তার ঠিকানা দিতে পার?

মুম্বাই, ১১ই মে, ২০১৫

Bengali Story- সবটা মোটেও গল্প না

সবটা মোটেও গল্প না (১)

রাজ্যারোহনের সাঁইত্রিশ বছর পরে প্রভাস থেকে খবর এল যে পাণ্ডবদের মামাতো ভাই আর পরম শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু কৃষ্ণ-বলরাম দুজনেই দেহরক্ষা করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘আর কেন ভাইসব, অনেক তো রাজ্যভোগ হল, চল এবার আমরাও যাই। সত্যি বলতে কি, কৌরবরা নেই, জরাসন্ধ-শিশুপাল-কীচকের মত বীরও আর দেখা যায় না। যুদ্ধ কার সাথে করি আর এই ঐশ্বর্য দেখাই বা কাকে! তা তোমার কি মত, বৃকোদর।‘ ভীম বসে থেকে থেকে আর রাজভোগ খেয়ে পেল্লায় একটি ভুঁড়ি বানিয়েছেন এতদিনে। তিনি পেটে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘দাদা, ইচ্ছে ছিল কেসি দাস বা হলদিরামের মত একটা জমাটি দোকান খুলে বসি হস্তিনাপুরে, তা আর হল না। আগ্রা থেকে আনানো পঞ্ছীর মোরব্বা খেয়ে সন্তুষ্ট থাকার চেয়ে মনে হয় স্বর্গে যাওয়াই ভাল। শুনেছি ওখানকার পারিজাতের মধু থেকে তৈরি মাধ্বী নাকি দারুন, একবার চেখে দেখতেই হচ্ছে!’
অর্জুন অবাক। ‘বল কি মেজদা, তুমি এখনও ওসব ছাইপাঁশ হজম করতে পার? আমার তো অম্লশূল শুরু হয়েছে। স্বর্গবৈদ্য অশ্বিনীকুমারদের ছেলে মানে আমাদের ছোট ভাই নকুল-সহদেবের তৈরি ক্ষারক-চূর্ণ না থাকলে এমনিতেই আমার স্বর্গপ্রাপ্তি হত। তা, বড়দা যখন বলছেন, আমার আপত্তি নেই। তবে হ্যাঁ, দ্রৌপদীকে ছেড়ে আমি কোথাও নড়ছি নে।‘ নকুল তো বরাবরই চুপচাপ। আর পাশাখেলার সময় দ্রৌপদীর অপমান দেখে সহদেব একবার চিৎকার করে উঠেছিলেন, সেই তাঁর শেষ প্রতিবাদ। দ্রৌপদী আড়াল থেকে সব শুনছিলেন। তিনি মহা উৎসাহে চুল বাঁধতে গেলেন। তারপর অর্জুনের নাতি পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে বসিয়ে শুভদিন দেখে একদিন পাঁচভাই-বৌ মিলে রওনা হয়ে গেলেন মহাপ্রস্থানের পথে। সে পথের বর্ণনা তো মহাভারতেই ভাল আছে, তাই তার আর পুনরাবৃত্তি করলাম না, আমাদের গল্প তাই নিয়ে যা মহাভারতে নেই।
(২)
পাণ্ডবরা হস্তিনাপুর থেকে হিমালয়ের পথ ধরলেন। ভীমের ইচ্ছেয় পাণ্ডবরা ভীমদত্ত, পশুপতিনগর হয়ে কৈলাস-মানসের পথ ধরলেন। এই ভীমদত্ত একসময় বৃকোদর ভীমের রাজত্ব ছিল। জতুগৃহ পুড়ে যাবার পর পাণ্ডবরা যখন চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় কুমায়ূন অঞ্চলের উপজাতীয় রাক্ষসবংশীয় সর্দার হাড়িম্বকে ঘটনাচক্রে মেরে তাঁর বোন হাড়িম্বাকে বিয়ে করেছিলেন ভীম। তারপর বছরখানেক সেই অঞ্চলেই থেকে রাজত্ব চালান তিনি। পুত্র ঘটোৎকচের জন্মের পর হাড়িম্বা(তিনি আদর করে বলতেন হিড়িম্বা, আমরাও তাই বলব)কে রাজ্যভার দিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন ভাইদের কাছে। রুদ্রপুর পেরিয়েই ভীমের রাজ্য শুরু হল। পথে পড়ল ভীমতাল সরোবর, যেটা তিনি পাহাড়ের একদিক থেকে বেঁধে জল ধরে রাখার জন্যে তৈরি করিয়েছিলেন। সেখানে স্নানাদি সেরে তাঁরা ভীমদত্ত শহরে এসে হিড়িম্বার দেখা পেলেন।
হিড়িম্বা তো ভীমকে কিছুতেই ছাড়বেন না। মহাপ্রস্থানে যাবার জেদ ধরে বসে আছেন। ‘কৃষ্ণাদি যেতে পারে, আর আমি গেলেই দোষ! কেন, দিদি কি আমার চেয়ে বেশি ফর্সা? আমি পাহাড়ি মেয়ে, তোমাদের থেকে ভাল এসব পারি, তা জান? নন্দনকাননের রাস্তা চেন তোমরা?’ অনেক কষ্টে, অনেক ভুজুং-ভাজাং দিয়ে তাঁকে কাটান হল। তিনি কচি মোষের কলজে ভাজা অনেকটা আর সেই সাথে সেদ্ধ-ভুট্টা গেঁজানো মদ দিতে চেয়েছিলেন সাথে, শরীর গরম থাকবে বলে। ‘আমরা তো মরতেই যাচ্ছি, তার আগে কি ওই ছাই-পাঁশগুলো না খেলেই নয়’, এই বলে অর্জুন কাটিয়ে দিলেন। ওঁরা এগিয়ে গেলেন। ‘মন দিয়ে প্রজাদের দেখাশুনো কর, আর খুব ক্ষিদে না পেলে তাদের মাংস খেয়ো না’ এই উপদেশ দিয়ে ভীম ভাইদের পিছু নিলেন। গোয়ালা দুধ দিতে এসেছিল, রাগের চোটে তাকেই ফুটন্ত দুধের মধ্যে ফেলে হিড়িম্বা পায়েস বানাতে লেগে গেলেন।
একজালা পায়েস খেয়ে হিড়িম্বার ক্ষুধা আর রাগ মিটলেও তাঁর মন শান্ত হল না। ‘দূর ছাই’ বলে তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে উলটোপথে হাঁটা দিলেন ও বেশ কদিন পরে ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় গঙ্গোত্রী-গোমুখে এসে হাজির হলেন। নাম শুনে ভেবেছিলেন, বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট কিছু গোবৎস পাওয়া যাবে সেখানে, পেট ভরে খাওয়া জুটবে বহুদিন পরে। কিন্তু দেখলেন কি? গরুর হাঁ-এর মত একটা গুহা, সেখান থেকে ভীষণ বেগে বেরিয়ে আসছে বরফ-জলের স্রোত, আর তার পাশেই এক ছাগল-দাড়িওলা মুনিঠাকুর চোখ বুজে বসে আছেন। হিড়িম্বা ভাবলেন আজ এটাকে দিয়ে জলখাবার খেলে কেমন হয়! বেচারা, তিনি কি করে জানবেন যে ঐ মুনিঠাকুরটি আর কেউ নন, মানুষে তাড়ানো দেবতায় খেদানো পরম নাস্তিক জাবালি ঋষি।
(৩)
জাবালি মুনির পরিচয় কিছু দিতে হবে কি? তিনি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছিলেন, বিধিমত পৈতেও হয়েছিল। তারপর অন্য মুনি-ঋষিদের মত একজায়গায় বসে ধ্যান-টান করার বদলে দুনিয়ার সারসত্যটা জানার তাঁর খুব ইচ্ছে হল। ঈশ্বর বলে কেউ আছে কিনা, থাকলেও তাঁর বাসা কোথায়, দেবতারা কি অমর, তাঁরা কি সত্যিই ভগবান? স্বর্গ-নরক কোথায়, আত্মা কি বস্তু, পুনর্জন্ম সত্যি আছে কিনা এসব প্রশ্ন সবাইকে শুধিয়ে বেড়াতে লাগলেন। লোকে বিরক্ত হয়, আরে বাবা ব্যাদ পড় না কেন, ব্যাদেই তো সব পাবে, তাঁরা বোঝান। কিন্তু উনি দেখলেন বেদ মানে স্বতঃসিদ্ধ কিছু ধারণা মাত্র, এগুলো সব সত্যি বলে মেনে নিয়েই তা লেখা হয়েছে, আসলে তার কোন প্রমাণ নেই। ব্রাহ্মন, আরণ্যক আর উপনিষদে বেশ সুন্দর সুন্দর কিছু গল্প-গাথা আর শ্লোক আছে, তবে সেগুলো নিছক নীতিশাস্ত্র আর মন্ত্র-তন্ত্র, যদিও কাব্যমাধুর্য তাদের ভালই। তখন উনি খুঁজে খুঁজে দেবতাদের ঠিকানা জোগাড় করে ছদ্মবেশে সব ঘুরে-টুরে দেখে এলেন। তারপর ফিরে এসে পৈতে ছিঁড়ে ফেললেন, আর প্রচার করতে লাগলেন- দেবতা-টেবতা সব ফাঁকিবাজি। একদল ফর্সা লোক, চেহারা ভাল, হিমালয়ের ওপারে কৈলাসপাহাড়ের তলায় মানসসরোবরের তীরে নন্দনকাননে থাকে, তারাই নিজেদেরকে দেবতা বলে। তাদের মধ্যেও জন্মমৃত্যু-আহার-নিদ্রা-মৈথুন সব আছে। ইন্দ্র-অগ্নি-বরুণ এগুলো শুধু তাদের পদনাম, ইন্দ্র মরলে আর একজন ইন্দ্র হয়, বরুণ মরলে তার ছেলে বা অন্য কেউ বরুণ হয়। এঁদের আসলে অস্ত্র-বল আর চাতুর্য যথেষ্ট পরিমাণে আছে, তাই দিয়ে এরা ব্রাহ্মণদের দিয়ে বেদ লিখিয়েছেন আর ক্ষত্রিয়দের দিয়ে ক্রিয়াবিধিগুলো করিয়ে তাতে করে নিজেদের ভাবমূর্তি বজায় রেখে সবার উপরে ছড়ি ঘোরাতে থাকেন। স্বর্গ-নরক বলে মারা যাবার পরে আলাদা করে কিছু নেই, যা আছে তা এই জীবনেই আছে। ভগবান যদি থাকেনও তাঁর সম্বন্ধে মানুষ যা জানে, দেবতারা তার বেশি কিছু জানে না। তাঁর কথা শুনে কেউ কানে আঙুল দিল, কেউ বা ঝাঁটা হাতে তেড়ে এল। দেবতা আর অন্য ঋষিমুনিরা মিলে তাঁকে একঘরে করে দিল।
এই সেই জাবালি মুনি যিনি পিতৃসত্য রক্ষা করতে বনবাসে যাওয়ার সময় রামকে বেশ দামী-দামী উপদেশ দিয়েছিলেন, যেগুলো বাল্মীকিমুনি চক্ষুলজ্জার খাতিরেও বাদ দিতে পারেন নি। উনি পষ্টোভাষায় বলেছিলেন-‘দেখ বাপু, রাজার কাজ হল মন দিয়ে রাজ্যশাসন করা। প্রজা সুখে থাকলেই রাজার সার্থকতা, এই শুধু তার নৈতিক দায়িত্ব। তা না রাম, তুমি চলেছ বনে, কি না পিতৃসত্য পালন করবে। আরে বাবা, ভেবে দেখ কে তোমার মা-বাবা? একটি শুক্রকীট আর একটি ডিম্বানুই তোমার মা, তোমার বাবাও। আর তুমি যেহেতু ক্ষত্রিয়, শত্রুশাসনই তোমার ধর্ম। তুমি রাজা, প্রজারঞ্জনই তোমার কর্ম- এর বাইরে তোমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই। তাছাড়া যে মরেছে তাকে পিণ্ডদান করেই বা কার কি লাভ? মরা মানুষকে যদি তুমি ভাত খাওয়াতে পার তাহলে তো বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়েও আমার খাওয়া-পরার কোন চিন্তা থাকবে না, বৌ আমাকে ঘরে বসেই রোজ খাইয়ে দেবে!‘ রাজা দশরথ যতদিন বেঁচেছিলেন, জাবালির রুজিরুটির কোনও অভাব হয় নি, তিনি মুচকি হেসে সব শুনতেন, তর্কও জুড়তেন মাঝে মাঝে। রাম কিন্তু এসব শুনে চড়াত করে রেগে উঠলেন। তিনি মুনিকে যা নয় তাই বলে গালাগাল দিলেন। পারিষদদলে বলে তার শতগুণ! অগত্যা অন্য মুনিরা তাঁকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে একেবারে সরযূ-গোমতী পার করিয়ে দিয়ে এলেন।
এখন জাবালি কি করেন? হৃষিকেশে গঙ্গাতীরে বসে তিনি আবার বেদ পড়তে শুরু করলেন। ঋষিপত্নী আগেই গত হয়েছেন, ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই, দু-চারটে গাঁজাখোর শিষ্য জুটতেও দেরি হল না। তা একদিন জাবালি ঋগ্বেদে চার্বাক বা চারুবাক বলে এক তার্কিক পণ্ডিতের সম্বন্ধে পড়লেন। কি আশ্চর্য, তিনিও তো সেই একই কথা বলছেন-
‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ
ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য
পুনরাগমনম্‌ কুতঃ।।‘
ইতিমধ্যে পিপ্পলাদ বলে তাঁর একটি শিষ্য জুটেছে। তাকে তিনি মহা উৎসাহে এই নতুন খুঁজে পাওয়া দর্শন বোঝাতে লাগলেন। মাসছয়েক শাস্ত্র-আলোচনার পর তিনি এই নতুন দর্শনটি পিপ্পলাদকে প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে গঙ্গোত্রী ছাড়িয়ে গোমুখে অলকানন্দার তীরে আরাম করছেন, এমন সময় খবর পেলেন শিষ্যটি ব্রাহ্মণ আর ঋষিদের চাপে পড়ে জাবালি-উপনিষদ নামে একখানা বই লিখে ফেলেছে। তাতে আবার তত্ব, জীব, আত্মা আর বিভূতি নিয়ে জ্ঞান গম্ভীর বিশ্লেষণ ঢুকিয়েছে একগাদা। ঈশ্বর আর মোক্ষ নিয়েও নাকি অনেক এঁড়েমি করেছে ব্যাটা। নাস্তিকের নীতিজ্ঞান জিনিষটা অবশ্য জাবালিরও পছন্দের। নাস্তিক যদি বিবেক বিসর্জন দেয় তবে তার আর পশুর মধ্যে তফাৎটা আর রইল কোথায়। তবু তিনি কোথায় ভেবেছিলেন চার্বাকের দর্শনকে আরো কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাবেন, পিপ্পলাদ দিল সব তপস্যার ফল নষ্ট করে।
তাই তিনি ইদানীং আর কারো সাথে কথাবার্তা বলেন না বিশেষ। শুনেছেন নেপালের তরাই অঞ্চলে নাকি বোধিসত্ব বা তথাগত বলে একদল নব্য সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটেছে যারা বেদ সত্য নয় বলে প্রচার চালাচ্ছে। যাকগে, বয়স একশো পেরিয়ে গেছে, এই বয়সে না তো তাঁর বুদ্ধ-বোধিসত্ব হবার দেহবল আছে আর না নতুন করে ঈশ্বর-ভজনা শুরু করতে পারবেন। এখন তাঁর অলস প্রহর কাটে এই অলকানন্দার তীরের ছোট্ট বাসাখানায় বসে বসে আর ক্বচিৎ দু-একটা পাখির ডাক শুনে। কিন্তু সামনে যে এই বিশাল জন্তুটি, দেখে অবশ্য কোন পাহাড়ি উপজাতির মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, বিশাল হাঁ করে এগিয়ে আসছে, তার কি করা
যায় এখন!
(৪)
‘আহা, আজ যেন অসময়ে চাঁদ উঠল, তাও এই মর্ত্যলোকে, বরফের উপত্যকায় যেন পারিজাত ফুটল। কে গো মা তুমি?’ ঋষি নাস্তিক হলেও তাঁর রাক্ষসীর পেটে যাবার ইচ্ছে নেই, আর প্রাণ বাঁচাতে মিথ্যে কথা কে না বলে।
তবে কাজ হল তাতে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও হিড়িম্বা থমকে দাঁড়ালেন। ‘আরে এ তো একটা চিম্‌সে বুড়ো! দূর ছাই, চিবোনোই যাবে না, দাঁতেরই গুষ্টিনাশ হবে শুধু’, তিনি ভাবলেন। যদিও বুড়োর কথাবার্তা ভাল, অনেকদিন নিজের সম্বন্ধে এরকম সত্যি কথা শোনেন নি, তবু ভাবলেন, ‘নাঃ, যখন এগিয়ে এসেছি, একটু তো ভয় দেখাতেই হবে- নইলে মান থাকে না।‘ কিন্তু তার আগেই জাবালি বলে উঠলেন, ‘উঃ কত বছর ধরে এই দেহভার থেকে মুক্তি পাবার আশায় এখানে বসে আছি। আজ মনে হয় আমার ইচ্ছে পূর্ণ হল। এখানে যে আসে সেই কিছু না কিছু বর চায়। আমিও বর দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠেছি। এখন তুমি আমাকে খেয়ে উদ্ধার করলেই আমি বাঁচি।‘
বরের নামে হিড়িম্বা এবার থমকে দাঁড়ালেন। তারপরেই হঠাৎ ‘আমার বর, আমার বর’ বলে কেঁদে উঠলেন। ‘কি হল মা, তোমার বুঝি ক্ষিদে নেই এখন?’ মুনি বললেন। ‘না না, মুনিঠাকুর বলছিলাম কি আমার বর, মানে মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেন আমায় ফেলে মহাপ্রস্থান করতে চলে গেছেন। এবার আমার কি হবে!’
‘সে কি গো কন্যে? না না, এ বর আমি তো দিতে পারব নি। তবে অন্য কিছু ইচ্ছে থাকে তো বল। যদিও ভগবানের সঙ্গে আমার আড়ি, তবু বলা যায় না, লেগে যেতেও পারে।‘
‘ঠাকুর, কত কি ভেবেছিলাম করব, তা আর এ জন্মে হল না। গান গাইতে, কাব্য লিখতে, ছবি আঁকতে, তা আর হল কই! বৃকোদর চলে যাওয়ায় একা রাজ্য চালাতে হল। ছেলেটাও অকালে মরে গেল, দাদার তো বিয়েই হয়নি, বংশরক্ষাও হলনা। আর কি এ জন্মে সেসব পাব?’
‘এ জন্মে হবে না তো কি আছে, পরের জন্মে হবে’ মুনি বলছেন আর মনে ভাবছেন- এরকম অবস্থায় পড়েই তো মানুষ হয় গাদাগুচ্ছেক মিথ্যে বলে বা ভগবানকে ডাকে। ভগবান বা পুনর্জন্ম না মানার ভাল শাস্তি পাচ্ছি আজ, বাধ্য হয়ে সব মানতে হচ্ছে। ‘আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি পরের জন্মে তুমি রাজ্যশাসন করছ। ভীম তোমাকে এ জন্মে কষ্ট দিয়েছে তাই পরজন্মে তুমি অনূঢ়া থাকবে। ভাইয়ের বংশরক্ষা হয়নি বলছ, নাহয় একটি ভাইপোও থাকবে। আর কি চাও?’
‘আর অন্য ইচ্ছেগুলো?’
‘আরে, আমাকে কি ভূতের রাজা পেয়েছ! হবে হবে, সব হবে’ বলে জাবালি একটু মুচকি হাসলেন। ‘বৎসে, আমার বরে পরজন্মে তুমি গলা খুল্লেই মিঞা তানসেন, রঙের তুলি ধরলেই দা-ভিঞ্চি আর কলম ধরলেই শেক্ষপীয়ার বা কালিদাস হবে। এবার যাও দেখি, আমার ঘুম পেয়েছে।‘
‘আর কোথায় যাব, ঋষিঠাকুর? তোমার এখানেই থাকি না, তোমার পদসেবা করেই জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিই।‘
‘ওরে বাবা!’ জাবালি আঁতকে উঠলেন। ‘না না এখানে নয়। এখানে কি মানুষ থাকে? তুমি বরং আরো উত্তর পশ্চিমে চলে যাও বিতস্তা নদীর তীর ধরে। মানালি নামে সেখানে একটা গ্রাম আছে, যেখানে একসময় বৈবস্বত মনু থাকতেন। ওখানকার রাক্ষসজাতির মধ্যে কোন বড় নেতা নেই, সবাই খাওয়া-খাওয়ি করে মরছে। সেখানে তুমি তোমার নতুন রাজধানী বসাও। পরজন্মে নেতৃত্ব করার প্রাথমিক পাঠটাও সেখানেই হয়ে যাবে।
(৫)
এরপরের ঘটনা মহাভারতে নেই বটে, তবে হিড়িম্বা যে মনুলীলাভূমি বা মানালিতে গিয়ে একজন নামজাদা শাসক হয়ে উঠেছিলেন তা সেখানকার হিড়িম্বা আর ঘটোৎকচ মন্দির দেখলেই বোঝা যায়। আর জাবালির বর? যে ভদ্দরলোক পুনর্জন্মেই বিশ্বাস রাখেন না তাঁর বর যে ফলতেই হবে তার কোনও মানে আছে নাকি? তবে এ দুনিয়ার অনেক জায়গাতে অনেক কিছুই তো ঘটে থাকে। তাই যদি কাকতালীয়ভাবে কোথাও কিছু ঘটতে দেখাও যায়, তবে তা কি জাবালির দোষ?

12/june/2015

Friday, May 1, 2015

বাংলা ছড়া - পেটুকের বারমাস্যা ।।

পেটুকের বারোমাস্যা ।।


বৈশাখে শাঁখ বাজে বৈকালে শোন তা
ঝড়ে পড়া আম খাই দিয়ে ঝাল নোনতা।
জৈষ্ঠেতে জষ্টির মধু খাই টাটকা  
সাথে কাঁঠালের কোয়া কিছু আল-টপকা।

আষাঢ়ে অসাড় দেহে বসে খাই মিষ্টি
ঝরঝর বরিষণ, একটানা বৃষ্টি।
শ্রাবণে বনের মাঝে ময়ুরের নৃত্য
আনারস রসধারে ভরে ওঠে চিত্ত।

ভাদ্রটা অভদ্র প্যাচপেচি গরমে
তালবড়া নাহি পেলে রাগ ওঠে চরমে।
আশ্বিনে অশ্বটা ছুটিয়ে বাজার ধাই
পুজোয় খিচুড়ি ভোগ চুটিয়ে দেদার খাই।

কার্তিকে কার দিকে ছুটব তা বল না
দেওয়ালির লাড্ডু সে শুধুই কি ছলনা?
অঘ্রাণে কার ঘ্রাণে ভুলি সব চিন্তা!
নলেন গুড়ের টানে নাচে মন ধিন তা।

পৌষে আউশ কাটি, মাতি পিঠে পরবে
উঠোনে মরাই বাঁধা, বুক ফোলে গরবে।
মাঘেতে শীতের ভয়ে পালায় পালাক বাঘ
লেপমুড়ি মাখা-মুড়ি-- কি খাওয়ার অনুরাগ।

ফাল্গুনে কালগুনে দেখি যে সময় নাই
বসন্ত জাগ্রত যাহা পাই, তাহা খাই।
চৈত্রের রাত্রের কি বাহার ভাব রে,
মহুয়ার নেশা ভাঙ্গে নববর্ষ ভোরে।


নববর্ষ, ১৪২২ সাল।

বাংলা কবিতা - আজাদী ।।

আজাদী ।।

আজাদী-স্বরাজ সব জেনে গেছি, তার মানে ভাত নুন,
আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, ওরে তাকে বলে পোড়া বেগুন।
এলো গেল কত পনের আগস্ট, ছাব্বিশে জানুয়ারী,
দু-দিনই আমরা রাস্তার মোড়ে পতাকা বিক্রি করি।
আমি আর ভাই তিনশ বেচেছি, ফারুক-আসিফ দুশ,
সাত দিন পেট ভরে তো খেয়েছি, যতই মোদের দূষ।
তাকেই তো বলে স্বাধীনতা যাতে মেটে এ পেটের আগুন,
দু'বেলা দু থালা ভাত-ডাল, কিছু নুন আর পোড়া বেগুন!

১৮ই এপ্রিল, ২০১৫, কুয়েত।

বাংলা অণুগল্প ৪১ ।। মরুবিজয় ।।

মরুবিজয় ।।

পুরুলিয়ার দাঁদা গ্রামের রূপলাল মাঝি ছিল আমাদের ভাগীদার। না, সে অঞ্চলে অনাবাসী জমিদার খুব একটা না থাকায় তেভাগার আঁচ সেরকম লাগে নি, মালিক-ভাগীদার সম্পর্ক ভালই ছিল। তাছাড়া খাটতে পারত বলে দাদু তাকে গোবিন্দপুর পাঠশালার বাগানের দায়িত্বও দিয়েছিলেন, তাতে খানিকটা হলেও অতিরিক্ত একটা আয় থাকত। এছাড়া আরেকটা বিশেষ গুণ ছিল রূপলালের। প্রহ্লাদ বাউরির ঝুমুর গানের সাথে তার মাদলে সঙ্গত সেইসময় আর পাঁচটা গ্রামে নাম কুড়িয়েছিল। একদিন বন মহোৎসবের উপলক্ষ্যে ওদের ডাক পড়ল শান্তিনিকেতনে। নিতান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠান, কিন্তু রূপলালের মনে তার প্রভাব পড়েছিল।
আমরা আজ যাদেরকে 'পেগানিস্ট' বলে বিশেষ সম্মান করি, আবার গালাগালও দিই, এই দেশেরই কিছু উপজাতির মানুষরা কিন্তু বংশ-বংশান্তরে, হয়ত অবচেতনাতে প্রকৃতিদেবীর একনিষ্ঠভাবে উপাসনা করে আসছে। ওখানে প্রহ্লাদের ঝুমুর বেশ জনপ্রিয় হয় বটে, তবে ফিরে আশার পর রূপলালের প্রথম প্রশ্নটা দাদুকেও বিস্মিত করে তোলে। ও জানতে চেয়েছিল-'মরুবিজয়ের কেতন' মানে কি? তারপরেই ও মাঝে মাঝে শহরে চলে আসত আমার বাবার কাছে 'মাটি পরীক্ষা', 'সয়েল প্রিজার্ভেশান' ইত্যাদি সম্বন্ধে গভীরভাবে জানতে। বাবা তাকে সয়েল টেস্টিং ল্যাবে নিয়ে গিয়ে লোম ও অ্যালুভিয়াল সয়েলের বিশেষত্ব, টপ সয়েল নষ্ট হবার কারণ ও তার পরিণতি, কম্পোস্ট, ইউরিয়া, সুপার ফসফেট ইত্যাদি সারের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার বেশ যত্নসহকারে বোঝাতেন।
তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। বহুকাল পরে এসেছি গ্রামে। সঙ্গে কাকা, সদ্য ইটালি থেকে ফিরেছেন, হাতে একটা নতুন ধরণের যন্ত্র- একটা স্পুল টেপ-রেকর্ডার। খবর পেয়েই প্রহ্লাদ আর রূপলাল এসে হাজির, বেশ কিছু ঝুমুর গান রেকর্ড করা হল। বিকেলে রূপলাল আমাদের নিয়ে বেরোল। কি আশ্চর্য সবুজ চারিদিকে! দাঁদার মরা জঙ্গল থেকে যে টাঁড় জমি লালপুর হয়ে মৌতোড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সব সবুজ হয়ে গেছে গাছে গাছে। এত গাছ কে লাগাল? উত্তরে শুধু মৃদু হাসে রূপলাল মাঝি। 'ফরেস্টের রেঞ্জার সায়েব বাধা দিয়েছেন, কিন্তু খুড়ার ধমক শুনে আর কিচ্ছুটি কইতে পারেনি। তবে জঙ্গলটা চেলিয়ামা রেঞ্জের দখলে এখন, আমাকে অবশ্য আর কিছু বলার সাহস পায় না ওরা।' বুঝলাম শান্তিনিকেতনের মরুবিজয়ের কেতন ওড়ান দেখেই এই রূপলালের নবজন্ম। বিস্তীর্ণ হাজার একর জমিকে সবুজ করে তুলে ওর নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে।
গতকাল মৃত্যু ঘটেছে পদ্মশ্রী রূপলাল মাঝির। আমি নিজে গিয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে এসেছি। এবার থেকে তিনি বসবেন রাইটার্স বিল্ডিং-এ, পরিবেশ মন্ত্রকের উপমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন। তবে মহীরূহ মরলেও তার শেকড় থেকে জন্ম নেয় আরো অসংখ্য তরুলতা, তাই ক্ষীণ হলেও কিছুটা আশা রাখি পরবর্তী প্রজন্মের উপর।

২৪শে এপ্রিল, ২০১৫, কুয়েত।

বাংলা অণু-গল্প ৪০ ।। এ কি প্রেম নয়!

এ কি প্রেম নয়!
অণু-গল্প


'শোনো, তুমি বরং চাকরিটা ছেড়েই দাও। চুল-দাড়ি গেলে আর শিখদের কি রইল, শুনি?' অনুযোগের সুরে বলল সুরিন্দর। শুনে ঈশ্বর একটু মুচকি হাসল শুধু।
' না, তবু সিরিয়াসলি ভাব একটু। ধর্ম বেচে রুটি খাওয়ার কথা কি আমাদের জাতে কেউ কোনদিন শুনেছে? অন্য কোথাও কিছু পাওয়া যায় না কি?' এবার একটু ঝাঁঝ পাওয়া গেল সুরিন্দরের কথায়।

ঈশ্বরের বাবা উত্তম সিংহ গিল কাজ করতেন ওমানের তেলের খনিতে, ওয়ার্কওভার অপারেশনস বিভাগে। সেদিনও রুটিনমত টিম নিয়ে বেরিয়েছিলেন ওয়েল ইন্সপেকশনএ। সোহারের ৩১২ নম্বর কুপের একটা লিকেজের রিপোর্ট ছিল। উত্তম সেলার পিটের উপর থেকেই গেজে ৩০০০ কিলোপাস্কলের মত প্রেসার দেখতে পাচ্ছেন। 'দেখা যাক, ব্লিড করা যায় কিনা' এই বলে তিনি ব্রিদিং মাস্ক পরতে লাগলেন।
'স্যার আপনি কেন নাবছেন, আমি গিয়ে দেখছি'- সর্বনা বলে ওঠে।
'আরে ছড ইয়ার, পাঞ্চ মিটার থললে হি তো জানা হ্যায়, অভি হো আতা হুঁ।' বলে নেমে পড়লেন উত্তম।
ভালভ খুলে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তো আছেনই, কি হলো স্যারের- সর্বনা আর গুপ্তে হাঁ করে ভাবছে। হঠাত কি ভেবে গুপ্তে বলল, 'ম্যায় জাতা হুঁ, তু ভি আ'.......মাস্ক পরে তৈরী হয়ে নিল তারা।
আজ ঘটনাটার ছয় বছর হয়ে গেল, ভাবছিল ঈশ্বর। সেই সকালে উত্তমের অচেতন দেহটাকে দুজনে মিলে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। প্রচুর পরিমানে হাইড্রোজেন সালফাইড নি:শ্বাসের সাথে রক্তে মিশে মৃত্যু ঘটে তাঁর। লম্বা চুল-দাড়ি থাকায় ব্রিদিং মাস্ক সীল করেনি, এই হলো সেফটি কমিটির রিপোর্ট। ওরা অবশ্য অম্রুতা অর্থাত উত্তমের স্ত্রীকে একটা কেরানির চাকরি দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ঈশ্বর তখন স্কুলের পরীক্ষায় ভাল ফল করে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ঢুকে পড়ায়, তিনি পরিবর্তে ছেলের ভবিষ্যতে উপযুক্ত চাকরির কথাটা আদায় করে নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। আজ অম্রুতাও ইহলোকে নেই। ক্যানসার ধরা পড়তেই অপরিণত বয়েসেই ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী দেখে তিনি গেছেন।

ঈশ্বরের সাথে ছেলেবেলা থেকে প্রেম সুরিন্দরের। বিয়ের পর থেকে ওরা কাছছাড়া হয়নি কখনো। এই চাকরিটা সে নিয়েছে কারণ শুধু মাইনে বেশি বলেই নয়, সুরিন্দর সাথে থাকতে পারবে।তাছাড়া মায়ের চিকিত্সায় বেশ কিছু ধারও হয়ে গেছে. যদিও অয়েল-ফিল্ডে কাজ বলে কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী তাকে দাড়ি কেটে 'মোনা' হতে রাজি হতে হয়েছে। তারপর আজ গিয়ে চুল-দাড়ি কেটে, মাস খানেকের মধ্যেই যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

পরদিন সকাল থেকেই মন খারাপ সুরিন্দরের। 'আরে বাবা আজই তো যাচ্ছি না। আর তাছাড়া তুমিও ত যাবে সাথে, তাই না', সান্ত্বনা দেয় ঈশ্বর। আজ সকাল সকাল স্নান সেরে নিয়েছে সে। চুল শুকনো, বাঁধার বালাই নেই, ফটাফট তৈরী, এবার ভিসার জন্যে ফটো তুলতে যাবে সে। পাসপোর্টে যদিও একজন শিখ যুবকের ছবি আছে, তবু ভিসা পেতে অসুবিধা হবেনা, ওরা জানিয়েছে। কিন্তু সুরিন্দর একটানা কেঁদেই চলেছে, তাকে বোঝায়, কার সাধ্যি!
কথায় বলে মেয়েদের মনের কথা স্বয়ং ঈশ্বরও বুঝতে পারেন না, আর ইনি তো নামেই ঈশ্বর। ও কি করে জানবে, কাল পর্যন্ত যে সুরিন্দর কাছে না থাকলে তার চুল ধোয়া, শুকোনো, পরিপাটি করে আঁচড়ে দেওয়া, পাগড়ি পাট করতে সাহায্য করা কিছুই হত না, আজ সে কর্মহীনা। সে যে দশ মিনিটে একা একাই তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল, এটা সুরিন্দর মাত্র দু-বছরের বিবাহিত জীবনে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

(একটি পাঞ্জাবি গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

Thursday, January 22, 2015

বাংলা অণু-গল্প- ৩৯ ।। কস্তে পুত্রঃ ।।

কস্তে পুত্র: ||
(গল্প)


রিটায়ার করার পর মানুষটা বড় একা হয়ে গেছেন।

অবশ্য আগেও যে খুব একটা মিশুকে ছিলেন ছাতুবাবু তা নয়। হ্যাঁ, ছাতুবাবু নামেই তাঁকে ডাকে পাড়ার লোক। আসল নাম সত্যেন পান্ডে লোকে বোধহয় ভুলেই গেছে। বিয়ে করেননি বলে যে তাঁর খুব একটা একাকিত্ব বোধ ছিল তা মনে হয় না, তবু কি অপত্য-স্নেহবঞ্চিত বুকের কোথাও একটু ফাঁকা-ফাঁকা লাগেনা কখনো জীবনের এই সন্ধিস্থলে এসে দাঁড়িয়ে? উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার মানুষ, সেই কোনকালে মহাজনের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতায়। শেয়ালদা স্টেশনে কুলিগিরি করে আর অবসর সময়ে পড়াশুনা করে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন সে যুগে। তারপর হাওড়ার বি-এন-আরের শালিমার ইয়ার্ডে ছোট্ট একটা চাকরি। ঘুরতে ঘুরতে শেষে মুম্বাই। সেন্ট্রাল রেলের প্যারেল ইয়ার্ডে ইয়ার্ড-মাস্টারি করেই তো কেটে গেল চাকরি জীবনের শেষ বারোটা বছর। ভোজপুরি আর হিন্দি ছাড়াও বাংলাটা ভালই শিখেছিলেন, এখন কিছুটা ইংরেজি আর মরাঠিও বলতে পারেন। তবে রিটায়ার করেও একটা নেশা যায়নি। সকালে ছিঁড়ে-ছাতু সহযোগে জলপান সেরে হিন্দু কলোনির ছোট্ট ফ্ল্যাট বাড়িটা থেকে রোজ বেলা দশটায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন দাদার স্টেশনে। সেখানে দেশোয়ালি কুলিদের সাথে বসে টানা একঘন্টা তাদেরকে তুলসীর রামায়ণ আর দোহা শোনান, এমন মুগ্ধ শ্রোতা মুম্বাইয়ে পয়সা দিলেও পাওয়া যায় না!

কিন্তু তারপর? সারা দিনটা যে পড়ে থাকে কর্মহীন অবসরের জন্যে, তার তো অভ্যেস ছিল না তাঁর। ওয়াডালা স্টেশনের ধারে বাচ্চাদের একট স্কুল আছে, বলা বাহুল্য, অবৈতনিক- ভিখারী-কুলি-মজুর আর কিছু নিম্নশ্রেনীর বারাঙ্গনাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে সেখানে। তিনি কদিন গিয়ে তাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে হিন্দি পড়াতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় নেতার ভয় হল, তিনি বুঝি ভোটে দাঁড়াতে চান- তাই গুন্ডা দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাঁকে তাড়ানো হলো। নেতাকেও দোষ দেওয়া যায় না, বিনা স্বার্থে কেউ কিছু করতে চায়, এই সত্যি কথাটা এযুগে বসে তাঁর হজম হবে কেন? তাছাড়া তিনি আবার সে স্কুলের বোর্ড প্রেসিডেন্ট!

সেদিন সকাল থেকে ঝির ঝির বৃষ্টি পড়লেও ছাতুবাবুর রুটিনের অন্যথা হয়নি। কিন্তু এগারোটা বাজতে চলল, কুলিভাইদের কারো দেখা নেই কেন? একটু খোঁজ নিতেই বোঝা গেল ব্যাপারটা। তিন নম্বর আপ কলকাতা-এলাহাবাদ-মুম্বাই মেল এক নম্বরের জায়গায় চারে আসছে, তাই সব ব্যাটা দৌড় দিয়েছে সেদিকে। ওই তো গাড়ি ঢুকছে চার নম্বরে, তিনিও কি ভেবে ফুট ওভারব্রিজে উঠে পড়লেন। ছাতুবাবু রিটায়ার করেছেন বটে, তবে তাঁর কাছে প্ল্যাটফর্ম টিকিট চায় এমন রেলকর্মী কেউ নেই এ স্টেশনে।
গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে চলেও গেছে। এখানে কেউ খামোখা বসে থাকে না। 'সময় হল, সময় হল, যে যার আপন বোঝা তোলো' বলে কুলিরা কেটে পড়েছে। কিন্তু যারা প্যাসেঞ্জার পায়নি তারা আবার ওই হুইলারের স্টলটার সামনে দাঁড়িয়ে কিসের জটলা করছে? এরকম তো কথা ছিল না। ছাতুবাবু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে। হায় রাম, এই কান্ড! এক ষাটোর্ধ্ব বুড়ো-বুড়ি নেমেছে ট্রেন থেকে, তারা কুলিদের মুখের সামনে একটা কাগজ নেড়ে ক্রমাগত কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে। কুলিদের কাজ কাগজ নিয়ে মাথা ঘামানো নয়, তারা মাল তুলতে পারলেই খুশি। তিনি এগিয়ে যেতেই ওরা সসম্ভ্রমে জায়গা ছেড়ে দিল। তাঁকে দেখেই বুড়ো-বুড়ি কেঁদে ফেলল। বুড়ো লোকটি হাউমাউ করে বাংলায় যা বলতে লাগলো তার অর্থ মোটামুটি এই বোঝা গেল যে, তাদের বড় ছেলে তাদেরকে বর্ধমানে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়েছে। ছোট ছেলে বোম্বাইএ কাজ করে, তার দাদার স্টেশনে মা-বাপকে নিতে আসার কথা, কিন্তু এখানে নেমে অবধি কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তাদের ভাষাও কেউ বোঝে না, ওরা নিজেরাও গাঁয়ের মানুষ, বাংলা ছাড়া কিছু জানে না।

'রুকিয়ে, রুকিয়ে, বাবুজি, আপনার হাথে উটা কিসের কাগজ?' ছাতুবাবু জানতে চাইলেন।
'এই দেখো, এটাই তো দেখাতে চাইছিলাম আপনাদের এতক্ষণ। আমার ছোটছেলে ব্যস্ত মানুষ, যদি না আসতে পারে, এই ভেবে বড় ছেলে ওর ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিল আমার হাতে। তা আমরা মুখ্যুসুখ্খু মানুষ, ইংরেজি কি পড়তে পারি! একটু দেখুন না সায়েব, কি লেখা আছে', বুড়ো লোকটি কাতরভাবে অনুরোধ করলেন।
উনি কৌতূহল-বশত: চিঠিটা পড়েই চমকে উঠলেন। তারপর গলাটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বললেন, 'বাবুজি, যে বস্তির ঠিকানা এখানে দেওয়া আছে তা তো কবে উঠে গেছে। সেখানে এখন মস্ত হোটেল। তা, আপনার যদি আর কুনো জায়গা না থাকে আমার সাথেই চলুন না আমার বাসায়, তারপর ধীরে-সুস্থে আপনার ছেলেটাকে খুঁজা যাবে। কি বোলেন?' বুড়ো-বুড়ি হাঁ করে তাকিয়েই আছে, তাদের যেন কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। কুলিরা তা বুঝে তাড়া ও ভরসা দিল-' আরে মাজি, সোচনে কা নেহি, হামারা সত্তুবাবু রামজি কা অবতার আছেন, আপ বিন্দাস যাইয়ে।' শুধু বলেই ক্ষান্তি নয়, দুজন কুলি সাথে সাথে তাদের জিনিসপত্র তুলে হাঁটা দিতে লেগেছে হিন্দু কলোনির দিকে।
'আপনাকে খুব কষ্ট দিলাম। আপনার স্ত্রী ছেলে-পুলে......'
'কুছু ভাববেন না। হামার কেউ নেই। এখন আপনি আমার বড়া ভাই, আর ইনি আমার ভাভী আছেন। আপনার ছেলেটাকে না পাওয়া অব্দি বাড়ির রান্না খাওয়া যাবে। কি ভাভিজি, বাঙালি রান্না খাওয়াবেন তো?'

এতদিনে ছাতুবাবুর বোধহয় ছেলেপুলে না থাকার দু:খ ঘুচলো। কাগজটাতে যে পষ্ট ইংরেজিতে এই কথাটা লেখা ছিল- 'এই বুড়ো-বুড়িকে দয়া করে কোনো দাতব্য বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দেবেন'।

এপ্রিল ৩, ২০১৫, কুয়েত।

Wednesday, January 21, 2015

বিবিধ প্রসঙ্গ ।। ১-৩

(১)
বিভীষণ

কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলেই আমরা কথায় কথায় বলে থাকি, 'ঘরভেদী বিভীষণ'। এই বিভীষণ কি অন্যায় বা অনৈতিক কাজ করেছিলেন দেখা যাক। তিনি সীতাকে বন্দী করে রাখার ব্যাপারটা সমর্থন না করে চেয়েছিলেন রাবণ সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দিক। এই নিয়ে তর্কাতর্কি চলাকালীন রাবণ রাগের চোটে ছোট ভাইকে লাথি মেরে বসেন। এই অপমান সহ্য না করতে পেরে বিভীষণ রাবণকে ছেড়ে চলে এসে রামের দলে যোগ দেন।
এছাড়া বিভীষণের কি আর কোনও উপায় ছিল না? ছিল। যদি তিনি রাবণের সত্যিকারের শুভাকাঙ্ক্ষী হতেন, তাহলে তিনি রাবণের পরাজয় চাইতেন, কিন্তু নিজে তার কারণ হয়ে উঠে রামের দলে যোগ দিতেন না। তিনি বরং নিরপেক্ষ হয়ে থাকতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি, কারণ তাঁর রাজ্যের লোভ ছিল। লঙ্কার অধীশ্বর হতে গেলে পুত্রপৌত্রাদিসহ রাবণের মৃত্যু জরুরী ছিল আর বিভীষণ এও জানতেন যে তাঁর সাহায্য ছাড়া রামের প্রসঙ্গ কাজ করা অসম্ভব হত।
আজ এ দেশের রাজনীতিতে এ খেলা অবিরত চলে আসছে। মমতার সাথে চার বছর সুখে ঘর করার পর যখন মনে হল দিদির এবার জেতার আশা কম, অমনি বনগাঁর ঠাকুরের খেয়াল হল পদ্মফুলের গন্ধ ঘাসফুলের চেয়ে মিষ্টি, ফলে তিনি দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদান করলেন। দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী হবার লোভে কেজরীওয়াল ছেড়ে কিরণ বেদিও ভাজপার পতাকাতলে এলেন। এঁরা কিন্তু নির্লোভ হলে দলত্যাগ করে নিরপেক্ষও থাকতে পারতেন, আর সেটাই হত অন্যায়নীতির বিরুদ্ধে সঠিক প্রতিবাদ। যদি নীতিগত প্রশ্নে বিভেদ ঘটে, নির্দলীয় হয়ে দাঁড়ালেই হয়!
তবে আমাদের দেশের জনতা চিরকাল বিভীষণকেই ভোট দিয়ে এসেছেন, এবং এবারও দেবেন, কারণ তিনি ভগবান রামের দলে এসেছেন যে! আর রামের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি বিভীষণের চরিত্রটিকে নিখুঁতভাবে অধ্যয়ন করে তাঁর কাছ থেকে নিজের ছেলে তরণীসেনকে মারার ট্রিকটুকুও বলিয়ে নিয়েছেন কথায় কথায়। তাই তো তিনি ভগবান!


(২)
কর্ণ


নাঃ, খুব ভালগার হয়ে গেল শীর্ষকটি। কিন্তু কিছু করার নেই। যে হারে সুবিধাবাদী ও বিক্ষুব্ধ নেতারা নিজের নিজের দল ছেড়ে অন্য দলে গিয়ে সাইন করছেন, হয়ত সেখানে গিয়ে শাইনও করবেন, সে সব দেখে দৈনন্দিন মলত্যাগে অভ্যস্ত সাধারণ জনতাও অস্বস্তি ফীল করছেন। মাতুয়া শিরোমণি শ্রীমঞ্জুল বা প্রাক্তন রেলমন্ত্রী দীনেশবাবু বা সাধন পাণ্ডেরা এতদিনে বুঝতে পারলেন-
কিসের মাটি, কিসের মানুষ, কিসের তৃণমূল,
কাল যে ছিল নয়নমণি, আজ সে চক্ষুশূল।
কেউ কেউ বলছেন, জনতার অপমান আর অভিশাপ বয়ে আর ও দলে থাকা যায় না। সত্যিই যায় না। আসল কারণ অবশ্য টাকা রোজগারের কায়দা হিসেবে সারদার পর নতুন কোনও ইনোভেটিভ আইডিয়ার উদ্ভব না করতে পারা, দু-নম্বর ভাজপা-কে কংগ্রেস ভেবে মমতার ভুল করে সভার মাঝে মোদিকে আজেবাজে কথা বলা (উপায় নেই, অভ্যাস হয়ে গেছে, মুখ খুললেই ওগুলো বেরিয়ে পড়ে) আর তিন নম্বর- তৃণমূল নেত্রীর সঠিক সময়ে একটু নত হয়ে কংগেসের সাথে জোট না করতে পারা। এরপরও লোকে থেকে যেতেন, যদি দলের কোনও আদর্শ থাকত- মনে করে দেখুন দল থেকে বিতাড়িত নেতা সোমনাথবাবুকে, যিনি অনায়াসে সেসময় কংগ্রেস বা অন্য দলে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু বাম আদর্শ যাঁর মজ্জাগত হয়ে গেছে তিনি কি তা করতে পারেন! কম্যুনিষ্ট পার্টির দুর্ভাগ্য, এরকম একটা মানুষ থাকতে হরকিষেন বা কারাটের মত লোকেরা পলিটব্যুরোর শীর্ষে থাকেন বা বুদ্ধদেববাবুর মত দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ বঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী হন!

এই প্রসঙ্গে ভেবে দেখলে মহাভারতের যুদ্ধের আগের দল-বদল পর্ব এখনও প্রাসঙ্গিক। মদ্ররাজ শল্য নকুল-সহদেবের মামা হলেও যেহেতু দুর্যোধনের অনুরোধ আগে পান, তাঁর দলেই যোগ দেন। কৃষ্ণকে নিয়ে হেড-টেল টস হয়, ও অর্জুন যেতেন। বলদেবের আশীর্বাদ প্রিয়শিষ্য দুর্যোধনের পক্ষে থাকলেও, ভাইএর কথায় তিনি থাকেন নির্দলীয় হয়ে। তবে রগড় শুরু হয় যুদ্ধ শুরু হবার পর। কর্ণের শৌর্য-বীর্যের কাছে পেরে না উঠে কৃষ্ণ তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলতে তাঁর বংশ-পরিচয় দিয়ে আসেন আর তার পরেই কুন্তী-মা গিয়ে তাঁকে দল-বদলের আহ্বান জানিয়ে আসেন। তিনিও তখন অনায়াসে বেরিয়ে আসতে পারতেন, এলে বেঁচে যেতেন, রাজাও হতেন হয়ত। কিন্তু সেই কবে বন্ধু দুর্যোধন অপমানিত অবহেলিত মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো একটি সূত-পুত্রকে রাজার মর্যাদা দিয়েছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতাবশে তিনি দলত্যাগ করলেন না। এ যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এ যে কত বড় স্বার্থত্যাগ, তা বলে বোঝানো যাবে না।
যাক গে, তৃণমূল ভাঙ্গুক, আআপ ভেঙে কিরণ বেদী বেরিয়ে এসে দিল্লীর বিধানসভার দিকে হাত বাড়ান বা নাই বাড়ান, ভাজপার বৃহস্পতি এই মুহূর্তে তুঙ্গে। যে দলই জিতুক কিছু যায় আসে না, শুধু চাইব তারা যেন জনতাকে 'বনলতা সেন'এর মত 'দু দণ্ড শান্তি' দিতে পারে।


(৩)

ঈশ্বর

সদ্য দেখা 'পি কে' ছবিতে একটা খুব জনপ্রিয় উক্তি ছিল। তপস্বী-বাবা বলছেন, 'বিধর্মীদের হাতে চুড়ান্ত অপমানের হাত থেকে আমরা ঈশ্বরকে রক্ষা করব'। তার উত্তরে ভিন-গ্রহ থেকে আসা লোকটা বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে প্রকারান্তরে বলেই ফেলল- 'যে ভগবান বিশ্ব-সৃষ্টি করেছেন তাঁকে রক্ষা করবে তুমি, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! চিন্তা কোরো না, ঈশ্বরের নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা ঠিকই আছে, তার জন্যে তোমার চিন্তার প্রয়োজন হবে না।'
আজ একালের ঈশ্বর বারাক ওবামা নিজের হাতে নিজের রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে এ গাঁয়ের মোড়লমশাইকে অশেষ দুশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্ত করেছেন। মোড়লমশাই তাঁর মোড়লজীবনের প্রথম গণতন্ত্রদিবসের সমারোহে প্রতিবেশী দেশের ছিঁচকে গুণ্ডাদের নিয়ে বড্ড চিন্তায় ছিলেন। এদিকে আধুনিক ঈশ্বরের কাছে স্বমহিমা প্রচারের এরকম সুযোগ ছাড়তেও পারছিলেন না। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের ছিঁচকে উৎপাত থেকে তাঁকে রক্ষা করবে কে? আমাদের অশেষ সৌভাগ্য যে এ দায়িত্ব তিনি নিজেই গ্রহণ করলেন। প্রতিবেশী দেশের মোড়লমশাইকে একটি বার্তায় তিনি স্পষ্টরূপে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর উপস্থিতিতে দিল্লী বা তার আসেপাশে কোনরকম অশান্তি বা নাশকতামূলক কাজকর্ম তিনি চাননা। আমরা অগত্যা একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম। কিন্তু এই একটা ঘটনা কি কি প্রমাণ করল দেখা যাক্‌-
১- ঈশ্বরকে মানিনা ইত্যাদি বলে গালাগাল দিলেও তাঁকে খুশী রাখতে রাম ও রাবণ দুজনেই চায়। তাই কুরুক্ষেত্রের প্রাক্কালে অর্জুন আর দুর্যোধন দুজনেই কৃষ্ণকে নিজের নিজের দলে টানতে দ্বারকা পৌঁছে গেছিলেন।
২- নিজেকে রক্ষার ভার ঈশ্বর নিজেই নিতে পারেন। তাই তাঁর রক্ষার জন্যে চিন্তিত না হয়ে তাঁকে নিয়ে এসো নিজের কাছে, এতে করে তুমি নিজেও সুরক্ষিত থাকবে।
৩- এই গ্রহে যাবতীয় নাশক-অনাশক, শুভাশুভ কর্মকাণ্ডের নায়ক তিনিই। তিনি না চাইলে কাশ্মীরের এক ইঞ্চিও ভারত পায় না, আবার আল-কায়দাও কোনও কায়দা-কানুন দেখাতে পারে না।
৪- এটাও জানা গেল যে বিভিন্ন সংগঠিত-অসংগঠিত, ন্যায্য-অন্যায্য নাশক-শ্রেণীর গুপ্তচক্রগুলির নিয়ন্ত্রণ প্রতিবেশী দেশের মোড়লের হাতে আছে, আর এটা স্বয়ং ভগবানও জানেন।
৫- সুতরাং দু-দেশের মোড়লেরই উচিৎ হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা বলে নিজেদের মধ্যে লাফালাফি না করে ঈশ্বরের ইচ্ছাটি কি তা জানার দিকেই নজর কেন্দ্রিত রাখা। অবশ্য জনতাকে ভাঁওতা দিতে একটু চেঁচামেচিরও দরকার আছে, মানতে হবে।
তাহলে টুইন টাওয়ারে কি হয়েছিল। কেন, ছেলেপুলেরা কি বাপ-মায়ের অবাধ্য হয়না মাঝে মাঝে? তার ফলও তারা পায় হাতে-নাতে।
অলমিতি বিস্তারেন!