মুচিপাড়ার প্রবীণতম বাসিন্দা কুট্টিবাবু নিজে কিন্তু চিরনবীন, একসময় ছেলেছোকরাদের কাছে
স্বার্থপর দৈত্য বলে পরিচিত ছিলেন। কাজকর্ম কিছু করেন কিনা কেউ জানেনা, তবে অজস্র বই পড়েন। সকাল থেকে
বারান্দায় একটা ইজি-চেয়ারে বসে বই পড়তেন তিনি, মুখে থাকত গড়গড়ার নল। এযুগে একটু খাপছাড়া
ঠেকে বটে,
কিন্তু কুট্টিবাবু
মানুষটিও তো নেহাৎ আধুনিক নন। ভয়ে বা ভক্তিতে ছেলেছোকরারা তাঁকে একটু এড়িয়েই চলত, অবশ্য বয়স্ক কাউকেও কখনও ওঁর
সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি তেমন।
খেলতে খেলতে একদিন
পাড়ার ছেলেদের টেনিস বল কুট্টিবাবুর বারান্দায় চলে যায়। ছেলেগুলো রাজ্যের
কুলাঙ্গার,
মায়ে তাড়ানো-বাপে
খেদানো চারজন, নাম-
ভোঁদড়, ভ্যাবলারাম, নেপাল আর গোবিন্দ। ভাল নাম ওদের
একটা করে আছে বটে কিন্তু তা শুধু স্কুলের খাতায়। বলটা ‘সেলফিশ-জায়ান্ট’ কুট্টিবাবুর
বারান্দায় যেতেই ওদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে কে যাবে তা উদ্ধার করতে।
ঠিক করতে না পেরে শেষমেষ চারজনেই গিয়ে কড়া নাড়ল তাঁর দরজায়। কুট্টিবাবুর চাকর দরজা
খুলে দিতেই ভেতর থেকে হাঁক এল- 'হারুন, ওদের চারটেকেই ভেতরে পাঠিয়ে দে।'
শুনেই তো ওদের হাত পা
ঠাণ্ডা। ওরকম ঘটোৎকচ মার্কা বিশাল চেহারা, চারজনকে
গিলে খেতে না পারলেও পিটিয়ে মারতে পারেন। তবু সাহস করে এগোল ওরা।
- ক্রিকেট খেলছিলি? তোদের মাঠখানা তো অনেকটা দূরে
দেখছি। এত জোরে মারল কে?
- দাদু, ভ্যাবলা মেরেছে, ভোঁদড়ের কাতরোক্তি।
- এই হতচ্ছাড়া, আমাকে দেখে কি তোদের দাদু মনে
হচ্ছে? নাম কী তোর?
- আজ্ঞে জ্যেঠু, আমি ভোঁদড়।
- জ্যেঠু, জ্যেঠু আবার কী? আমার বয়স কত হবে বলত? এবার প্রশ্ন নেপালকে।
- জানিনা স্যার, ষাট-সত্তর হবে।
- বলিস কী রে!
ষাট-সত্তর-আশি হয়ে তাহলে তো বুড়ো হয়ে কোনদিন মরেই যাব। জানিস, আমার বয়েস এখন আঠেরো। তোরা আমাকে
এবার থেকে কুট্টিবাবু বলবি, কেমন?
বোঝা গেল, বেশ একটা রসিকতা করলেন
কুট্টিবাবু। গোবিন্দ ওদের মধ্যে খুব সুকুমার ভক্ত, নিজেও একটি পাগলা দাশুর অবতার। ও
বলে- 'হ-য-ব-র-ল’র বুড়োর মত বয়সটাকে
ঘুরিয়ে দিয়েছেন বুঝি?'
এবার হা হা করে
প্রাণখোলা অট্টহাস্য করে উঠলেন কুট্টিবাবু। ব্যস, এক নিমেষেই সবার বন্ধু হয়ে গেলেন
তিনি।
- মাঝে মাঝে আসবি, কেমন? আর আপনি নয়, তুমি। আঠেরো বছরের মানুষকে কেউ
কখনও 'আপনি' বলে! যা বল নিয়ে পালা এখন।
চার বন্ধুই এখন কুট্টিবাবুর মুগ্ধ ভক্ত। এক রবিবার সকালে কুট্টিবাবু বসে আছেন তাঁর
সেই বিখ্যাত আরামকেদারাটিতে আয়েশ করে, ওটা
নাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলার নিলাম করা সম্পত্তি থেকে কেনা, কে জানে কতটা সত্যি সে গল্প। উনি
গড়গড়ার নলটা সবে টেনেছেন, এমন
সময় হুড়মুড় করে ভ্যাবলারাম এসে হাজির। 'হেল্প
কুট্টিবাবু,
বাঁচাও!' ভ্যাবলারামের আর্তনাদ।
- কী ব্যাপার রে, কেউ তাড়া করেছে নাকি? সাত সকালে কার হাঁড়ি ভাঙতে
গিয়েছিলে চাঁদ?
- না, মানে ভোঁদড়ের কাছে খবরটা শুনেই
তাড়াতাড়ি......
- অ্যাঁ! তাড়ির হাঁড়ি
ভেঙেছিস?
আহা রে, না ভেঙে যদি নিয়ে আসতিস! না না, সবাই মিলে ভাগ করেই খাওয়া যেত।
- দুত্তেরি তোমার তাড়ি।
এবার পাত্তাড়ি গোটাতে হবে দেখছি এখান থেকে। আমার কিনা এখন শিরে সংক্রান্তি, শিরা ছিঁড়ে যাবার যোগাড়!
- সংক্রান্তি? বলিস কিরে! আজ যে মোটে দোসরা পৌষ।
আহা সংক্রান্তিটা কবে আসবে রে? বেশ
পিঠে খাওয়া যাবে।
- ভাল জ্বালা! তোমার
কেবলই দেখি খাওয়ার চিন্তা। আসলে আমার শিরে সংক্রান্তি নয়, সংস্কৃত- ভ্যাবলারাম ভুলটা
সংস্কার করে নেয়।
- সংস্কৃত? ঐ মানে অং-বং-চং?
- হ্যাঁ, কাল আমার সংস্কৃত পরীক্ষা।
অন্যগুলো কোনমতে পার হয়েছি, তা
এইটে হল গিয়ে বিভীষণ, না
কী যেন- বিসূচিকা!
- বিভীষিকা?
- ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই, মানে খুব ভয়ের ব্যাপার। ভোঁদড় তাই
শুনে তোমার কাছে পাঠাল, বলল
কুট্টিবাবু আমাদের বহুরূপী!
- অ্যাঁ! তা হ্যাঁরে, ভোঁদোড়কে দেখছি না তো?
বলতে বলতেই ভোঁদোড়
হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির। 'উরিব্বাস, খুব বেঁচে গেছি! এই রবিবারেও দেখি
অঙ্কের টিউটার। পর্শু অঙ্ক পরীক্ষা কিনা, আজও
এসে হাজির,
আমি তো দেখেই ভোঁ দৌড়।
- নামের উপযুক্ত কাজটিই
করেছো, কুট্টিবাবু স্বীকৃতি দেন। 'তা হ্যাঁরে, আমার সম্বন্ধে কী সব উল্টোপাল্টা
বলেছিস ভ্যাবলাকে?
- আমি? কই না তো!
- ঐ যে বহুরূপী। জানিস
সেটা একধরণের গিরগিটি, যারা
ঘন ঘন রঙ বদলায়?
- এই দ্যাখো! বহুরূপী কেন
হতে যাবে,
আমি বলেছি বহুদর্শী, মানে যে অনেক কিছু দেখেছে।
- তা দেখেছি বটে। একবার
কী দেখেছিলাম জানিস, একটা
গরু একটা গাছের মগডালের পাতা খাচ্ছে।
- যাঃ, সে তো কেবল গল্পে হয়, গরু গাছে ওঠে।
- হ্যাঁরে, পুরোটা শুনবি তো! গাছটা ছিল চার
ফুট উঁচু একটা জংলি কুলগাছ।
এমন সময় নেপাল আর গোবিন্দ এসে ঢোকে। ভোঁদড় আর ভ্যাবলাকে
হাসতে দেখে ওরা ভাবে নিশ্চয়ই একটা কিছু হাসির ব্যাপার ঘটেছে, তাই ওরাও বোকার মতন খুব হাসতে
থাকে। হঠাৎ ভ্যাবলা মুখটাকে কাঁদো-কাঁদো করে বলে, 'কুট্টিবাবু,, আমাকে রেসক্যু কর, আমি সং......
- ওঃ, আবার ইংরেজি বুলি ঝাড়া হচ্ছে!
তোকে সং সাজতে কে বলেছিল?
- আরে না না কুট্টিবাবু, ভ্যাবলা সং সাজে নি, কাল ওর সংস্কৃত পরীক্ষা- তাই
বলছিল।
- ও, তাই বল। জানিস, আমি একবার সংস্কৃতে ছিয়ানব্বুই
পেয়েছিলাম?
- অসম্ভব! সবাই একযোগে
নস্যাৎ করে দেয় দাবীটাকে।
- কী বললি? পাইনি! প্রমাণ চাস?
- ওরে ব্বাবা! প্রমাণ
চাইব তোমার কাছে? তার
চেয়ে বরং কী করে পেয়েছিলে তাই বল, শুনে
মুগ্ধ হই- নেপাল একটু তোয়াজ করে কুট্টিবাবুকে।
- তবে শোন, কুট্টিবাবু শুরু করেন তাঁর
কাহিনী। মুগ্ধবোধ থেকেই শুরু করি। তখন আমরা পড়ি বোপদেবের মুগ্ধবোধ আর বিদ্যাসাগরের
কৌমুদী। পণ্ডিতমশাই ক্লাসে ঢুকতেই আমরা তারস্বরে পড়তে শুরু করে দিতাম- নরঃ নরৌ
নরাঃ। ভুল করলেই পণ্ডিতের ধমক- বেঞ্চির উপর দাঁড়াঃ! অমনি সমবেতকণ্ঠে শুরু হত-
গজঃ গজৌ গজাঃ
খেতে বড় মজা।
ফলম ফলে ফলানি
পরের গাছে ঝোলানি,
আমরা কুড়োই তলানি
পাড়তে গেলেই প্যাঁদানি।
ইত্যাদি ইত্যাদি...
পণ্ডিতমশাই পদ্য শুনতে খুব ভালবাসতেন। তাই এভাবে
কিছুক্ষণ দুলে দুলে পড়তেই ঘুমপাড়ানি ছড়া শুনে বাচ্চাদের যেমন হয়, উনিও নাক ডাকাতে শুরু করতেন। সাথে
সাথেই আমাদের পলায়ন। কাজেই পড়াশুনো কেমন হত বুঝতেই পারছিস!
কুট্টিবাবু থামলেন।
- তাহলে
নাইনটি সিক্স......গোবিন্দের ব্যাকুল প্রশ্ন।
- বলছি - বলছি। সম্রাট
বিক্রমাদিত্য আর কালিদাসের সেই গল্পটা শুনেছিস কি, সেই যে এক চিত্রকর রাজমহিষী
ভানুমতীর ছবি এঁকেছিল- কালিদাস তা দেখেই বললেন 'একদম হয়নি’?
- না শুনিনি। শুনছি, বলে যাও। নেপাল বলে।
- শুনে সম্রাট তো অবাক। 'কী বলতে চাও, মহাকবি?' তিনি জানতে চান। 'আমি লিখে জানাচ্ছি' বলে কালিদাস কলম ডোবান কালিতে।
কিন্তু বেশ কিছুটা কালি ছিটকে পড়ে ছবিতে ভানুমতীর পায়ে, একটা তিলের মত হয়ে যায়।
'এবার ঠিক হয়েছে', কালিদাস বলেন। কিন্তু সম্রাট রেগে
আগুন, 'রানীর চেহারা এত নিখুঁতভাবে তুমি
কী করে জানলে হে কালিদাস?'
- কী আবোলতাবোল বকছ, কুট্টিবাবু? ধান ভানতে শ্যামাসংগীত! সংস্কৃতের
সাথে এর কী সম্বন্ধ?
- কথাটা শ্যামাসংগীত নয়, শিবের গীত। আছে হে ভ্যাবলানন্দ, সম্পর্ক আছে। ঠিক এরকম ব্যাপারই
সেদিন ঘটেছিল কিনা! সংস্কৃত পরীক্ষার দিনে পেপারটা দেখেই না আমার ভীষণ ঘুম পেয়ে
গেল। রাত জেগে পড়া, অথচ কিছুই প্রায় জানিনা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী যে লিখেছিলাম মনে
নেই, বোধ করি উত্তরগুলো বাংলায় লিখে
যাচ্ছিলাম। হঠাৎ হেঁড়ে গলার চিৎকারে তন্দ্রা ছুটলো-
- 'কি র্যা কুট্টি, তুই এখানে বসে ঘুমোবি, আর পরীক্ষাটা বুঝি আমি দেব?' পণ্ডিতমশাইয়ের গলা। আজ ব্যাপারটা
গেছে উলটে,
অর্থাৎ কিনা তিনি জেগে
আর আমি ঘুমিয়ে। আমি তো চমকে জেগে উঠেছি। কলমটা ছিল হাতে ধরা, তখনকার দিনের ফাউন্টেন পেন, বুঝলি কিনা, সেটা ফসকে গেল হাত থেকে, পড়ল গিয়ে খোলা খাতার উপর।
পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল আমি পেয়েছি নাইনটি-সিক্স!
- পণ্ডিতমশাই
নিশ্চয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই মার্কিং করেছিলেন, ভোঁদড়
নিশ্চিত।
- হেঁ হেঁ, তোরা ছেলেমানুষ, অতশত কি বুঝিস? এবার আলোয় আসেন কুট্টিবাবু। আসলে
কী হয়েছিল জানিস, কলমটা
হাত থেকে ছিটকে পড়ে কালি ছিটকে যেখানে যেখানে পড়ার কথা, পড়ে গেছিল, পড়ে অনুস্বর-বিসর্গ-চন্দ্রবিন্দু
জায়গামত লেগে গিয়েছিল। আর জানিসই তো বাংলাভাষায় অনুস্বর-বিসর্গ লাগলেই সংস্কৃত।
কালিদাস তাই বলেছিলেন সম্রাট বিক্রমাদিত্যকে, মাঝে
যদিও একটা স-সে-মি-রা'র
গল্প আছে-
"দেবতার প্রসাদেতে গুরুর
কৃপায়,
জিহ্বা-অগ্রে সারদা
বিরাজে মহাশয়।
নতুবা এ রূপ কথা কোনজন
জানে,
ভানুমতী উরূদেশে তিলের
সন্ধানে?।" *
হেঁ হেঁ, অবিকল কালিদাসের গল্পটা। কালিদাস
যা পারেন তা তোদের কুট্টিবাবু পারবে না, বলিস
কী রে!
- আলবাৎ পারে, আলবাৎ পারে। আর কুট্টিবাবু যা
পারেন তা এই ভ্যাবলারাম পারবে না?......যাই
কলমে কালি ভরি গিয়ে, ভ্যাবলা
ছুট দিল।
তারপরে অবশ্য ভ্যাবলারামের ভাগ্যে কী জুটেছিল তা এখনও জানা যায়নি, কারণ কুট্টিবাবুর সঙ্গে তার
কাট্টি,
মানে আড়ি, এখনও, আজ পর্যন্ত।
* - মাধবচন্দ্র পাল ও বিশ্বম্ভর লাহা
প্রণীত 'বত্রিশ সিংহাসন' পুস্তক থেকে।
(শেষ)
কুট্টিবাবুর মশক-অভিযান।
আমাদের মুচিপাড়ার প্রবীনতম বাসিন্দা চিরনবীন কুট্টিবাবু তাঁর সিরাজউদ্দৌলার সম্পত্তি থেকে নিলামে কেনা আরামকেদারাতে সকাল সকাল বসে বসে দোল খাচ্ছেন, এমনসময় ভোঁদড়, নেপাল আর গোবিন্দের হই-হই করে আবির্ভাব।
'বুঝলে কুট্টিবাবু, পড়াশুনা করে আর কী হবে?'- ভোঁদড়ের ব্যাকুল আক্ষেপ, 'বড়লোক হয়ে হয়ত দুটো টাকাই কামাতে পারব, নাম কামানোটা আর অত সহজ রইল না।'
'ব্যাপারটা কী বল দিকিন?' কুট্টিবাবু শুধোন, 'এখনও দাড়ি কামাতে শিখলি না, আর নাম কামাবার চিন্তা! ক্যান রে, তোকে আটকাচ্ছে কে?'
'মানে এই নিউটন-মার্কনিদের কথা বলছি। দুনিয়ার যেখানে যা কিছু দেখছি সব আবিষ্কার করে রেখেছে! আমাদের জন্যে আর কিছুই নেই।'
'আচ্ছা কুট্টিবাবু, সত্যি কি পৃথিবীতে কোনও প্রশ্নের উত্তর অজানা নেই?' নেপাল শুধোয়।
'আরে তোরা যেমন', কুট্টিবাবু ভরসা দেন।'অনেক প্রশ্নই এমন আছে যা লোকে জানে না, তায় উত্তর দেবে কী?'
'যেমন-'
'এই যেমন ধর, শ্রীলঙ্কার লঙ্কার থেকে আমেরিকার লঙ্কা কেন বেশি ঝাল? বম্বেটের উৎপত্তি কি বম্বে থেকে? সিং নেই, গর্জনটাও sing নয়, তবু সে সিংহ কেন? কোনটা বেশি ভয়ের, মেশিন গান না হিন্দি সিনেমার গান? ভূগোলের নম্বরের জায়গায় মাঝে মাঝেই জোড়া গোল বসে কেন...'
'থাক থাক, অনেক বুঝেছি', গোবিন্দ কুট্টিবাবুকে থামিয়ে দেয় মাঝপথে।
ইতিমধ্যে ভ্যাবলাকান্ত এসে হাজির হয়েছে। কুট্টিবাবুর মুগ্ধবোধ পরামর্শে কান দিয়ে ও সংস্কৃত খাতায় যা লিখেছিল তাই দেখে পরীক্ষক নাকি মুগ্ধ হয়ে নম্বর দিতেই ভুলে গেছিলেন। তারপরেই কুট্টিবাবুর সঙ্গে ভ্যাবলার কট্টি, মানে আড়ি। শেষে আর থাকতে না পেরে এই ক'দিন হল আড্ডায় আবার নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাই- আর কোন কথায় কান দেবেনা কুট্টিবাবুর।
আরে মোলো, চুপ করে কাঁহাতক থাকা যায়! পেটের মধ্যে মোচড় খেতে খেতে কথাটা শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই গেল।
'কুট্টিবাবু, এরকম কেন হয় বলতে পারো? বাবা জিগ্যেস করলেন, হ্যাঁরে তোদের অঙ্ক কে পড়ান? প্রহ্লাদবাবু বলতে গিয়ে ভুল করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল 'জল্লাদবাবু'।'
কুট্টিবাবু মিনিট দুই একটু হেঁঃ হেঁঃ করে হেসে আরাম-কুর্সিটায় একটু নড়ে-চড়ে নিলেন। তারপরেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন- 'হ্যাঁরে নেপাল, তোর ঠাকুমার দাঁত নড়ছিল, ভাল আছেন তো? ভোঁদড়ের ভাগ্নের অন্নপ্রাশন কেমন কাটল? উঃ, তুইও মামা হয়ে গেলি শেষ পর্যন্ত! বাপ্স্, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে হু হু করে! বিরাট শচিনের রেকর্ডটা ভাঙবেই একদিন, কী বলিস?......
'কুট্টিবাবু-', ভ্যাবলা শুরু করে।
'ও হ্যাঁ ভ্যাবলা', কুট্টিবাবু মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, 'তোর বাবা ভাল আছেন তো?'
'হ্যাঁ ভালই তো', ভ্যাবলা একটু থতমত খায়।
'আর তাঁর ছেলে?'
'ছেলে? এইত আমি এখানে!'
'সে তো দেখতেই পাচ্ছি জলজ্যান্ত চোখের সামনে। কিন্তু তার মস্তিষ্কের কোন কোষে কষে গিঁঠ না কি স্নায়ুতন্ত্রীতে গ্রন্থি পড়ে গেছে তা তো আমরা জানি না।'
'তার মানে? বলতে চাও আমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমি পাগল!'
'অত প্রাঞ্জল করে বলিস্নে বাপ! পাগলের নামেই আমার প্রাণ জল হয়ে আসে। পাগল আমিই, নইলে তোকে মুগ্ধবোধ শিক্ষা দিই, তোর মত 'মুগ্ধ', মানে মুর্খকে!'
'ঘাট হয়েছে কুট্টিবাবু', এইবার ভ্যাবলানন্দের মুখে হাসি ফুটল। 'মাপ চাইছি। যা হয়েছে, হয়েছে। আমার কথাটা শুনেছ? প্রহ্লাদবাবু-'
'ও, ভুলের কথা বলছিস? হ্যাঁ, ওই হল একটা শব্দ যা বিশ্বসুদ্ধু লোক ভুল বলে, ভুল পড়ে, ভুল উচ্চারণ করে, ভুল লেখে। 'ভুল' সম্বন্ধে সিংহমুন্ড মানে আমার বন্ধু ফ্রয়েড বলেছিলেন......'
এই ফাঁকে চুপিচুপি জানিয়ে রাখি, গোবিন্দদের সঙ্গে কুট্টিবাবুর একটা অলিখিত চুক্তি আছে যে গুলকে গুল বলে দাবী করা তো দূরের কথা, গুল ভাবতে পর্যন্ত পারবে না তারা, যদি তা কুট্টিবাবুর মুখনিঃসৃত হয়। সুতরাং......কুট্টিবাবু কী বলেন শোনাই যাক।
'......যাক্গে, কিছু একটা বলেছিলেন, অতশত মনে নেই, অনেকদিন হল কিনা! আচ্ছা একটা ঘটনা বলি, বললে তোরা কেউ বিশ্বাস করবি না-'
'একদম করব না, স্বচ্ছন্দে চালিয়ে যাতে পার।' গোবিন্দ আশ্বাস দেয়।
ইতিমধ্যে কুট্টিবাবুর মধ্যযুগীয় বান্দা হারুণ এসে দাঁড়াল। হারুণের পরণে বরাবরের মত চোঙা পাজামা, চিকনের কুর্তা, মাথায় মোগলাই পাগড়ি, হাতে ট্রে, তাতে পাঁচ কাপ গরম কফি। এটা আমাদের কুট্টিবাবুর বাসার আড্ডার একটা অন্যতম আকর্ষণ। কফিপান শেষ করে কুট্টিবাবু শুরু করলেন তাঁর কাহিনী।
* * * * *
'তবে শোন। স্বাধীনতার সময়কার ঘটনা, তখন আমি কলকাতায়। সেবার ভারত-পাকিস্তানের সাথে সাথে কলকাতার মশারাও যেন স্বাধীনতা ঘোষণা করল। রাস্তায়-ঘরে-বাইরে, আলসেয়-উঠোনে-ছাতে সর্বত্র সংঘবদ্ধ হয়ে তারা মশাদের জাতীয় সংগীত গাইতে লাগল-
জয় জয় মঁসিয়ে মশক মহাশয়,
মসীকালো মশানের ধারে-
জয় তার মশকেতে বয়
তাজা খুন যারা থরে থরে।
এইভাবে চলতে লাগল তাদের দাপট। মশাদের দাপটে তটস্থ হরিদাস পাল থেকে রাজ্যপাল, না রাজ্যপাল বস্তুটা তখন ছিল না, তবে গভর্নর ছিল, বেহাল নগরপাল- কেউ দিতে পারে না সামাল। প্রচণ্ড রায়ট শুরু হয়ে গেল। রক্তগঙ্গা বইতে লাগল। বড় বড় মশকে- মশক জানিস তো, রাজমিস্ত্রির ভিস্তিরা যে চামড়ার থলিতে জল বইত- ওই তাতে করে বড় বড় ব্লাড ব্যাঙ্ক ভর্তি করে তুলল। অবশেষে ডাক পড়ল আমার।'
'তোমাকে কেন? তোমার শরীরে আর কতটুকু রক্ত ছিল!' একটা খোঁচা দিল গোবিন্দ।
'কী বললি? ন্যাপলা!'
ইশারা বুঝতে নেপালের সময় লাগল না। মুহূর্তে হাজির হল 'ইন্টারাপ্শন ফাইন বক্স', একটাকা গচ্ছা গেল গোবিন্দের। এবার সন্তুষ্ট হয়ে কুট্টিবাবু আবার চালু করলেন তাঁর কাহিনী।
'তবে শোন। আমার হাতে দেওয়া হল মশক-বিতাড়নের দায়িত্ব। সাথে সাথেই আমি রওনা হয়ে গেলাম ওমান দেশের মশকাট শহরে, নিয়ে এলাম দুটো বড় বড় কামান।'
'কামান আনতে ওমান! কেন আন্দামানে পাওয়া যেত না?'
'মস্করা হচ্ছে! তার চেয়ে বলনা, বর্ধমান গেলেই হত। এ কি তোদের মসাগ্রামের মশা পেয়েছিস...এক একটা চড়ুইপাখের মত সাইজ, হ্যাঁ! যেমন মশা তেমনি তার কামান। একটা বসান হল মনুমেন্টের মাথায়- বনবন করে ঘুরছে আর গোলা ছুটছে শ্যামবাজার থেকে শ্যালদা, আলিপুর থেকে আউট্রাম ঘাট।অন্যটা থাকল উল্টোডাঙা ব্রিজের উপর, তার লং রেঞ্জ, গোলা ছুটছে টালা থেকে টালিগঞ্জ, বালি থেকে বালিগঞ্জ! সে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ। ভাবলাম বুঝি এবার পোস্থুমাস অ্যাওয়ার্ড-ফ্যাওয়ার্ড পেয়ে যাব কিছু একটা।'
'পোস্থুমাস কেন গো? সে তো মরণোত্তর, বেঁচে থেকে পাওয়া যায় নাকি?'
'তা হবে। বেশ গালভরা কথাটা, তাই না ভেবে বলে ফেললাম। যাকগে, একটা পরমবীর চক্রও তো পেতে পারতাম!' কুট্টিবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন এবার।
'তারপর? মশারা দূর হল?' চারজনেরই উৎসুক প্রশ্ন এবার।
'বুঝলি ভ্যাবলা, সকলই কপাল! আসলে সেদিন বাজারে শুনছিলাম একজন পূর্ববঙ্গীয় বয়স্ক ভদ্রলোক দোকানদার বন্ধুকে বলছেন- 'দ্যাস ভাগ হইসে কত্তা, দুই দ্যাসে দাঙ্গা। ঢাকা-বরিশালের মাইন্স্যে দলে দলে আইসে, চাউলের দাম বাড়বা। এই ত সুযোগ, মশায় কামান, এই সুযোগে কামান!
ব্যস, রাত্রে গণ্ডগোলে আর ঘুম আসে না। শুধু মনে পড়ছে 'মশায় কামান', আর বাইরে রায়টের দাপট, গুড়ুম গুড়ুম বোমা আর পুলিশের বন্দুকের আওয়াজ! দুঃস্বপ্ন কি আর সাধে হয়! এইজন্যেই তো সিংহমুণ্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন.........।'
বলা বাহুল্য, কী যে বলেছিলেন সেটা আর সম্পূর্ণ করেন না কুট্টিবাবু।