Tuesday, August 27, 2019

মজার গল্প- গুল-বাঘা

গুল-বাঘা।
(মজার গল্প)

আমার একটি পাতানো ভাগ্নে আছে। ভাগ্নে হলেও যখন থেকে সে ডায়মন্ড হারবারে একটা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ঢুকেছে, আমার সাথে সমবযস্কতার দাবি করে। এখন নাকি সে প্রেম-টেমও করে। সে করুক গে, আমার বয়েই গেছে। পরের ছেলে বয়েই যাক আর উচ্ছন্নে, আমার কি তাতে?
একবার গঙ্গাসাগর দেখতে ডায়মন্ড হারবারে ড্রপ করেছি, ভাগ্নে-রত্ন খবর পেয়ে হোটেলে এসে হাজির। একথা-সেকথার পর ওর আবদার হলো, দু-একটা উর্দু শের লিখে দিতে হবে, আজকাল ফিউশনের যুগ, ভ্যালেনটাইন কার্ডে নাকি শের-শায়রী গার্ল-ফ্রেন্ডরা খুব খাচ্ছে। বোঝো কথা! সুন্দরবনের এত কাছে থেকে কিনা শের যোগাড় করতে বোম্বাইয়া মামা! যাক, কথা দিয়েছি, একটা মনে ছিল, লিখে দিলাম কাগজে-
'পাত্তা পাত্তা, বুটা বুটা, হাল হামারা জানে,
জানে না জানে, গুল হি না জানে, বাগ ইয়ে সারা জানে।'
লাইন দুটো পড়ে ভাগ্নের মুখ গম্ভীর, 'মামা, তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছ? এই শের ভ্যালেনটাইন-এ চলবে!'
আমি অবাক হয়ে বললাম, 'কেন, খারাপ কি? তুই জানিস, এটা কার?'
-'হাঁ, মেহেদী হাসানের গজল তো, দিল্লির তখনকার সর্দারজী হোম মিনিস্টার বুটা সিং-কে নিয়ে।'
আমি ঘাবড়ে একটা খাবি খেলাম। 'এর মানে জানিস?'
- 'মোটামুটি বুঝতে পারি। আমাদের বুটা সিং খুব ভাল তাস খেলে, প্রত্যেকটা পাত্তার হালচাল ঠিকঠাক বলে দিতে পারে। তাই বলে ভেবোনা সে গুল দেয়। গুল মারতে বাঘের মত কেউ জানে না, বাঘ সবকিছুই জানে।'
সুন্দরবনের বাঘ নিশ্চয় ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত আসে না, তাহলে নির্ঘাত আমাকে খেয়ে ফেলত। আর খেয়ে যে ফেলেনি, তারই বা নিশ্চয়তা কি? বাঘ যে আবার গুল মারতে ওস্তাদ!
(সব চরিত্র কাল্পনিক, বাঘ ছাড়া)

স্মৃতিচারণ- ঈশ্বরদর্শন।

ঈশ্বরদর্শন।

এই বর্ষণমুখরিত দিনে ১৯৭৮এর বন্যার বিধ্বংসী চেহারা নিয়ে স্মৃতিচারণ হচ্ছিল, চোখে পড়ল কলকাতা-বিশেষজ্ঞ ডাঃ সিদ্ধার্থ মুখার্জির শ্রী দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে লেখা একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমার তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবু যেটুকু হয়েছে তাকে কবিগুরুর ভাষায় বলা চলে 'এসেছিলে তবু আস নাই, জানায়ে গেলে'।
ভাবতাম কলকাতার বাসিন্দারা ভাগ্যবান, চাইলেই ঈশ্বরকে দেখতে পান। আমি থাকি অনেক দূরে, জানিনা ভগবানের ঠিকানা। তাছাড়া খবর পেয়েছি যে তাঁকে আজকাল গান গাইতে দেওয়া হয় না। ভাবতাম এটা কি ইংরেজ শাসনের প্রলম্বন, যে সম্ভাবনার কথা নজরুল লিখে গেছিলেন তাই কি সত্যি হল!
'হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি,
সর্বনাশী শেখায় এ হীন তথ্য কে রে?'
তাহলে? ১৯৭৮এ হঠাৎই সুযোগ হয়ে গেল শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেখতে যাওয়ার, আমাদের বন্ধু বাবুইয়ের হোস্টেলের অতিথি হয়ে। অজয়-ময়ূরাক্ষী-দামোদরের বন্যার বছর সেটা, বাসে ইলামবাজার পেরোবার সময় গাছের ডালে গরুর কংকাল ঝুলতে দেখে শিউরে উঠেছিলাম। সেদিন ৭ই পৌষ সন্ধ্যেয় মেলা তখনও জমে নি তেমন। ফেরার পথে স্টেট ব্যাঙ্কের দরজার মুখে সিঁড়িতে এক মাতালকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। বন্ধু বলল, প্রণাম কর, ইনি রামকিংকর বেইজ। সত্যি, কি নেশা আছে এখানকার জলে-হাওয়ায়-মাটিতে দুনিয়ার যত পাগল-মাতাল-নেশাখোর বলরামের চেলারা ভীড় করেছেন এখানে। আমাদের এই ভগবানও তো পাগল, বুঁদ হয়ে আছেন এক অনন্য নেশার বন্ধনে, তার নাম রবি ঠাকুরের গান।
সকালে পৌষালু শীতের কবল থেকে বেরোতে একটু সময় লেগে গেল। মেলার মুখে দেখি আরে, রবি ঠাকুর বেহালা নিয়ে বসে বাজাচ্ছেন- 'তোমার খোলা হাওয়া'। একটু কাছে যেতেই বুঝলাম, ইনি রবি ঠাকুর হতেও পারেন, আবার নাও হতে পারেন। ইনি হয়ত দাদাঠাকুর বা ধনঞ্জয় বৈরাগী বা 'অচলায়তন' ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই গুরু। বিশ্বভারতীর স্টলে দূর থেকে দেখছি খুব ভীড়। একজন গেরুয়া পরা ভদ্রলোক খোলা গলায় গাইছেন-
"কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সংকেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।"
মনে হল এই শীতের সকালে যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। না, কাছে গিয়ে দেখি সুচিত্রা মিত্র আর অশোকতরু বসে আছেন। জানা গেল, দেবব্রত বিশ্বাস এইমাত্র স্টল থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, ঈশ্বরকে পেতে যে সাধনার প্রয়োজন তা হয়ত আমার ছিল না।

স্মৃতিকথা- মুর্গীর হালুয়া।

ছেলেবেলার গল্প
মুর্গীর হালুয়া।
আমরা ছোটবেলায় সিন্দ্রির একটা কলোনিতে থাকতাম। সিন্দ্রি সার কারখানার কলোনিগুলো বেশ খানিকটা কসমোপলিটান চরিত্রের ছিল। পাশাপাশি আর মুখোমুখি প্রতিবেশিদের মধ্যে ছিলেন আমরা ছাড়াও দুটি বাঙালি, দুটি বিহারী, উত্তর প্রদেশীয়, পঞ্জাবী আর গুজরাটি পরিবার একটি করে। পাশের পাশের কোয়ার্টারে থাকতেন রায়বাবু, সাদাসিধে বিহারী ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক, পরিবার গ্রামের বাড়িতে রেখে একাই থাকতেন। ভোর না হতেই তাঁর 'রঘুপতি রাঘব রাজারাম/ পতিতপাবন সীতারাম' শুনে পাড়া-প্রতিবেশিদের ঘুম ভাঙত বলে আমার ছোট বোন ওঁর নামই রেখেছিল 'সীতারাম'।
আমার বোন তখন বছর তিনেকের হবে। দিনের সময়ের অন্ততঃ ঘন্টাতিনেক ওর কাটত সীতারামের বাসায়, গল্প করে আর টুকটাক এটা সেটা খেয়ে। আমরা মজা করে বলতাম মিনি-কাবলিওলার জোড়ি।
একদিন সকালে বোন রায়বাবুর বাসা থেকে আসছে মুখ মুছতে মুছতে। জিগ্যেস করলাম, কি রে কী খেলি?
- মুলগির হালুয়া, অম্লানবদনে বলল ও।
মুর্গি! বাবা অবাক। আমাদের বাসায় মুর্গি ঢোকেনা তখনও। দাদু-ঠাকুমা বা গ্রামের লোক জানতে পারলে হুলস্থুল বেধে যাবে। 'হ্যাঁরে, সত্যি বলত কী খেয়েছিস? বোনকে ঝাঁকিয়ে শুধোন বাবা।
- মুলগির হালুয়া, না না পায়েস, না হালুয়া। কনফ্যুজড উত্তর আসে।
শেষমেষ বিকেলে অফিস-ফেরতা সীতারামকে ধরা হল। বাবা বললেন, ক্যা রায়বাবু, মুরগি খিলা দিয়ে মেরি বিটিয়া কো?
- রাম রাম, বোলেন কী? হামি আউর মুরগি! হাম ভুমিহার ব্রাহ্মণ হ্যায়, রায় হামারা উপাধি আছে। আরে চটারজিবাবু, হাম তো পেঁয়াজ-লসন ভি নেহি খাতে!
- তাহলে সকালে কী খাইয়েছেন বলুন তো আমার মেয়েকে? ও তো বলছে মুরগির হালুয়া। শুনে রায়বাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।
- ও হো, অব সমঝে। সুবহ হাম থোড়া মুংগদাল কা হালোয়া বনায়ে থে, ওহি থোড়া দিয়া খুঁকুমনি কো। দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠেন এবার।
আমার বোন ভয়ে ভয়ে কোন একটা শাস্তির অপেক্ষা করছিল, ও অবাক হয়ে থাকিয়ে রইল দুজনের দিকে।

স্মৃতিকথা- বাদলের ধারাপাত

বাদলের ধারাপাত।
(স্মৃতিকথা)


কাল সকাল থেকেই প্রচণ্ড গরম, সেই সঙ্গে প্রায় নব্বই শতাংশ আর্দ্রতা। হাঁসফাঁস অবস্থা। বিকেলে সাউথ আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ দেখব বলে টিভি চালিয়েছি, দেখি খেলা বন্ধ, ইংলন্ডে তুমুল বৃষ্টি। এত রাগ হচ্ছিল ইন্দ্রদেবতার একচোখোমির জন্যে! এমন সময় কড়-কড়-কড়াৎ - মেঘের গর্জন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুরু হল প্রবল বর্ষণ, সাথে ঝড় আর বজ্রপাত। কম্পাউণ্ডের বাইরের রাস্তার ধারে মড়-মড় করে একটা গাছ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শোনা গেল। টিভি সেটের সব কানেকশন খুলে জানালার ধারে একটা চেয়ার নিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখতে বসলাম। মুহূর্তে চোখের উপর ভেসে উঠল পঞ্চাশেরও বেশি বছর আগেকার একটা ছবি। ভুলে যাওয়ারই কথা, তবে এই বর্ষার শুরুতে কবির মনে যদি দু-আড়াই হাজার বছর আগের উজ্জয়িনীর ছবি, রেবানদীর তীরে কোন এক মালবিকার অনিমিখে চেয়ে থাকার দৃশ্য স্মরণে আসতে পারে, আমারও বাল্যের স্মৃতি ফিরে আসতে দোষ কিসের?
আমার বয়স তখন ছয় কি সাত, বোন আরো তিন বছরের ছোট। বাইরে বৃষ্টি শুরু হলেই বাইরের ঘরের খোলা জানলার বাইরেটা ছিল আমাদের ভাই-বোনের বিশ্বজগৎ। জানালার পাশেই বাবার কাঠের চেয়ার, একটু ভেতরের দিকে লেখার টেবিল। ওই একটা চেয়ারে দু'জনে কি সুন্দর হাঁটু মুড়ে বসে বাইরের পৃ্থিবীটাকে দেখতাম, এখন ভেবে অবাক লাগে হয়ত ওই চেয়ারে এখন আমার একারই বসতে কষ্ট হবে।
জানালার বাইরে বারান্দা, তাই আমরা ভিজছি না, অথচ সব দেখতে পাচ্ছি। আমাদের তখন বাগান ছিল না, সামনের বাড়ির রাজুদেরও বাগান নেই। তার পাশে রাস্তা, একটা কুকুর রাস্তা পার হয়ে ছুটে এসে রাজুদের বারান্দায় বসল, ওটা আমাদের বাসায় কেন এল না সেই ভেবে বোনের চোখ ছলছল করে উঠল। এমন সময় সারা শরীরে একটা ঝটকা খেলাম, তবে তেমন কিছু নয়, সাথে সাথেই চড়-চড় করে মেঘ ডেকে উঠল। বোনকেও বলিনি, মায়ের কানে গেলে আমাদেরকে ওখান থেকে চলে আসতে হবে। আজ বুঝতে পারি, জানালার শিক ধরে বসায় বিদ্যুতের একটা হাল্কা শক লেগেছিল, তবে চেয়ারের ইন্স্যুলেশন থাকায় কোন ক্ষতি হয়নি।
আমার ছেলেবেলায় একটা আবোল-তাবোল বই ছিল। তার যাবতীয় ছড়া আমি বোনকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলাম। ঘরে কেউ এলেই ওর হাতে উঠে আসত বইটা, উলটো করে ধরেই পড়ে চলত- 'সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি,/ কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট কেন খেলে রাজার পিসি?' আজ আমার স্কুল নেই, পরিস্থিতি অনুকূল দেখে বোন বলল, 'দাদা আজকে কোন ছড়াটা শেখাবি রে? বই নিয়ে আসি?' ইতিমধ্যে কাকা ধানবাদের কলেজ থেকে ছুটিতে এসে আরো দুটো বই কিনে দিয়ে গেছেন, সুকুমার রায়েরই খাই খাই আর বহুরূপী। আমি কি ভেবে খাই-খাইটা নিয়ে এলাম। বোনটি আমার ছিল প্রায় শ্রুতিধর, কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে শুরু করে দিল-
"জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত-
অফুরান্‌ নামতায় বাদলের ধারাপাত।
.........স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়,
নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায়।"

বাংলা কবিতা- ন্যাড়ার গান

ন্যাড়ার গান।।

আজ আমাকে গাইতে তোমরা বোলো না।
সত্যি বলছি আজকে আমার গলাই তেমন খুলবে না।
আজকে দেখি জগৎসভায়, হোমরা-চোমরা এল সবাই
কে যে করে কাদের বিচার কেউ তাকিয়ে দেখছে না,
কাল যে ছিল আমার চেনা, আজ তারা কেউ চিনছে না!
লুট না কোতল, রেপ নাকি খুন, কেই বা রাখে খবর তার
নক্রভায়ার বক্র মেজাজ, চক্ষে ছোটে অশ্রুধার।
আজব দেশের বিচারশালায় আইন-দেবী হন কানা
হুতোমপ্যাঁচা হাকিম সেথায় আলোয় তিনি দেখেননা

ন্যাড়া ছিল বেলতলাতে, আপন মনে গাইছে গান
নেই সে কোনও সাতে-পাঁচে, তাও বলে তায় পাকড়ে আন।
কার হল জেল, কার যে ফাঁসি, কেউ ত মাথা ঘামায় না,
যাদের চক্রে ভূত-ভগবান, কেউ ত তাদের থামায় না!
আজব দেশের বিচার সভায় চাও যদি ভাই রাখতে প্রাণ,
গাইছে রাজা হুক্কা হুয়া, তার সুরেতে মেলাও তান।

বাংলা অণু-গল্প- মিথেন

মিথেন।
(অণু-গল্প)

- 'কী হল, এখনো পারলে না? হাফ অ্যান আওয়ার মোর।'
- 'এই যে স্যার, হয়ে এল। কোনমতে বললাম।' আসলে তো কিছুই হয় নি। দু-ঘন্টা ধরে ঠায় বসে আছি। পরীক্ষকের চেয়ারে বসে প্রফেসার সাহু, রসায়নজ্ঞ, তবে মোটেই রসিক নন। কী একটা যাচ্ছেতাই এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন, মাথামুণ্ডু কিছুই ঢুকছে না মাথায়।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এম-এস-সি নয়, বি-এস-সিও নয়, জাস্ট বারো ক্লাসের মানে হায়ার সেকেন্ডারির কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা। আর এই সেই প্রফেসার সাহু, যাঁর প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে অনিমেষ একবার পটাসিয়াম ক্লোরেটকে গরম করে পটাসিয়াম ক্লোরাইট, অক্সিজেন আর সালফার পেয়েছিল। ও ইম্‌প্যোরিটি ভেবে ভয়ে সালফারটা না লেখাতে সাহু ক্ষেপে গেছিলেন, অনেক যত্নে উনি গুঁড়ো করে মিশিয়েছিলেন কিনা! আজ আমার ফাইনাল পরীক্ষায় ল্যাবে বসেছেন তিনি! অন্যরা তবু সল্ট টেস্ট বা টাইট্রেশন পেয়েছে, আমার ভাগ্যেই পড়েছে অদ্ভূত একটা এক্সপেরিমেন্ট, মিথেনে কার্বন-হাইড্রোজেনের বন্ড অ্যাঙ্গেল বের কর।
কী কাণ্ড! বইয়ে পড়েছিলাম বটে ১০৯ না কত ডিগ্রি হয়, সেটা আবার বের করব কী করে? এরকম তো কিছু পড়িনি কখনও। এদিকে ভাবতে ভাবতে দু-ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, গা-হাত-পা ঘামতে শুরু করেছে। এইবার সাহু দেখছি আমার দিকে এগিয়ে আসছে, ধীরগতিতে কিন্তু ক্রুরদৃষ্টিতে চেয়ে।
- 'কী হে, মিথেন দেখনি কখনও? হ্যাভ ইয়ু নেভার সীন মিথেন?'
- 'না স্যর।' আমি অকপটে স্বীকার করলাম। 'তবে আলেয়া দেখেছি, শুনেছি জলাভূমিতে মিথেন জ্বলে আলেয়া হয়।'
- 'শাট আপ!' এবার স্যর ধমক দিলেন। 'মাথার উপরে তাকিয়ে দেখ, কী ঝুলছে?'
দেখছি। বহুদিন ধরেই ঝুলছে ওটা। একটা কাঠের তৈরি লাল গোলক, মধ্যে C লেখা, আর চারপাশে চারটে কাঠি দিয়ে চারটে সবুজ রঙের ছোট ছোট বল আটকানো, সাদা রঙে পষ্টো লেখা H.
- ' গট এ প্রট্র্যাক্টার? চাঁদা?' আবার গর্জন করলেন সাহু।
- 'চাঁদা? না তো স্যর।' আমি ভেবে পেলাম না কেমিস্ট্রিতে চাঁদা দিয়ে কী হবে।
- 'ইডিয়ট! গেট এ চাঁদা অ্যান্ড মেজার দ্য অ্যাঙ্গল। গো, ফাস্ট!'
কী মুস্কিল, চাঁদা কোথায় পাই এখন? চাঁদা...চাঁদা...ভাবতে ভাবতেই পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঘন্টা বেজে উঠল। চমকে উঠে বসলাম।
কোথায় সাহু, কোথায় ল্যাব? তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখি পাড়ার ছেলেরা, সরস্বতী পুজোর চাঁদার রসিদ-বই হাতে। 'কাকু চাঁদা। সকালে দেবেন বলেছিলেন।' মনে পড়ল কাল এরাই এসেছিল, ভাগিয়ে দিয়েছিলাম কাল সকালে আসিস বলে। আরো বলেছিলাম মা সরস্বতীর পাঁচটা নাম মুখস্থ করে আসতে।
হে মা সরস্বতী! দোহাই তোমার, পাঁচটা প্রতিশব্দ তো দূর, সরস্বতী বানানও কাউকে কখনও শুধোব না, একবাক্যে চাঁদা দিয়ে দেব। শুধু যেন এরকম দুঃস্বপ্ন কখনও কাউকে দিও না। 

Thursday, August 22, 2019

অভিশপ্ত পাঁচের জুলাই। স্মৃতিচারণ

অভিশপ্ত পাঁচের জুলাই।

(১) 
অতিবৃষ্টি

২০০৫ সালের ২৬শে জুলাই, মুম্বাই।  আকাশের মাঝামাঝি মনে হয় মস্ত একটা ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে  সুকুমারের ভাষায়-
"জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত।
অবিরাম নামতায় বাদলের ধারাপাত।"
২৬শে জুলাই, ২০০৫। শুধু এটুকু বললেই সেই সময়কার  মুম্বাই  শহরের বাসিন্দাদের শিরদাঁড়া বেয়ে এখনও একটা ঠাণ্ডা শিহরণের স্রোত নেমে যায়।  ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৯৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি!

পূর্বাভাস ছিল। তা সত্ত্বেও মুম্বাই প্রশাসন অফিস-বাজার-স্কুল-কাছারি কিছুই বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় নি। আর মুম্বাই সদাব্যস্ত শহর। এখানে আজ পর্যন্ত দু-চারটে দিনই জনজীবন স্তব্ধ থাকতে দেখেছি। তার একটা ৮৪ সালে ইন্দিরা হত্যার পরের দিন, ৯২এর দাঙ্গার একটা দিন আর ২০০২ তে বাল ঠাকরে গ্রেফতারের দিন। আজ কিন্তু পরিস্থিতি কতটা সাঙ্ঘাতিক হতে পারে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। সকালে সবাই অফিস গেছে, বাচ্চারা স্কুল-কলেজ গেছে, দোকানপাট খুলেছে, লোকাল ট্রেন, বাস, ট্যাক্সি, মায় অটো পর্যন্ত চলছে, আর তার সঙ্গে জোরালো বর্ষণ।

ঠিক দুপুর দু'টোর সময় আরব সাগরে জোয়ার এল। সঙ্গে সঙ্গে শহরের জল নিষ্কাশন-ব্যবস্থার ইতি, সমুদ্র-উপকূলবর্তী এলাকাগুলোতে জল বাড়তে লাগল হু-হু করে। ঠিক আড়াইটায় ট্র্যাকে জল জমে প্রায় সমস্ত লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। মুম্বাইয়ের বাসিন্দা সভয়ে জানল যে স্টর্ম-ওয়াটার ড্রেনেজ সিস্টেমের ১০৫টি খালের মধ্যে মাত্র তিনটির গেট কাজ করছে, বাকিগুলো বন্ধ হচ্ছে না বা গেট নেই। রিয়েল-এস্টেট মাফিয়া- রাজনৈতিক নেতা চক্রের চক্রান্তে শহরের অর্ধেক ম্যানগ্রোভ জঙ্গল উড়ে গেছে। অতএব উপচে পড়া স্টর্ম-ওয়াটার আর রিট্রীটেড হাই-টাইডের জল ধারণের উপযুক্ত কিছু আর নেই। বাকি যা ছিল শহরবাসিদের সঠিক চেতনার অবর্তমানে প্লাস্টিক তার নিজের কাজটুকু করেছে, অর্থাৎ যেটুকু নালার বহনক্ষমতা ছিল তার অধিকাংশই আটকে আছে প্লাস্টিকে।

এবার আমার কথায় আসি। আমার বাড়ি আন্ধেরি ইস্টে মহাকালী গুহা অঞ্চলে, সেখান দিয়ে ঢালু পাহাড়ি পথ পশ্চিমে সমুদ্রের দিকে চলে গেছে। তাতে জল জমে না, দুরন্ত স্রোতে বয়ে যায়। কিন্তু প্লাস্টিকের আশীর্বাদে জলবাহী নালাগুলি বন্ধ, তাই সেগুলো উপচে পড়ে জল বইছে রাস্তার উপর দিয়ে। নালাতে যে একবার পড়েছে তার মৃতদেহ ভেসে উঠেছে ছ-সাত কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের কাছে- ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমি কিন্তু শহরে নেই, আছি শহর থেকে ১৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরব সাগরের মাঝে। পাগলের প্রলাপ নয়। সত্যিই আমার দায়িত্বে তখন ওএনজিসির রিগ সাগর-রত্ন, চেয়ারম্যানের নির্দেশে ISO 9001 সার্টিফিকেশন অডিটের প্রস্তুতির জন্যে আমি, রিগ ম্যানেজার সহায় আর মেকানিক্যাল বিভাগের নান্দেডকার সেখানে বসে আছি তিনদিন ধরে। মুম্বাইয়ের বৃষ্টি পরিস্থিতির কথা টিভির খবরে শুনছি আর মনে মনে আতঙ্কিত হচ্ছি, পরিবারের মানুষরা কিভাবে আছে ভেবে। নান্দেডকার মুম্বাইয়ে আমার প্রতিবেশি, হাঁটাপথে পাঁচ মিনিটের দূরত্ত্বে থাকি আমরা। আমার মেয়ে ক্লাস সেভেন্থ আর ওর ছেলে ফিফথে পড়ে জুহুর মানেকজি কুপার স্কুলে।  ইতিমধ্যে সন্ধের সময় নান্দেডকার ছুটে এসে জানাল, মানেকজি কুপার স্কুলের বাস বাচ্চাদের নিয়ে ফেরেনি, ওর আর আমার ছেলেমেয়েরা কোথায় কী অবস্থায় আটকা পড়ে আছে তা কেউ জানে না।

আমাদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। তখন অফশোর ইন্সটলেশনে মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে দেওয়া হতনা, রিগের স্যাটেলাইট সার্ভিস দ্বারা কানেক্টেড ল্যান্ডলাইন টেলিফোনই ভরসা কিন্তু মুম্বাইয়ের সমস্ত টেলিফোন সিস্টেম অচল, কাউকে ধরা যাচ্ছে না। ভাবছি বাড়িতে কী অবস্থা চলছে, নিশ্চয় কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। সব রাস্তা বন্ধ, কোথাও যাবারও তো উপায় নেই। শেষে রাত দশটায় খাসনবীসদাকে ধরা গেল, ওঁর মেয়েও আমার কন্যার সহপাঠী। জানতে পারলাম, জল বেড়ে স্কুল বাসের অর্ধেকটা ডুবে যায়, জুহু ভিলে-পার্লে স্কীম পাড়ায় বাস দাঁড়িয়ে যায়। বাচ্চাদের কান্নাকাটি করতে দেখে আশেপাশের সোসাইটির কিছু সহৃদয় মানুষ এগিয়ে এসে বাচ্চাদের নিজের বাসায় নিয়ে যান।  খাবার-দাবার জুটেছে কিনা জানিনা, তবে রাত্রির জন্য নিরাপদ আশ্রয় মিলেছে জেনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম। পরদিন সকালে খাসনবীসদা খোঁজ নিয়ে গিয়ে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

২৭শে জুলাই, সকাল ন'টা। আমি আর নান্দেডকার দু'জনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম জেনে যে আমাদের ছেলেমেয়েরা নিরাপদে বাড়ি ফিরেছে। মুম্বাইয়ের অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির যা খতিয়ান জানানো হচ্ছে টিভি নিউজে, অত্যন্ত ভয়াবহ। ২৬শে জুলাই সকাল থেকে ২৭শে জুলাই সকাল পর্যন্ত একটানা ৯৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে ২৪ ঘন্টায়, যেটা একরকম রেকর্ড। মুম্বাই এয়ারপোর্টের রানওয়ে টানা ৩০ ঘণ্টা বন্ধ ছিল জল জমে থাকায়, এটাও একটা রেকর্ড। এছাড়া সেই রাত্রে অগুন্তি সাধারণ মানুষ ট্রেন, বাস, গাড়ি থেকে নেমে মাইলের পর মেইল হেঁটে বাড়ি ফিরেছে, অনেকে সেই রাতে ফিরতে পারেন, কারো বাসায় বা রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। আমার মেয়ের কথা তো বললাম, আমাদের কোম্পানির চিফ জিওলজিস্ট পিনাকীদার মেয়ে বাসা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ত, সে তো অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে কলেজের ক্লাসরুমেই থেকে গেছে। আবার অনেকের আর এ জন্মে বাড়ি ফেরা হয়নি, খোলা ম্যানহোল বা নালায় পড়ে কোথায় কয়েক মাইল দূরে পরদিন উদ্ধার হয়েছে হতভাগ্যদের মৃতদেহ। পোলে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন দুয়েকজন। আবার এমনও হয়েছে, অত্যাধুনিক অটোমেটিক গাড়ির সওয়ারি, পয়েন্টে জল ঢুকে ইঞ্জিন বন্ধ, ফলে মোটর-চালিত জানলা খোলেনি, জলের চাপে দরজা বন্ধ- বদ্ধ গাড়িতে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাঁকে। সৌভাগ্য, না দুর্ভাগ্য বলব, বাড়ি থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে সমুদ্রে বসে এসব ভোগ করতে পারিনি, তেমনি কাউকে কোন সাহায্যও করতে পারিনি। কিন্তু সাক্ষী হয়ে থেকেছি বিশ্বের শিল্পোদ্যোগের ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে থাকা এক বিশাল দুর্ঘটনার।



 (২) 
বাড়বাগ্নি- ভস্মীভূত প্ল্যাটফর্ম।



ONGCর তৈলক্ষেত্র বোম্বে হাই (অধুনা মুম্বাই) মুম্বাই উপকূল থেকে ন্যুনাধিক ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে আরব সাগরে অবস্থিত, ১৯৭৪ থেকে আজ পর্যন্ত যার দানে সমৃদ্ধ হয়েছে ভারতের অর্থনীতি, ঔদ্যোগিক বিপ্লব এসেছে এদেশে। এখানে তিন রকমের প্ল্যাটফর্ম ছিল, ড্রিলিং-কাম-প্রডাকশন বা ওয়েল-হেড প্ল্যাটফর্ম, লিভিং কোয়ার্টার্স ও প্রসেস প্লাটফর্ম। বম্বে হাইয়ের নর্থ প্ল্যাটফর্ম কমপ্লেক্স পরস্পর সেতু-যুক্ত চারটে প্ল্যাটফর্ম নিয়ে তৈরি হয়েছিল- ওয়েল-হেড প্ল্যাটফর্ম NA, যার জ্যাকেটে অবস্থিত ছটি তৈলকূপ থেকে তেল-গ্যাস উৎপাদন হত, সেখানে ওয়ার্ক-ওভার রিপেয়ারের কাজ করছিল নোবেল চার্লি ইয়েস্টার (NCY) নামক জ্যাক-আপ রিগ। এছাড়া ছিল সাততলা উঁচু BHN মেন প্রসেস, MHW নামে এক অতিরিক্ত প্রসেস আর MHF নামে কর্মীদের থাকার জন্যে লিভিং প্ল্যাটফর্ম। এছাড়াও বম্বে হাই নর্থে কাছাকাছি আরো ১১টি প্রডাকশন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাইপলাইন-বাহিত হয়ে আসত তেল ও গ্যাস, প্রাথমিক পদ্ধতির পর সবকিছু পাইপে পাঠানো হত সমুদ্রতীরস্থ উরান প্ল্যান্টের প্রাথমিক শোধনাগারে সহ খনিজ তেল স্থিরীকরণ কেন্দ্রে (Primary Processing and Crude Stabilization Unit)। BHN Complexএর কাছেই কাজ করছিল সমুদ্র-সুরক্ষা নামের নানা-কাজের উপযোগী জাহাজ (Multipurpose Support Vessel বা MSV), পাঁচজন ডুবুরী ডাইভিং-এর কাজ সেরে বেসমেন্টের ডিকম্প্রেশন চেম্বারে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছিলেন। এমন সময় একজন রাঁধুনী তার আঙুল কেটে ফেলায় উপযুক্ত চিকিৎসার জন্যে তাকে ক্রেনের সাহায্যে বিএইচএনে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। জুলাই মাসের ভরা মনসুন, সমুদ্র উত্তাল, ৩৫ নট বেগে হাওয়া বইছে- অথচ সমুদ্র সুরক্ষার সমুদ্রে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার উপযোগী Dynamic Positioning System (DPS) ঠিকঠাক কাজ করছিল না। তাই তাকে যেতে হয় প্ল্যাটফর্মের অনেকটা কাছে আর তখনই ঘটে যায় দুর্ঘটনাটা। জাহাজের আঘাতে একটা গ্যাসের পাইপ ফেটে আগুন লেগে যায়।

২৭শে জুলাই, ২০০৫। তখন চারটে বাজে ছয়-সাত মিনিট। সাগর-রত্ন রিগের ইনচার্জের অফিসে বসে আছি আমি, সহায়, রাজেন্দ্র সিং, নান্দেডকার, বার্জ ইঞ্জিনীয়ার জোজি জন আর রেডিও অফিসার প্রদীপ সামেল। সকালে ছেলেমেয়েদের নিরাপদে বাড়ি ফেরার খবর পেয়ে গেছি, তাই বেশ আনন্দের সঙ্গে আড্ডা ও কফিপান করছি সবাই মিলে। এমন সময় ইলেকট্রিক্যালের চিফ অজয় ছুটতে ছুটতে বাইরে থেকে এসে জনকে বলে- 'জোজি, দূরবীন দো, BHN মে কুছ জল রহা হ্যায়।' আমি স্যামেলকে রেডিও-রুমে খবর নিতে বলে ছুটলাম বাইরে, ফরোয়ার্ড জ্যাকহাউসের ওপর।

সত্যিই কিছু একটা জ্বলছে, তবে তা যে সমস্ত প্ল্যাটফর্মটাকে পুড়িয়ে ফেলবে এতটাও ভাবিনি। ৫-৬ কিলোমিটারের দূরত্ব, দূরবীনও লাগল না- ৪ঃ০৫ থেকে ৪ঃ৩০ এর মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেল গোটা প্ল্যাটফর্ম। সম্পত্তির পরিমাণের কথা পরে, ২২৭ জন বিএইচএনে ৮৪ জন সমুদ্র সুরক্ষায়, ৭৩ জন NCY রিগে। চতুর্দিকে লাইফ-বোটে যাত্রীরা নেমে পড়ল, অনেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিল আতঙ্কে, 'সুরক্ষা'র ক্রু নেই, দিশাহারা হয়ে চলতে শুরু করে দিল জাহাজটি। নেভি, কোস্ট-গার্ড আর আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কার্যরত বিভিন্ন সামুদ্রিক জাহাজ ছুটে এল উদ্ধারকাজে। আমাদের সামেল রেডিও নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 
হঠাৎ দেখি দিশাহীন সমুদ্র সুরক্ষা এগিয়ে আসছে আমাদের রিগের দিকে। সর্বনাশ, কন্ট্রোল করার যে কেউ নেই, ধাক্কা লাগলে আমাদের কাউকেই আর দেখতে হবে না- SOS কল পাঠানো হল চতুর্দিকে। সুখের কথা শিপিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার একটি জাহাজ এগিয়ে এসে জলের জেট ছুঁড়ে সুরক্ষার মুখ ঘুরিয়ে দিল, আমরা বেঁচে গেলাম। সামেল ওদের জানাল যে পাঁচজন ডাইভারকে উদ্ধার করতে হবে ডিকম্প্রেশন চেম্বার থেকে। নাবিকদের তৎপরতায় আর চেষ্টায় সেটাও সম্ভব হল। 

একটা প্রশ্ন তবু থেকেই যায়। সেফটি বা সুরক্ষার তো এত ব্যবস্থা থাকে সমুদ্রস্থ তেলের রিগ বা ইন্‌স্টলেশনগুলোতে। তা সত্ত্বেও এরকম একটা দুর্ঘটনা হয় কী করে? বিশ্বের যে কোন শিল্পোদ্যোগে, বিশেষতঃ পেট্রোলিয়াম ফিল্ডে সেফ্‌টি সেকশন চিরকালই ছিল, তবে তা নিতান্তই দায়সারা গোছের আর ঘটনোত্তর কার্যবহুল (reactive)। তার প্ল্যানের মধ্যে থাকত দুর্ঘটনা হলে কী করবে তার উপায় আর সমুদ্রে নিজেকে বাঁচানোর ট্রেনিং (Survival of Life at Sea বা SOLAS)। তারপর ১৯৮৮ সালে ঘটে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। স্কটল্যান্ডের অ্যাবার্ডিন থেকে ১১০ মাইল পূর্বোত্তরে নর্থ-সীর পাইপার অঞ্চলের বিশাল অফশোর প্ল্যাটফর্ম ‘পাইপার অ্যালফা’ (Piper Alpha) পুড়ে ছাই হয়ে যায় শুধুমাত্র যোগাযোগ সমস্যা (communication), সঠিক হস্তান্তরণ-পদ্ধতি (proper hand-over system) আর একটি নিশ্ছিদ্র দুর্যোগ-মোকাবিলা প্রক্রিয়ার (Disaster Management Plan) অভাবে। পাইপার আলফা দুর্ঘটনা একটা মাইলস্টোন, শুধু তেল-উদ্যোগ নয়, শুধু সমুদ্র নয়, গোটা বিশ্বের শিল্পোদ্যোগ জগতের সুরক্ষা-জগতে নিয়ে এল এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সব কিছু ঢেলে সাজানো হল, আনা হল ঘটনা-পূর্ব প্রস্তুতি কার্যপ্রণালী (pro-active approach)। এখন সম্পূর্ণ সুরক্ষার জন্যে তৈরি হয়েছে নানা সংস্থা, নতুন নতুন কার্যক্রম, প্রতিটি কোম্পানিতে স্বয়ং-সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য-সুরক্ষা-পরিবেশ (Health, Safety and Environment বা HSE) বিভাগ। অবশ্য এতে এ ধরণের দুর্ঘটনা কমানো গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি তার নিদর্শন হল ২০০৫ এর ২৭শে জুলাইয়ের এই দুর্ঘটনা, সামান্য একটি মানবিক-ভুল আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। 

পরে জানলাম, সবার চেষ্টায় সর্বমোট ৩৫৫ জনকে উদ্ধার করা গেছে, পরে আরো সাতজনকে। কিন্তু সব মিলিয়ে ২২ জন কর্মী ও অফিসার মৃত বা নিখোঁজ। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু আমাদের বন্ধু হেমন্ত কুলশ্রেষ্ঠর। হেমন্ত সমুদ্রে লাফিয়েও বেঁচে ছিল, উদ্ধার করার জন্যে বোট থেকে যে দড়ি ছোঁড়া হয়, তাতে গলায় ফাঁস লেগে প্রাণ হারায় বেচারা। অথচ যার জন্যে এত কাণ্ড, একটা ভুল সিদ্ধান্ত থেকে এত বড় দুর্ঘটনাটা ঘটল, সেই রাঁধুনী ছোকরাটি কিন্তু প্রথমেই ক্রেনের বাস্কেট থেকে লাফ দেয় সমুদ্রে, প্রায় অনায়াসেই বেঁচে যায়!                  
    

 

Wednesday, August 21, 2019

ছোটদের জন্যে গল্প-- কুট্টিবাবুর মুগ্ধবোধ


 (গল্প)
পল্লব চট্টোপাধ্যায়

মুচিপাড়ার প্রবীণতম বাসিন্দা কুট্টিবাবু নিজে কিন্তু চিরনবীন, একসময় ছেলেছোকরাদের কাছে স্বার্থপর দৈত্য বলে পরিচিত ছিলেন। কাজকর্ম কিছু করেন কিনা কেউ জানেনা, তবে অজস্র বই পড়েন। সকাল থেকে বারান্দায় একটা ইজি-চেয়ারে বসে বই পড়তেন তিনি, মুখে থাকত গড়গড়ার নল। এযুগে একটু খাপছাড়া ঠেকে বটে, কিন্তু কুট্টিবাবু মানুষটিও তো নেহাৎ আধুনিক নন। ভয়ে বা ভক্তিতে ছেলেছোকরারা তাঁকে একটু এড়িয়েই চলত, অবশ্য বয়স্ক কাউকেও কখনও ওঁর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়নি তেমন।
খেলতে খেলতে একদিন পাড়ার ছেলেদের টেনিস বল কুট্টিবাবুর বারান্দায় চলে যায়। ছেলেগুলো রাজ্যের কুলাঙ্গার, মায়ে তাড়ানো-বাপে খেদানো চারজন, নাম- ভোঁদড়, ভ্যাবলারাম, নেপাল আর গোবিন্দ। ভাল নাম ওদের একটা করে আছে বটে কিন্তু তা শুধু স্কুলের খাতায়। বলটা ‘সেলফিশ-জায়ান্ট’ কুট্টিবাবুর বারান্দায় যেতেই ওদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে কে যাবে তা উদ্ধার করতে। ঠিক করতে না পেরে শেষমেষ চারজনেই গিয়ে কড়া নাড়ল তাঁর দরজায়। কুট্টিবাবুর চাকর দরজা খুলে দিতেই ভেতর থেকে হাঁক এল- 'হারুন, ওদের চারটেকেই ভেতরে পাঠিয়ে দে।'
শুনেই তো ওদের হাত পা ঠাণ্ডা। ওরকম ঘটোৎকচ মার্কা বিশাল চেহারা, চারজনকে গিলে খেতে না পারলেও পিটিয়ে মারতে পারেন। তবু সাহস করে এগোল ওরা।

-
ক্রিকেট খেলছিলি? তোদের মাঠখানা তো অনেকটা দূরে দেখছি। এত জোরে মারল কে?
-
দাদু, ভ্যাবলা মেরেছে, ভোঁদড়ের কাতরোক্তি।
-
এই হতচ্ছাড়া, আমাকে দেখে কি তোদের দাদু মনে হচ্ছে? নাম কী তোর?
-
আজ্ঞে জ্যেঠু, আমি ভোঁদড়।
-
জ্যেঠু, জ্যেঠু আবার কী? আমার বয়স কত হবে বলত? এবার প্রশ্ন নেপালকে।
-
জানিনা স্যার, ষাট-সত্তর হবে।
-
বলিস কী রে! ষাট-সত্তর-আশি হয়ে তাহলে তো বুড়ো হয়ে কোনদিন মরেই যাব। জানিস, আমার বয়েস এখন আঠেরো। তোরা আমাকে এবার থেকে কুট্টিবাবু বলবি, কেমন?
বোঝা গেল, বেশ একটা রসিকতা করলেন কুট্টিবাবু। গোবিন্দ ওদের মধ্যে খুব সুকুমার ভক্ত, নিজেও একটি পাগলা দাশুর অবতার। ও বলে- 'হ-য-ব-র-ল’র বুড়োর মত বয়সটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন বুঝি?'
এবার হা হা করে প্রাণখোলা অট্টহাস্য করে উঠলেন কুট্টিবাবু। ব্যস, এক নিমেষেই সবার বন্ধু হয়ে গেলেন তিনি।
-
মাঝে মাঝে আসবি, কেমন? আর আপনি নয়, তুমি। আঠেরো বছরের মানুষকে কেউ কখনও 'আপনি' বলে! যা বল নিয়ে পালা এখন।
চার বন্ধুই এখন কুট্টিবাবুর মুগ্ধ ভক্ত। এক রবিবার সকালে কুট্টিবাবু বসে আছেন তাঁর সেই বিখ্যাত আরামকেদারাটিতে আয়েশ করে, ওটা নাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলার নিলাম করা সম্পত্তি থেকে কেনা, কে জানে কতটা সত্যি সে গল্প। উনি গড়গড়ার নলটা সবে টেনেছেন, এমন সময় হুড়মুড় করে ভ্যাবলারাম এসে হাজির। 'হেল্প কুট্টিবাবু, বাঁচাও!' ভ্যাবলারামের আর্তনাদ।
-
কী ব্যাপার রে, কেউ তাড়া করেছে নাকি? সাত সকালে কার হাঁড়ি ভাঙতে গিয়েছিলে চাঁদ?
-
না, মানে ভোঁদড়ের কাছে খবরটা শুনেই তাড়াতাড়ি......
-
অ্যাঁ! তাড়ির হাঁড়ি ভেঙেছিস? আহা রে, না ভেঙে যদি নিয়ে আসতিস! না না, সবাই মিলে ভাগ করেই খাওয়া যেত।
-
দুত্তেরি তোমার তাড়ি। এবার পাত্তাড়ি গোটাতে হবে দেখছি এখান থেকে। আমার কিনা এখন শিরে সংক্রান্তি, শিরা ছিঁড়ে যাবার যোগাড়!
-
সংক্রান্তি? বলিস কিরে! আজ যে মোটে দোসরা পৌষ। আহা সংক্রান্তিটা কবে আসবে রে? বেশ পিঠে খাওয়া যাবে।
-
ভাল জ্বালা! তোমার কেবলই দেখি খাওয়ার চিন্তা। আসলে আমার শিরে সংক্রান্তি নয়, সংস্কৃত- ভ্যাবলারাম ভুলটা সংস্কার করে নেয়।
-
সংস্কৃত? ঐ মানে অং-বং-চং?
-
হ্যাঁ, কাল আমার সংস্কৃত পরীক্ষা। অন্যগুলো কোনমতে পার হয়েছি, তা এইটে হল গিয়ে বিভীষণ, না কী যেন- বিসূচিকা!
-
বিভীষিকা?
-
ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই, মানে খুব ভয়ের ব্যাপার। ভোঁদড় তাই শুনে তোমার কাছে পাঠাল, বলল কুট্টিবাবু আমাদের বহুরূপী!
-
অ্যাঁ! তা হ্যাঁরে, ভোঁদোড়কে দেখছি না তো?
বলতে বলতেই ভোঁদোড় হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির। 'উরিব্বাস, খুব বেঁচে গেছি! এই রবিবারেও দেখি অঙ্কের টিউটার। পর্শু অঙ্ক পরীক্ষা কিনা, আজও এসে হাজির, আমি তো দেখেই ভোঁ দৌড়।
-
নামের উপযুক্ত কাজটিই করেছো, কুট্টিবাবু স্বীকৃতি দেন। 'তা হ্যাঁরে, আমার সম্বন্ধে কী সব উল্টোপাল্টা বলেছিস ভ্যাবলাকে?
-
আমি? কই না তো!
-
ঐ যে বহুরূপী। জানিস সেটা একধরণের গিরগিটি, যারা ঘন ঘন রঙ বদলায়?
-
এই দ্যাখো! বহুরূপী কেন হতে যাবে, আমি বলেছি বহুদর্শী, মানে যে অনেক কিছু দেখেছে।
-
তা দেখেছি বটে। একবার কী দেখেছিলাম জানিস, একটা গরু একটা গাছের মগডালের পাতা খাচ্ছে।
-
যাঃ, সে তো কেবল গল্পে হয়, গরু গাছে ওঠে।
-
হ্যাঁরে, পুরোটা শুনবি তো! গাছটা ছিল চার ফুট উঁচু একটা জংলি কুলগাছ।
এমন সময় নেপাল আর গোবিন্দ এসে ঢোকে। ভোঁদড় আর ভ্যাবলাকে হাসতে দেখে ওরা ভাবে নিশ্চয়ই একটা কিছু হাসির ব্যাপার ঘটেছে, তাই ওরাও বোকার মতন খুব হাসতে থাকে। হঠাৎ ভ্যাবলা মুখটাকে কাঁদো-কাঁদো করে বলে, 'কুট্টিবাবু,, আমাকে রেসক্যু কর, আমি সং......
-
ওঃ, আবার ইংরেজি বুলি ঝাড়া হচ্ছে! তোকে সং সাজতে কে বলেছিল?
-
আরে না না কুট্টিবাবু, ভ্যাবলা সং সাজে নি, কাল ওর সংস্কৃত পরীক্ষা- তাই বলছিল।
-
, তাই বল। জানিস, আমি একবার সংস্কৃতে ছিয়ানব্বুই পেয়েছিলাম?
-
অসম্ভব! সবাই একযোগে নস্যাৎ করে দেয় দাবীটাকে।
-
কী বললি? পাইনি! প্রমাণ চাস?
-
ওরে ব্বাবা! প্রমাণ চাইব তোমার কাছে? তার চেয়ে বরং কী করে পেয়েছিলে তাই বল, শুনে মুগ্ধ হই- নেপাল একটু তোয়াজ করে কুট্টিবাবুকে।

- তবে শোন, কুট্টিবাবু শুরু করেন তাঁর কাহিনী। মুগ্ধবোধ থেকেই শুরু করি। তখন আমরা পড়ি বোপদেবের মুগ্ধবোধ আর বিদ্যাসাগরের কৌমুদী। পণ্ডিতমশাই ক্লাসে ঢুকতেই আমরা তারস্বরে পড়তে শুরু করে দিতাম- নরঃ নরৌ নরাঃ। ভুল করলেই পণ্ডিতের ধমক- বেঞ্চির উপর দাঁড়াঃ! অমনি সমবেতকণ্ঠে শুরু হত-
গজঃ গজৌ গজাঃ
খেতে বড় মজা।
ফলম ফলে ফলানি
পরের গাছে ঝোলানি,
আমরা কুড়োই তলানি
পাড়তে গেলেই প্যাঁদানি। ইত্যাদি ইত্যাদি...
পণ্ডিতমশাই পদ্য শুনতে খুব ভালবাসতেন। তাই এভাবে কিছুক্ষণ দুলে দুলে পড়তেই ঘুমপাড়ানি ছড়া শুনে বাচ্চাদের যেমন হয়, উনিও নাক ডাকাতে শুরু করতেন। সাথে সাথেই আমাদের পলায়ন। কাজেই পড়াশুনো কেমন হত বুঝতেই পারছিস!
কুট্টিবাবু থামলেন।
- তাহলে নাইনটি সিক্স......গোবিন্দের ব্যাকুল প্রশ্ন।
-
বলছি - বলছি। সম্রাট বিক্রমাদিত্য আর কালিদাসের সেই গল্পটা শুনেছিস কি, সেই যে এক চিত্রকর রাজমহিষী ভানুমতীর ছবি এঁকেছিল- কালিদাস তা দেখেই বললেন 'একদম হয়নি’?
-
না শুনিনি। শুনছি, বলে যাও। নেপাল বলে।
-
শুনে সম্রাট তো অবাক। 'কী বলতে চাও, মহাকবি?' তিনি জানতে চান। 'আমি লিখে জানাচ্ছি' বলে কালিদাস কলম ডোবান কালিতে। কিন্তু বেশ কিছুটা কালি ছিটকে পড়ে ছবিতে ভানুমতীর পায়ে, একটা তিলের মত হয়ে যায়।
'
এবার ঠিক হয়েছে', কালিদাস বলেন। কিন্তু সম্রাট রেগে আগুন, 'রানীর চেহারা এত নিখুঁতভাবে তুমি কী করে জানলে হে কালিদাস?'

- কী আবোলতাবোল বকছ, কুট্টিবাবু? ধান ভানতে শ্যামাসংগীত! সংস্কৃতের সাথে এর কী সম্বন্ধ?
-
কথাটা শ্যামাসংগীত নয়, শিবের গীত। আছে হে ভ্যাবলানন্দ, সম্পর্ক আছে। ঠিক এরকম ব্যাপারই সেদিন ঘটেছিল কিনা! সংস্কৃত পরীক্ষার দিনে পেপারটা দেখেই না আমার ভীষণ ঘুম পেয়ে গেল। রাত জেগে পড়া, অথচ কিছুই প্রায় জানিনা। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কী যে লিখেছিলাম মনে নেই, বোধ করি উত্তরগুলো বাংলায় লিখে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ হেঁড়ে গলার চিৎকারে তন্দ্রা ছুটলো-
- '
কি র‍্যা কুট্টি, তুই এখানে বসে ঘুমোবি, আর পরীক্ষাটা বুঝি আমি দেব?' পণ্ডিতমশাইয়ের গলা। আজ ব্যাপারটা গেছে উলটে, অর্থাৎ কিনা তিনি জেগে আর আমি ঘুমিয়ে। আমি তো চমকে জেগে উঠেছি। কলমটা ছিল হাতে ধরা, তখনকার দিনের ফাউন্টেন পেন, বুঝলি কিনা, সেটা ফসকে গেল হাত থেকে, পড়ল গিয়ে খোলা খাতার উপর। পরীক্ষার ফল বেরোতে দেখা গেল আমি পেয়েছি নাইনটি-সিক্স!
- পণ্ডিতমশাই নিশ্চয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই মার্কিং করেছিলেন, ভোঁদড় নিশ্চিত।
-
হেঁ হেঁ, তোরা ছেলেমানুষ, অতশত কি বুঝিস? এবার আলোয় আসেন কুট্টিবাবু। আসলে কী হয়েছিল জানিস, কলমটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে কালি ছিটকে যেখানে যেখানে পড়ার কথা, পড়ে গেছিল, পড়ে অনুস্বর-বিসর্গ-চন্দ্রবিন্দু জায়গামত লেগে গিয়েছিল। আর জানিসই তো বাংলাভাষায় অনুস্বর-বিসর্গ লাগলেই সংস্কৃত। কালিদাস তাই বলেছিলেন সম্রাট বিক্রমাদিত্যকে, মাঝে যদিও একটা স-সে-মি-রা'র গল্প আছে-
"
দেবতার প্রসাদেতে গুরুর কৃপায়,
জিহ্বা-অগ্রে সারদা বিরাজে মহাশয়।
নতুবা এ রূপ কথা কোনজন জানে,
ভানুমতী উরূদেশে তিলের সন্ধানে?" *
হেঁ হেঁ, অবিকল কালিদাসের গল্পটা। কালিদাস যা পারেন তা তোদের কুট্টিবাবু পারবে না, বলিস কী রে!
- আলবাৎ পারে, আলবাৎ পারে। আর কুট্টিবাবু যা পারেন তা এই ভ্যাবলারাম পারবে না?......যাই কলমে কালি ভরি গিয়ে, ভ্যাবলা ছুট দিল।

তারপরে অবশ্য ভ্যাবলারামের ভাগ্যে কী জুটেছিল তা এখনও জানা যায়নি
, কারণ কুট্টিবাবুর সঙ্গে তার কাট্টি, মানে আড়ি, এখনও, আজ পর্যন্ত।

* - মাধবচন্দ্র পাল ও বিশ্বম্ভর লাহা প্রণীত 'বত্রিশ সিংহাসন' পুস্তক থেকে।

(শেষ)

 কুট্টিবাবুর মশক-অভিযান।
আমাদের মুচিপাড়ার প্রবীনতম বাসিন্দা চিরনবীন কুট্টিবাবু তাঁর সিরাজউদ্দৌলার সম্পত্তি থেকে নিলামে কেনা আরামকেদারাতে সকাল সকাল বসে বসে দোল খাচ্ছেন, এমনসময় ভোঁদড়, নেপাল আর গোবিন্দের হই-হই করে আবির্ভাব।
'বুঝলে কুট্টিবাবু, পড়াশুনা করে আর কী হবে?'- ভোঁদড়ের ব্যাকুল আক্ষেপ, 'বড়লোক হয়ে হয়ত দুটো টাকাই কামাতে পারব, নাম কামানোটা আর অত সহজ রইল না।'
'ব্যাপারটা কী বল দিকিন?' কুট্টিবাবু শুধোন, 'এখনও দাড়ি কামাতে শিখলি না, আর নাম কামাবার চিন্তা! ক্যান রে, তোকে আটকাচ্ছে কে?'
'মানে এই নিউটন-মার্কনিদের কথা বলছি। দুনিয়ার যেখানে যা কিছু দেখছি সব আবিষ্কার করে রেখেছে! আমাদের জন্যে আর কিছুই নেই।'

'আচ্ছা কুট্টিবাবু, সত্যি কি পৃথিবীতে কোনও প্রশ্নের উত্তর অজানা নেই?' নেপাল শুধোয়।
'আরে তোরা যেমন', কুট্টিবাবু ভরসা দেন।'অনেক প্রশ্নই এমন আছে যা লোকে জানে না, তায় উত্তর দেবে কী?'
'যেমন-'

'এই যেমন ধর, শ্রীলঙ্কার লঙ্কার থেকে আমেরিকার লঙ্কা কেন বেশি ঝাল? বম্বেটের উৎপত্তি কি বম্বে থেকে? সিং নেই, গর্জনটাও sing নয়, তবু সে সিংহ কেন? কোনটা বেশি ভয়ের, মেশিন গান না হিন্দি সিনেমার গান? ভূগোলের নম্বরের জায়গায় মাঝে মাঝেই জোড়া গোল বসে কেন...'
'থাক থাক, অনেক বুঝেছি', গোবিন্দ কুট্টিবাবুকে থামিয়ে দেয় মাঝপথে।

ইতিমধ্যে ভ্যাবলাকান্ত এসে হাজির হয়েছে। কুট্টিবাবুর মুগ্ধবোধ পরামর্শে কান দিয়ে ও সংস্কৃত খাতায় যা লিখেছিল তাই দেখে পরীক্ষক নাকি মুগ্ধ হয়ে নম্বর দিতেই ভুলে গেছিলেন। তারপরেই কুট্টিবাবুর সঙ্গে ভ্যাবলার কট্টি, মানে আড়ি। শেষে আর থাকতে না পেরে এই ক'দিন হল আড্ডায় আবার নিয়মিত হাজিরা দিতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাই- আর কোন কথায় কান দেবেনা কুট্টিবাবুর।
আরে মোলো, চুপ করে কাঁহাতক থাকা যায়! পেটের মধ্যে মোচড় খেতে খেতে কথাটা শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই গেল।
'কুট্টিবাবু, এরকম কেন হয় বলতে পারো? বাবা জিগ্যেস করলেন, হ্যাঁরে তোদের অঙ্ক কে পড়ান? প্রহ্লাদবাবু বলতে গিয়ে ভুল করে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল 'জল্লাদবাবু'।'

কুট্টিবাবু মিনিট দুই একটু হেঁঃ হেঁঃ করে হেসে আরাম-কুর্সিটায় একটু নড়ে-চড়ে নিলেন। তারপরেই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন- 'হ্যাঁরে নেপাল, তোর ঠাকুমার দাঁত নড়ছিল, ভাল আছেন তো? ভোঁদড়ের ভাগ্নের অন্নপ্রাশন কেমন কাটল? উঃ, তুইও মামা হয়ে গেলি শেষ পর্যন্ত! বাপ্‌স্‌, পেঁয়াজের দাম বাড়ছে হু হু করে! বিরাট শচিনের রেকর্ডটা ভাঙবেই একদিন, কী বলিস?......
'কুট্টিবাবু-', ভ্যাবলা শুরু করে।
'ও হ্যাঁ ভ্যাবলা', কুট্টিবাবু মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, 'তোর বাবা ভাল আছেন তো?'
'হ্যাঁ ভালই তো', ভ্যাবলা একটু থতমত খায়।
'আর তাঁর ছেলে?'
'ছেলে? এইত আমি এখানে!'
'সে তো দেখতেই পাচ্ছি জলজ্যান্ত চোখের সামনে। কিন্তু তার মস্তিষ্কের কোন কোষে কষে গিঁঠ না কি স্নায়ুতন্ত্রীতে গ্রন্থি পড়ে গেছে তা তো আমরা জানি না।'
'তার মানে? বলতে চাও আমার মাথা খারাপ হয়েছে, আমি পাগল!'
'অত প্রাঞ্জল করে বলিস্‌নে বাপ! পাগলের নামেই আমার প্রাণ জল হয়ে আসে। পাগল আমিই, নইলে তোকে মুগ্ধবোধ শিক্ষা দিই, তোর মত 'মুগ্ধ', মানে মুর্খকে!'
'ঘাট হয়েছে কুট্টিবাবু', এইবার ভ্যাবলানন্দের মুখে হাসি ফুটল। 'মাপ চাইছি। যা হয়েছে, হয়েছে। আমার কথাটা শুনেছ? প্রহ্লাদবাবু-'

'ও, ভুলের কথা বলছিস? হ্যাঁ, ওই হল একটা শব্দ যা বিশ্বসুদ্ধু লোক ভুল বলে, ভুল পড়ে, ভুল উচ্চারণ করে, ভুল লেখে। 'ভুল' সম্বন্ধে সিংহমুন্ড মানে আমার বন্ধু ফ্রয়েড বলেছিলেন......'

এই ফাঁকে চুপিচুপি জানিয়ে রাখি, গোবিন্দদের সঙ্গে কুট্টিবাবুর একটা অলিখিত চুক্তি আছে যে গুলকে গুল বলে দাবী করা তো দূরের কথা, গুল ভাবতে পর্যন্ত পারবে না তারা, যদি তা কুট্টিবাবুর মুখনিঃসৃত হয়। সুতরাং......কুট্টিবাবু কী বলেন শোনাই যাক।
'......যাক্‌গে, কিছু একটা বলেছিলেন, অতশত মনে নেই, অনেকদিন হল কিনা! আচ্ছা একটা ঘটনা বলি, বললে তোরা কেউ বিশ্বাস করবি না-'
'একদম করব না, স্বচ্ছন্দে চালিয়ে যাতে পার।' গোবিন্দ আশ্বাস দেয়।

ইতিমধ্যে কুট্টিবাবুর মধ্যযুগীয় বান্দা হারুণ এসে দাঁড়াল। হারুণের পরণে বরাবরের মত চোঙা পাজামা, চিকনের কুর্তা, মাথায় মোগলাই পাগড়ি, হাতে ট্রে, তাতে পাঁচ কাপ গরম কফি। এটা আমাদের কুট্টিবাবুর বাসার আড্ডার একটা অন্যতম আকর্ষণ। কফিপান শেষ করে কুট্টিবাবু শুরু করলেন তাঁর কাহিনী।
*                *               *              *               *


'তবে শোন। স্বাধীনতার সময়কার ঘটনা, তখন আমি কলকাতায়। সেবার ভারত-পাকিস্তানের সাথে সাথে কলকাতার মশারাও যেন স্বাধীনতা ঘোষণা করল। রাস্তায়-ঘরে-বাইরে, আলসেয়-উঠোনে-ছাতে সর্বত্র সংঘবদ্ধ হয়ে তারা মশাদের জাতীয় সংগীত গাইতে লাগল-
জয় জয় মঁসিয়ে মশক মহাশয়,
মসীকালো মশানের ধারে-
জয় তার মশকেতে বয়
তাজা খুন যারা থরে থরে।

এইভাবে চলতে লাগল তাদের দাপট। মশাদের দাপটে তটস্থ হরিদাস পাল থেকে রাজ্যপাল, না রাজ্যপাল বস্তুটা তখন ছিল না, তবে গভর্নর ছিল, বেহাল নগরপাল- কেউ দিতে পারে না সামাল। প্রচণ্ড রায়ট শুরু হয়ে গেল। রক্তগঙ্গা বইতে লাগল। বড় বড় মশকে- মশক জানিস তো, রাজমিস্ত্রির ভিস্তিরা যে চামড়ার থলিতে জল বইত- ওই তাতে করে বড় বড় ব্লাড ব্যাঙ্ক ভর্তি করে তুলল। অবশেষে ডাক পড়ল আমার।'

'তোমাকে কেন? তোমার শরীরে আর কতটুকু রক্ত ছিল!' একটা খোঁচা দিল গোবিন্দ।
'কী বললি? ন্যাপলা!'
ইশারা বুঝতে নেপালের সময় লাগল না। মুহূর্তে হাজির হল 'ইন্টারাপ্‌শন ফাইন বক্স', একটাকা গচ্ছা গেল গোবিন্দের। এবার সন্তুষ্ট হয়ে কুট্টিবাবু আবার চালু করলেন তাঁর কাহিনী।

'তবে শোন। আমার হাতে দেওয়া হল মশক-বিতাড়নের দায়িত্ব। সাথে সাথেই আমি রওনা হয়ে গেলাম ওমান দেশের মশকাট শহরে, নিয়ে এলাম দুটো বড় বড় কামান।'
'কামান আনতে ওমান! কেন আন্দামানে পাওয়া যেত না?'
'মস্করা হচ্ছে! তার চেয়ে বলনা, বর্ধমান গেলেই হত। এ কি তোদের মসাগ্রামের মশা পেয়েছিস...এক একটা চড়ুইপাখের মত সাইজ, হ্যাঁ! যেমন মশা তেমনি তার কামান। একটা বসান হল মনুমেন্টের মাথায়- বনবন করে ঘুরছে আর গোলা ছুটছে শ্যামবাজার থেকে শ্যালদা, আলিপুর থেকে আউট্রাম ঘাট।অন্যটা থাকল উল্টোডাঙা ব্রিজের উপর, তার লং রেঞ্জ, গোলা ছুটছে টালা থেকে টালিগঞ্জ, বালি থেকে বালিগঞ্জ! সে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ। ভাবলাম বুঝি এবার পোস্থুমাস অ্যাওয়ার্ড-ফ্যাওয়ার্ড পেয়ে যাব কিছু একটা।'

'পোস্থুমাস কেন গো? সে তো মরণোত্তর, বেঁচে থেকে পাওয়া যায় নাকি?'
'তা হবে। বেশ গালভরা কথাটা, তাই না ভেবে বলে ফেললাম। যাকগে, একটা পরমবীর চক্রও তো পেতে পারতাম!' কুট্টিবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলেন এবার।
'তারপর? মশারা দূর হল?' চারজনেরই উৎসুক প্রশ্ন এবার।

'বুঝলি ভ্যাবলা, সকলই কপাল! আসলে সেদিন বাজারে শুনছিলাম একজন পূর্ববঙ্গীয় বয়স্ক ভদ্রলোক দোকানদার বন্ধুকে বলছেন- 'দ্যাস ভাগ হইসে কত্তা, দুই দ্যাসে দাঙ্গা। ঢাকা-বরিশালের মাইন্স্যে দলে দলে  আইসে, চাউলের দাম বাড়বা। এই ত সুযোগ, মশায় কামান, এই সুযোগে কামান!
ব্যস, রাত্রে গণ্ডগোলে আর ঘুম আসে না। শুধু মনে পড়ছে 'মশায় কামান', আর বাইরে রায়টের দাপট, গুড়ুম গুড়ুম বোমা আর পুলিশের বন্দুকের আওয়াজ! দুঃস্বপ্ন কি আর সাধে হয়! এইজন্যেই তো সিংহমুণ্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন.........।'

বলা বাহুল্য, কী যে বলেছিলেন সেটা আর সম্পূর্ণ করেন না কুট্টিবাবু।