Tuesday, August 27, 2019

স্মৃতিকথা- বাদলের ধারাপাত

বাদলের ধারাপাত।
(স্মৃতিকথা)


কাল সকাল থেকেই প্রচণ্ড গরম, সেই সঙ্গে প্রায় নব্বই শতাংশ আর্দ্রতা। হাঁসফাঁস অবস্থা। বিকেলে সাউথ আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ দেখব বলে টিভি চালিয়েছি, দেখি খেলা বন্ধ, ইংলন্ডে তুমুল বৃষ্টি। এত রাগ হচ্ছিল ইন্দ্রদেবতার একচোখোমির জন্যে! এমন সময় কড়-কড়-কড়াৎ - মেঘের গর্জন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুরু হল প্রবল বর্ষণ, সাথে ঝড় আর বজ্রপাত। কম্পাউণ্ডের বাইরের রাস্তার ধারে মড়-মড় করে একটা গাছ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ শোনা গেল। টিভি সেটের সব কানেকশন খুলে জানালার ধারে একটা চেয়ার নিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখতে বসলাম। মুহূর্তে চোখের উপর ভেসে উঠল পঞ্চাশেরও বেশি বছর আগেকার একটা ছবি। ভুলে যাওয়ারই কথা, তবে এই বর্ষার শুরুতে কবির মনে যদি দু-আড়াই হাজার বছর আগের উজ্জয়িনীর ছবি, রেবানদীর তীরে কোন এক মালবিকার অনিমিখে চেয়ে থাকার দৃশ্য স্মরণে আসতে পারে, আমারও বাল্যের স্মৃতি ফিরে আসতে দোষ কিসের?
আমার বয়স তখন ছয় কি সাত, বোন আরো তিন বছরের ছোট। বাইরে বৃষ্টি শুরু হলেই বাইরের ঘরের খোলা জানলার বাইরেটা ছিল আমাদের ভাই-বোনের বিশ্বজগৎ। জানালার পাশেই বাবার কাঠের চেয়ার, একটু ভেতরের দিকে লেখার টেবিল। ওই একটা চেয়ারে দু'জনে কি সুন্দর হাঁটু মুড়ে বসে বাইরের পৃ্থিবীটাকে দেখতাম, এখন ভেবে অবাক লাগে হয়ত ওই চেয়ারে এখন আমার একারই বসতে কষ্ট হবে।
জানালার বাইরে বারান্দা, তাই আমরা ভিজছি না, অথচ সব দেখতে পাচ্ছি। আমাদের তখন বাগান ছিল না, সামনের বাড়ির রাজুদেরও বাগান নেই। তার পাশে রাস্তা, একটা কুকুর রাস্তা পার হয়ে ছুটে এসে রাজুদের বারান্দায় বসল, ওটা আমাদের বাসায় কেন এল না সেই ভেবে বোনের চোখ ছলছল করে উঠল। এমন সময় সারা শরীরে একটা ঝটকা খেলাম, তবে তেমন কিছু নয়, সাথে সাথেই চড়-চড় করে মেঘ ডেকে উঠল। বোনকেও বলিনি, মায়ের কানে গেলে আমাদেরকে ওখান থেকে চলে আসতে হবে। আজ বুঝতে পারি, জানালার শিক ধরে বসায় বিদ্যুতের একটা হাল্কা শক লেগেছিল, তবে চেয়ারের ইন্স্যুলেশন থাকায় কোন ক্ষতি হয়নি।
আমার ছেলেবেলায় একটা আবোল-তাবোল বই ছিল। তার যাবতীয় ছড়া আমি বোনকে শুনিয়ে শুনিয়ে মুখস্থ করিয়ে দিয়েছিলাম। ঘরে কেউ এলেই ওর হাতে উঠে আসত বইটা, উলটো করে ধরেই পড়ে চলত- 'সিংহাসনে ঝোলায় কেন ভাঙা বোতল শিশি,/ কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট কেন খেলে রাজার পিসি?' আজ আমার স্কুল নেই, পরিস্থিতি অনুকূল দেখে বোন বলল, 'দাদা আজকে কোন ছড়াটা শেখাবি রে? বই নিয়ে আসি?' ইতিমধ্যে কাকা ধানবাদের কলেজ থেকে ছুটিতে এসে আরো দুটো বই কিনে দিয়ে গেছেন, সুকুমার রায়েরই খাই খাই আর বহুরূপী। আমি কি ভেবে খাই-খাইটা নিয়ে এলাম। বোনটি আমার ছিল প্রায় শ্রুতিধর, কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে শুরু করে দিল-
"জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত-
অফুরান্‌ নামতায় বাদলের ধারাপাত।
.........স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়,
নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায়।"

No comments:

Post a Comment