ঈশ্বরদর্শন।
এই বর্ষণমুখরিত দিনে ১৯৭৮এর বন্যার বিধ্বংসী চেহারা নিয়ে স্মৃতিচারণ হচ্ছিল, চোখে পড়ল কলকাতা-বিশেষজ্ঞ ডাঃ সিদ্ধার্থ মুখার্জির শ্রী দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে লেখা একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমার তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবু যেটুকু হয়েছে তাকে কবিগুরুর ভাষায় বলা চলে 'এসেছিলে তবু আস নাই, জানায়ে গেলে'।
ভাবতাম কলকাতার বাসিন্দারা ভাগ্যবান, চাইলেই ঈশ্বরকে দেখতে পান। আমি থাকি অনেক দূরে, জানিনা ভগবানের ঠিকানা। তাছাড়া খবর পেয়েছি যে তাঁকে আজকাল গান গাইতে দেওয়া হয় না। ভাবতাম এটা কি ইংরেজ শাসনের প্রলম্বন, যে সম্ভাবনার কথা নজরুল লিখে গেছিলেন তাই কি সত্যি হল!
'হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি,
সর্বনাশী শেখায় এ হীন তথ্য কে রে?'
'হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি,
সর্বনাশী শেখায় এ হীন তথ্য কে রে?'
তাহলে? ১৯৭৮এ হঠাৎই সুযোগ হয়ে গেল শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলা দেখতে যাওয়ার, আমাদের বন্ধু বাবুইয়ের হোস্টেলের অতিথি হয়ে। অজয়-ময়ূরাক্ষী-দামোদরের বন্যার বছর সেটা, বাসে ইলামবাজার পেরোবার সময় গাছের ডালে গরুর কংকাল ঝুলতে দেখে শিউরে উঠেছিলাম। সেদিন ৭ই পৌষ সন্ধ্যেয় মেলা তখনও জমে নি তেমন। ফেরার পথে স্টেট ব্যাঙ্কের দরজার মুখে সিঁড়িতে এক মাতালকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। বন্ধু বলল, প্রণাম কর, ইনি রামকিংকর বেইজ। সত্যি, কি নেশা আছে এখানকার জলে-হাওয়ায়-মাটিতে দুনিয়ার যত পাগল-মাতাল-নেশাখোর বলরামের চেলারা ভীড় করেছেন এখানে। আমাদের এই ভগবানও তো পাগল, বুঁদ হয়ে আছেন এক অনন্য নেশার বন্ধনে, তার নাম রবি ঠাকুরের গান।
সকালে পৌষালু শীতের কবল থেকে বেরোতে একটু সময় লেগে গেল। মেলার মুখে দেখি আরে, রবি ঠাকুর বেহালা নিয়ে বসে বাজাচ্ছেন- 'তোমার খোলা হাওয়া'। একটু কাছে যেতেই বুঝলাম, ইনি রবি ঠাকুর হতেও পারেন, আবার নাও হতে পারেন। ইনি হয়ত দাদাঠাকুর বা ধনঞ্জয় বৈরাগী বা 'অচলায়তন' ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই গুরু। বিশ্বভারতীর স্টলে দূর থেকে দেখছি খুব ভীড়। একজন গেরুয়া পরা ভদ্রলোক খোলা গলায় গাইছেন-
"কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সংকেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।"
"কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,
সুরের সংকেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।"
মনে হল এই শীতের সকালে যেন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। না, কাছে গিয়ে দেখি সুচিত্রা মিত্র আর অশোকতরু বসে আছেন। জানা গেল, দেবব্রত বিশ্বাস এইমাত্র স্টল থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। মনকে সান্ত্বনা দিলাম, ঈশ্বরকে পেতে যে সাধনার প্রয়োজন তা হয়ত আমার ছিল না।
No comments:
Post a Comment