টুপি।
(গল্প)
(গল্প)
আসানসোল জংশনের চার-পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে হুইলারের বুক স্টলে দাঁড়িয়ে একটা হিন্দি বই দেখছিলেন সোমেনবাবু। হিন্দি তাঁর মাতৃভাষা নয়, যদিও ভালই পড়তে পারেন ভাষাটা। আসলে তাঁর চোখ আটকে গেছে একটা বইয়ের মলাটে, লেখা আছে- 'আঁখ কী কিরকিরি', লেখকের নাম শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। উনি আর ভেবে পাচ্ছেন না রবি ঠাকুর এরকম অদ্ভুত নামের একটা বই লিখলেন কখন! বইটা নেড়েচেড়ে দেখতে যাবেন, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ভারী নকল গলায় হেঁকে উঠল, 'আসুন দাদারা, টুপি পরুন। জাদু কি টোপি, পঞ্চাশ টাকায় একটা- আসুন, আইয়ে, পচাস কা এক, সও রুপয়ে কে তিন!'
কেউ তেমন পাত্তা দিল না প্রথমে। তখন সে দ্বিতীয় তোপটা ছাড়ল। 'আসুন দাদা, আসুন মামা, আইয়ে চাচা, আলাদীন কী জাদু কী টোপি।'
এবার দু-চারজন কাছে ঘেঁসতেই তৃতীয় তোপ- 'হর টোপিমে হ্যায় গঞ্জাপন কী জাদু-দাওয়াই। টুপি পরলেই একমাসে টাকে চুল গজাবে- হাঁ ভাইসাব, একদম গ্যারান্টিড! আমরিকি দাওয়াইএর পরত লাগানো আছে হরেক টুপিতে, আসুন, পরখ করুন।'
কেউ তেমন পাত্তা দিল না প্রথমে। তখন সে দ্বিতীয় তোপটা ছাড়ল। 'আসুন দাদা, আসুন মামা, আইয়ে চাচা, আলাদীন কী জাদু কী টোপি।'
এবার দু-চারজন কাছে ঘেঁসতেই তৃতীয় তোপ- 'হর টোপিমে হ্যায় গঞ্জাপন কী জাদু-দাওয়াই। টুপি পরলেই একমাসে টাকে চুল গজাবে- হাঁ ভাইসাব, একদম গ্যারান্টিড! আমরিকি দাওয়াইএর পরত লাগানো আছে হরেক টুপিতে, আসুন, পরখ করুন।'
এইবার 'আঁখ কী কিরকিরি' ছেড়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন সোমেনবাবু। সার্কাসের জোকারের মতন দেখতে একটা ঢ্যাঙামতন লোক, দাঁতে পানের ছোপ, পষ্টো বোঝা যায় বাঙালি, তবে এই অঞ্চলে থাকার ফলে হিন্দিটা মোটামুটি জানে। মাথায় টুপি, তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘন বাবরি চুল। আচ্ছা বাবরি কেন বলে, বাবর শা কি ওরকম চুল রাখতেন? নাঃ, এ নিয়ে রিসার্চ পরে করলেও চলবে, সোমেনবাবু ভাবলেন, আপাততঃ এই 'পাইড পাইপার'টাকেই দেখা যাক! একটা আঁকাবাঁকা লাঠির ডগায় আটকানো গোটাকুড়ি চিত্র-বিচিত্র কাপড়ের টুপি, কাঁধের ঝোলা ব্যাগে অন্ততঃ আরো খান-পঞ্চাশেক হবে। একটা টুপি একজনের হাতে দিয়ে গন্ধ শুঁকতে দিল, সোমেনবাবুও বেশ খানিকটা দূর থেকে পে্লেন একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ।
'দেখুন স্যার, এতে আমেরিকান ফরমুলায় তৈরি ওষুধ মাখানো আছে, ঠিক একমাসে মাথাভরা চুল হবে, আর তিনমাসে আমার মতন ঘন বাবরি। নিয়ে যান দাদা, টেক ওয়ান আঙ্কল, লে জাইয়ে এ চাচা, এ ভাইজান!
টেকো লোকের অভাব নেই এ দেশে, আর তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ধারণা যে তাদের টাকটা সাময়িক, কোন না কোন ওষুধে ঠিক চুল গজাবেই একদিন। 'ধন্য আশা, কুহকিনী' জেনেও মন মানে না। এই খনি শিল্পাঞ্চলে বহু লোককেই একটানা আটঘন্টা শিরস্ত্রাণ পরে কাজ করতে হয়, তাই মাথায় ঘাম জমে টাকটাও পড়ে বেশি, টাকা না থাকলেও। তাই দরদস্তুর হয়। শেষমেশ চল্লিশ টাকায় মুক্তি পায় এক একটি জাদু-ই-টুপি।
'দেখুন স্যার, এতে আমেরিকান ফরমুলায় তৈরি ওষুধ মাখানো আছে, ঠিক একমাসে মাথাভরা চুল হবে, আর তিনমাসে আমার মতন ঘন বাবরি। নিয়ে যান দাদা, টেক ওয়ান আঙ্কল, লে জাইয়ে এ চাচা, এ ভাইজান!
টেকো লোকের অভাব নেই এ দেশে, আর তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ধারণা যে তাদের টাকটা সাময়িক, কোন না কোন ওষুধে ঠিক চুল গজাবেই একদিন। 'ধন্য আশা, কুহকিনী' জেনেও মন মানে না। এই খনি শিল্পাঞ্চলে বহু লোককেই একটানা আটঘন্টা শিরস্ত্রাণ পরে কাজ করতে হয়, তাই মাথায় ঘাম জমে টাকটাও পড়ে বেশি, টাকা না থাকলেও। তাই দরদস্তুর হয়। শেষমেশ চল্লিশ টাকায় মুক্তি পায় এক একটি জাদু-ই-টুপি।
হঠাৎ একটা ঘোষণা তালভঙ্গ করে দেয়। ধানবাদ-হাওড়া ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস পাঁচের জায়গায় তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে দশ মিনিটের মধ্যে। অপ্রত্যাশিত হুড়োহুড়ি পড়ে গেল যাত্রীদের মধ্যে। সব পড়ি কি মরি করে ছুটে ফুট ওভারব্রিজে উঠতে লাগল। টুপিওয়ালাও বেশ দ্রুত বিক্রির টাকা গোনা শেষ করে টুপি ও ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ছুট দিতে গেল ওভারব্রিজের দিকে। ঠিক সেই সময় ঘটল দুর্ঘটনাটা। হুইলারের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে কিভাবে যেন টুপিওলার টুপি আটকে গেল স্টলের ছাত থেকে বেরিয়ে আসা একটা বইয়ের হুকে। ব্যস, একেবারে 'বেণীর সঙ্গে মাথা'! টুপির সঙ্গে খুলে এল বাবরি চুলের পরচুলা, তলায় সুদৃশ্য ইন্দ্রলুপ্ত!
ভাগ্যিস পুরনো খদ্দেররা তখন পালিয়েছে। সোমেনবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল টুপি কুড়োতে গিয়ে, বেচারা-মার্কা একটা মলিন হাসি দেখা গেল টুপিওলার পানের ছোপলাগা দাঁতের ফাঁকে। ব্যাটা ভালই টুপি পরাল সবাইকে, তিনি বললেন মনে মনে। সোমেনবাবুর ধানবাদের গাড়ি, আসবে লাগোয়া চার নম্বরে, কোন তাড়া নেই। তিনি আবার টেনে নিলেন 'আঁখ কি কিরকিরি' হুইলারের স্টল থেকে।
ও হরি! এ তো দেখি সেই 'চোখের বালি'।
No comments:
Post a Comment