Sunday, August 18, 2019

বাংলা গল্প - বেচারাম ও টাকলামাকান।

বেচারাথেরিয়াম ও টাকলামাকান।
(গল্প)


বেচারাম লোকটা বড়ই নির্বিকার গোবেচারা ভালমানুষ, যদিও আড়ালে লোকে তাঁকে বোকারাম বলেই ডাকে। যারা একটু সুকুমার-টুকুমার চর্চা করে, তারা অবশ্য বেচারাথেরিয়াম বলেই ডাকে। বললে বিশ্বাস করবেন না, লোকটা খবরের কাগজের প্রতিটা কথা সত্যি ভাবেন, টেলিভিশনকে তো দৈববাণী মনে করেন। আর পরোপকার, কবে স্কুলে থাকতে পড়েছিলেন- 'পরোপকারায় সতাং বিভূতয়ঃ', সাধুর ঐশ্বর্য শুধু পরহিত তরে, তারপর থেকে নিজেকে সাধু-সন্ন্যিসি বলেই মনে করেন। হয়ত অফিস যাচ্ছেন, এমন সময় উপরতলার বৌদি চিৎকার করে বলল, 'বেচাদা, ওদিকেই যাচ্ছেন যখন টুকাইকে একটু মোড়ের মাথায় ছেড়ে দেবেন, স্কুল বাসটা ধরতে?' বেচারা বেচারাম আর বলতে পারেন না যে তিনি মোটেই সেইদিকে যাচ্ছিলেন না! এই করতে গিয়ে অফিস লেট হয়ে যায়, ফলে সেদিন একটানা কাজ করে যেতে হয়, ভাল করে টিফিনটাও খাওয়া হয় না।
অফিসের কাজটা অবশ্য বেচারামবাবু ভালই বোঝেন, দরকার পড়লে টাকলামাকানকেও বুঝিয়ে দিতে পারেন। না না, টাকলামাকান কোন চিনদেশীয় মরুভূমি নয়, ইনি হলেন বেচারামের অফিসের বড়কত্তা মাখনলাল দত্ত। প্রচণ্ড রাগী বলে ব্রহ্মতালু সদাই গরম, তাই একটা চুলও টেঁকেনি মাথায়, টাকলা- মরুভূমি হয়ে গেছে। আর মাখন থেকে মাকান। বড়সায়েব যেদিন বদলি হয়ে এলেন এই অফিসে, অন্য সবার কথা শুনে ভুল বুঝে ওঁকে টাকলামাকান স্যার বলে ডেকে দিয়েছিলেন বেচারাম। তার পর থেকে এই ভালমানুষটির ওপর বিষদৃষ্টি বড় সায়েবটির। বেচারাম ভেবে পান না, যে চেয়ারে যোগ্যতা আর সিনিয়ারিটি অনুযায়ী তাঁর নিজের বসবার কথা বহুবছর আগেই, সেখানে বাইরের লোক সটান এসে কিভাবে বসে পড়ে- তিনি পড়ে রইলেন দু-পোস্ট নীচে! তাঁর ধারণা ছিল, বিদ্যা, বুদ্ধি, সততা, কর্মদক্ষতা এসব থাকলেই কাজের ক্ষেত্রে উন্নতি হয়, তাহলে ঝামেলাটা কোথায় হল?
বেচারামের একমাত্র পরামর্শদাতা তাঁর গিন্নি যাঁর আসল নামটা আমরা কেউ জানি না, চালু নাম হল চিল্লানোসেরাস- চেঁচিয়ে একাই গোটা পাড়া মাত করে রাখতেন। রাত্রে শয়নকক্ষে তাদের মধ্যে কী কথাবার্তা হয় তা আমাদের জানার কথা নয়, কিন্তু লেখককে যেহেতু অনেক কিছু জানতে হয়, তাছাড়া চিল্লানোসেরাসের মুখে কোন মিউট বা ভল্যুম কন্ট্রোল বোতাম না থাকায় আমিও জানি ঘটনাটা। বেচারাম সোজা কথায় বউকে শুধোলেন, 'হ্যাঁ গো বিদ্যে-বুদ্ধি-জ্ঞান-দক্ষতা সব থাকা সত্বেও আমার প্রমোশন কেন হচ্ছেনা বলতে পার?'
চিল্লানোসেরাস এক্ষেত্রে না চিল্লিয়েই টিভির একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের স্টাইলে স্বামীরত্নটিকে যা উপদেশ দিলেন তার সারার্থ হল- জ্ঞান, সততা, কর্মদক্ষতা এখন অতীত। এখন জীবনে উন্নতির পাঁচতলা মলের পুরোটা জুড়ে শুধু তেল আর তেল। বসকে তেল দাও আর উন্নতির সিঁড়িতে চড়। 'বুঝলে কিছু, হাঁদারাম?'
বলা বাহুল্য, কিছু না বুঝলেও সেকথা স্বীকার করার হিম্মৎ বেচারার নেই। পরদিন ছিল রবিবার, বাজারের থলি নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লেন বেচারাম। বউ বসকে তেল দিতে বলেছে কিন্তু কী তেল সেটা বলে নি, কতটা দিতে হবে তাও না। কী করা যায়? ভাবতে ভাবতে বেচারামের সাদা মাথাতেও খানিক ব্যবহারিক বুদ্ধি খেলে গেল। বসের মাথা গরম, কিছুটা মহাভৃঙ্গরাজ নিয়ে গেলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। এক লিটার মহাভৃঙ্গরাজের বোতল আয়ুর্বেদিক ওষুধের দোকান থেকে কিনে নিয়ে উনি চললেন বসের বাড়ি।
টাকলামাকান তখন বারান্দায় বসে বিশাল ভুঁড়িতে তেল মাখাচ্ছিলেন, এমন সময় তেল হাতে বেচারামের উদয়। 'আপনি এখানে?' বসের ভ্রূ কুঞ্চিত। 'স্যার আপনাকে তেল দিতে এলাম। এবার আমার প্রমোশনটা যদি করে দেন দয়া করে.....' - বলে আশা নিয়ে তাকিয়ে রইলেন বসের দিকে। টাকলামাকানের তখন টাকে আগুন লেগেছে, রাগে ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলছে, কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। তিনি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দেখে সরল-সিধে মানুষটি ভাবলেন বুঝি বরফ গলছে। উনি জিগ্যেস করলেন, 'স্যার, কোথায় রাখব তেলটা?'
'কেন, আমার মাথায় ঢালুন! তেলা মাথায় তেল দিতে শিখেছেন ত ভালোই.......'
ব্যস আর কে পায় বেচারামকে! ঢাকনাটা খুলে সমস্ত তেলটা হড়হড় করে ঢেলে দিলেন টাকলামাকানের মাথায়, মহাভৃঙ্গরাজ গড়াতে লাগল তাঁর মাথা বেয়ে শরীরের সর্বত্র। উনি তো সেই মুহূর্তেই মুর্ছা গেলেন। বস মারা পড়লেন ভেবে ভয়ে-আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে প্রায় একছুটে বাড়ি ফিরে এলেন বেচারাম। তারপর পড়লেন ধুম জ্বরে, একেবারে সাতদিন পরে ছাড়ল সে জ্বর।

পরদিন ভয়ে ভয়ে অফিস গেছেন বেচারাম, অফিসের বাইরে পুলিশ না দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ঢুকেই শুনলেন, বস ডাকছে। বস তাহলে বেঁচে আছে! মনে ভয় থাকলেও জোর করে খানিকটা সাহস এনে গেলেন বসের অফিসে।
একি, এ কে বসের চেয়ারে বসে! এ তো টাকলামাকান নয়। চেহারাখানা ঐরকমই, তবে মাথায় ছোট ছোট ঘন চুল, কপালে চেনা আঁচিল- আরে এ তো বসই!
বসুন, মি: সাহা, বস স্মিতহাস্যে নিজের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন। 'সাহা'টা আবার কে? ও: হো, তিনিই তো বেচারাম সাহা, সেই কোনকালে শেষ কে এই নামে ডেকেছিল! বেচারাম বসতেই একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন বস।
'প্রমোশন!' আনন্দে-বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন বেচারাম।
'আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে একটা শর্ত আছে। ঐ তেলটা কোন দোকানে পাওয়া যায়, আমাকে নামটা একটু লিখে দিতে হবে। উঁহু উঁহু, ওটাকে মহাভৃঙ্গরাজ বলবেন না, আমি জানি ওটা অন্য কিছু- টাকের মহৌষধ!'
'বন্ধুগন! আমার আসল নামটা আজ মনে পড়েছে, বেচারাম সাহা'- বসের অফিস থেকে বেরিয়েই সগর্বে ঘোষণা  করলেন তিনি সহকর্মোদের উদ্দেশ্যে। 'আর বসের নাম টাকলামাকান নয়, শ্রী মাখনলাল দত্ত।'

আজকাল অফিসে বেচারামের বসার নতুন কামরাটি হয়েছে মাখনলালের চেম্বারের গা-ঘেঁষে, রোজ সকালে তাঁর কাজ শুরু হয় বসের বাড়িয়ে দেওয়া সিগারেটটি ধরিয়ে, যাঁর মাথায় এখন ব্রাজিলের অরণ্যের মত ঘন কালো চুল/


তবে একটা মুশকিল হয়েছে। বেচারামের প্রমোশনের ফলে বেচারাথেরিয়ামের সাথে সাথে তাঁর গিন্নির চিল্লানোসেরাস নামটিরও পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে। ফলে তাঁদের শয়নকক্ষের আভ্যন্তরীন সংবাদ আর এই লেখকের কর্ণগোচর হচ্ছে না। তাই ইচ্ছে থাকলেও, আমার ইন্দ্রলুপ্তধারী বন্ধুরা, আপনাদের আমি এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে পারছি না। সেই মহৌষধের দোকানের ঠিকানা সম্বন্ধে যা জানার আপনারা দয়া করে বেচারাম সাহা কিংবা টাকলামাকান, ইয়ে মানে মাখনস্যারের কাছ থেকেই জেনে নেবেন, কেমন?  

No comments:

Post a Comment