Monday, August 19, 2019

সেই যে দিনগুলি- স্মৃতিকথা

সেই যে দিনগুলি।।


(১) বন্যার আগে

২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮। কলকাতা আর আশেপাশের অঞ্চলে শুরু হয়েছে ভয়াবহ বৃষ্টি। কলকাতা চব্বিশ পরগনা, নদিয়া, হুগলি ভাসতে শুরু করেছে, অজয়-ময়ুরাক্ষী উপচে পড়ছে, শুধু ডিভিসির ড্যামগুলো আর দুর্গাপুর ব্যারেজের পরিকল্পিত জল ধরা আর ছাড়ার জন্যে শিল্প-শহরগুলো এখনও অক্ষত। তবে পুজো চলে এল, বৃষ্টি মাঝে কমলেও পুজোর আগেটাতে আবার কি মনে করে ফিরে এল তুমুলভাবে। এরই মধ্যে পিসির চিঠি পেলাম বাঁকুড়া থেকে- বিহারের পুজো আর কত দেখবি, একবার এদিকেও ঘুরে যা পুজোর ধূমধাম।
বলা বাহুল্য আসানসোল দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চল আর পুরুলিয়া ছাড়া বাংলার দুর্গাপূজা দেখিনি এর আগে, যদিও ধানবাদ অঞ্চল মানে যেখানে আমি বড় হয়েছি, তাকে ঠিক বাংলার বাইরেও বলা যায় না। তবু ভাবলাম সপ্তমীর অঞ্জলিটা দিয়ে বেরিয়ে পড়ি। বৃষ্টি পড়েই চলেছে, ৮ই অক্টোবর মহাসপ্তমী, পুষ্পাঞ্জলি দিতে গেলে সকালের ট্রেন ধরা যাবে না, তাও ঠিক করলাম সেদিনই বিকেলের ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে দুর্গাপুর হয়ে, সেখান থেকে বাঁকুড়ার বাস ধরব। পাড়াতুতো কাকী শ্রীমতী ব্যানার্জি শুনে সঙ্গে যেতে চাইলেন। ওঁর বাপের বাড়ি বাঁকুড়া। কাকুর ছুটি নেই, অগত্যা রাজি হতে হল, চার বছর আর সাত বছর বয়সী দুটি নাবালক পুত্রদের নিয়ে তিনিও সঙ্গে চললেন।

৮ই অক্টোবর রবিবার ছিল। তাই ব্ল্যাকে ভীড় ছিলনা তেমন, আরাম করেই দুর্গাপুর পৌঁছলাম। স্টেশনের বাইরেই বাঁকুড়ার বাস ছাড়ে, চেপে বসা গেল বাসে। তখন থেকেই কানাঘুষো শুনছি, দুর্গাপুর ব্যারেজে নাকি ফাটল ধরেছে। জল ছাড়লে বর্ধমান-বীরভূম-হুগলি-বাঁকুড়া ভেসে যাবে আর না ছাড়লে ব্যারেজ ভেঙে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটবে। তখন অত ফোনের সুবিধে ছিল না যে ওখান থেকে কেউ সঠিক খবর জানাবে। তবু দুর্গতিনাশিনীর নাম নিয়ে বাস চলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ব্যারেজ পার হয়ে ব্রিজের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে পড়লাম। তারপরেই দেখি শিয়রে শমন! জলের একটা ধারা ব্যারেজকে বাইপাস করে ব্রিজে বেশ চওড়া একখানা ফাটল ধরিয়ে বয়ে চলে বেশ খানিকটা গিয়ে আবার দামোদরের মূল ধারায় মিশেছে। বাস বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেকে বাস থেকে নামলেন না, ফিরে যাবেন বলে। আমি দেখলাম নীচের ক্ষীণ ধারা- তাও শ-খানেক ফিট চওড়া হবে, পারাপারের জন্যে ডিঙিনৌকো চলছে। কাকিমার তখন বাপের বাড়ি যাবার অদম্য ইচ্ছে, ওপারে একবার পৌঁছলে বাস পাওয়া যাবে এই আশায় নৌকো চড়ার জিদ ধরে বসলেন। আমি তখন আঠারো, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র, ভয় পাওয়ার প্রশ্নই নেই, সুতরাং ব্রিজ থেকে নীচে নেমে এসে নৌকায় উঠলাম। কিছুক্ষণ পরেই বাঁকুড়া জেলার প্রতাপপুর গ্রামের বড়রাস্তায় এসে উঠলাম। আশা ছিল সেখান থেকে বড়জোড়া-বেলিয়াতোড় হয়ে বাঁকুড়া যাবার বাস পাব। ধন্য আশা কুহকিনী! একটা বাস এসে কিছু যাত্রী নিয়ে চলে গেছে, তারপর সেই বাসের ড্রাইভারের কাছে ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার খবর শুনে আর কোন দুর্গাপুরগামী বাস রওনা দেয়নি সেই রূটে। স্বভাবতঃই কারো মাথায় আসেনি যে বেশ কিছু দুঃসাহসী অথচ নিরুপায় যাত্রী প্রতাপপুর নামক এক গণ্ডগ্রামে আটকে আছে।

এমন বিপদেও মানুষ পড়ে? আজকের প্রতাপপুর আধা শহর। সেখানে বাজার, থানা, স্কুল, বাসস্ট্যান্ড, গোটা তিন-চার হোটেল- কী নেই এখন! তখন কিন্তু আধ মাইল দূরে একটা পুলিশ চৌকি ছাড়া আর কিছু ছিলনা। যাত্রীরা কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। কাকিমা বলে চলেছেন যে কিছুদূরে একটা পুলিশ-চৌকি আছে, সেখানে ফোন থাকলেও থাকতে পারে, কেউ কিন্তু রাস্তা ছেড়ে নড়তে চাইছে না।
তবে নবকুমাররা সর্বত্র থাকেন। এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক, দেখে মনে হয় স্কুলশিক্ষক, তিনি রাজি হলেন এই শর্তে যে কেউ একজন সঙ্গে চলুক। আমি একপায়ে খাড়া। কাকিমা অভয় দিলেন যে তাঁর সাময়িক নিরাপত্তার জন্যে ভাবতে হবে না, বরং আমাকে তাঁর বাপের বাড়ির ফোন নম্বর দিলেন। আরেকজন ভদ্রলোক তখন স্বেচ্ছায় আমাদের সঙ্গ নিলেন।

পুলিশ-সেপাইকে বুঝিয়ে বলতে তিনি আর না করলেন না, নিজেই বাঁকুড়া থানায় ট্রাঙ্ক-কল করে জানিয়ে দিলেন যে শিশু-মহিলা সমেত বেশ কিছু অসহায় যাত্রী প্রতাপপুরে ব্যারেজের কাছে আটকে আছে, যেন স্ট্যান্ড থেকে একটা বাস অবিলম্বে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমরা বুঝলাম যে কাজ হবে তবে স্বভাবতঃই বেশ খানিকটা দেরি হবে। বাঁকুড়া থেকে বাস পাঠানো। সেটা বিনা যাত্রীতে ছাড়বে। তারপর এখানে পৌছোতে অন্ততঃ ৪৫ মিনিট। বাঁকুড়া পৌঁছোতে কম করেও দশটা বাজবে। তারপর আরো পনের মিনিট পিসির বাড়ি। ভেবে চিন্তে আমাদের নবকুমার (আমি এই নামই দেয়েছিলাম তাঁর) আমার সঙ্গে একটা চুক্তি করলেন।
'দ্যাখো, রাত্রি প্রায় দশটায় শহরে ঢুকবে। পুজোর বাজার, হয়ত রিকশ পাব, কিন্তু আমার বাসা সেই ভৈরব-স্থান ছাড়িয়ে। রিকশ নাও যেতে পারে। তুমি তো একা আছ, রাতটার জন্যে তোমাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে কী?'
'দেখুন, বাড়ির মালিক আমার পিসেমশাই, তাঁকে জোর করতে পারিনা। তবে আমি বললে নিশ্চয় আপত্তি করবেন না। আপনি সবার এত উপকার করলেন, আমি তো খুশিই হব তাহলে।' আমি বললাম।

বাস ঠিক রাত্রি সাড়ে-দশটায় ঢুকল বাঁকুড়া শহরে। মাচানতলায় বাসের গ্যারেজ, সেখানেই সবাইকে নামিয়ে দেওয়া হল, আর স্ট্যান্ডে যাবেনা বাস। সেখানে গেলে হয়ত ভৈরব-স্থানে যাবার রিকশ পাওয়া যেত, তবে মাচানতলায় নেমে দেখি দু-তিনটে মাত্র রিকশ দাঁড়িয়ে সেই রাতে। তার একটায় কাকিমাকে দুই পুত্র সহ বসিয়ে দিলাম, ওদের বাড়ি শাঁখারিপাড়ার একটু ভেতর দিকে, উনি একাই যেতে পারবেন বললেন। আমি যাব ফার্স্ট ফিডার রোড বা রবীন্দ্র সরণি, মিনিট দশের হাঁটা রাস্তা। নবকুমারবাবু এলেন আমার সাথে। পিসির শাশুড়ি মানে আমাদের ঠাকুমা আমাদের গল্প শুনে রোমাঞ্চিত, ভদ্রলোককে খাইয়ে দাইয়ে সযত্নে বৈঠকখানায় শোবার ব্যবস্থা করে দিলেন। শেষ হল আমাদের বন্যাকবলিত না হয়ে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর উপাখ্যান।


(২) বন্যার পরে।

না, ১৯৭৮ এর বন্যা সেভাবে দেখা হয় নি, যদিও বাঁকুড়ার রাস্তায় আর পুজোর পরে হাওড়া-গোমো প্যাসেঞ্জারে সিন্দ্রি (ধানবাদ) ফেরার পথে রেললাইনের দু'ধারে বন্যাকবলিত গ্রাম আর ধানখেত দেখেছি বেশ কিছু। আমরা বাঁকুড়া আসার রাত্রেই ডিভিসি বাধ্য হয় দুর্গাপুরের ব্যারেজের গেটগুলো যথাসম্ভব খুলে দিতে, দামোদর, অজয়, ময়ুরাক্ষী মিলে ভাসিয়ে দিল মাঝের বর্ধমান-বীরভূম মধ্যবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা। দামোদরকে যে 'বাংলার দুঃখ' (Sorrow of Bengal) বলা হত এককালে দামোদর উপত্যকা যোজনার সাফল্যের পরে সে কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল লোকে। একটু সঠিক আবহাওয়া-সূচনা আর সঠিক পরিকল্পনার অভাবে প্রকৃতি আবার তার অসীম শক্তির কথা মনে করিয়ে দিল।

বন্যার জল সম্পূর্ণ নামার পরে ডিসেম্বরে আবার যাত্রার সুযোগ এল। আমাদের পাড়ার বন্ধু শুভব্রত (বাবুই) শান্তিনিকেতনে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। আমি কথায় কথায় বলেছিলাম যে পৌষমেলা দেখিনি কখনও। ও এই কথা! সঙ্গে সঙ্গে প্ল্যান হয়ে গেল। পৌষের ছয় তারিখে আমি, বাবুই, সুশান্ত (বুড়ো), প্রভাত আর গৌতম ধানবাদ স্টেশনে চেপে বসলাম গোমো-বর্ধমান প্যাসেঞ্জারে। ঠিক হল প্রভাতের মামাবাড়ি বোলপুর, ও আর গৌতম থাকবে সেখানে। আমি আর বুড়ো উঠব বাবুইয়ের অতিথি হয়ে ওদের হোস্টেলে।

দুর্গাপুরে নেমে এবার বোলপুরের বাস। শহর ছাড়িয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রামনাবাগানের জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। কিন্তু এ কী জঙ্গলের অবস্থা। সর্বত্র শুকনো কাদামাটির ছাপ, ভেঙে পড়া গাছপালা শুয়ে আছে যেখানে সেখানে। Denudation কথাটা জিওলজিতেই পড়েছিলাম, আজ স্বচক্ষে দেখলাম তার বীভৎস রূপ। বাড়িঘরের ছাতের উপর কাদামাটি-গাছের ডালপালার স্তুপ। বন্যার সময় প্রকৃতির এক ভয়ংকর প্রলয়ঙ্কর রূপ দেখেছি, অবশ্যই বেশিরভাগ ছবিতে আর চলচ্চিত্রে, আজ দেখলাম প্রকৃতির এক নগ্ন রূপ।

তবে বীভৎসতার কিছুটা দেখা বাকি ছিল তখনও। অজয় নদের সেতু পেরিয়ে ইলামবাজারে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে চোখে পড়ল দৃশ্যটা। একটা আদ্যন্ত ন্যাড়া পলাশ বা শালগাছের থেকে ঝুলছে ওটা কী? বাস কাছে আসতে দেখি একটা গরুর কঙ্কাল। গৌতম এ পথে নতুন, যদিও এমন দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের কারো কখনও হয়নি এর আগে। ও বলে- 'আরে, গরুটা দ্যাখ গাছে উঠেছিল। কী করে উঠল বলত, তবে বেচারা আর নামতে পারেনি!'

গল্পে গরু গাছে ওঠে বটে। তবে যখন বন্যার জলে ভাসতে ভাসতে সে গাছের ডালে আটকে যায়, তখন আর গল্পের মজা থাকে না- তা হয়ে ওঠে নির্মম বাস্তব! 







No comments:

Post a Comment