ভারতের প্রথম ভাষা আন্দোলন ১৯১২-১৯৫৬।।
(১)ভাষা আন্দোলনের পটভূমি।
বাংলাদেশের ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা শহীদদের বা কাছাড়ের ১৯শে মে’র ভাষা আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের আত্মার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা আছে আমার। মাতৃভাষা মাত্র ভাষা নয়, এ যে আমাদের আত্মা, আমাদের জীবনধারণের মূল। মাতৃস্তন্য পুষ্ট করে শরীরকে কিন্তু মাতৃশরীর থেকে বিচ্যুত হয়েও থেকে যায় নাড়ির টান। তেমনই ভাষার অদৃশ্য শিকড় মাতৃভূমির সঙ্গে আমাদের মনোভূমি বেঁধে রেখেছে অলক্ষ্য চৌম্বক বন্ধনে। কেউ জোর করে কেড়ে নিতে পারে না আমার মাতৃভাষার অধিকার, জীবনপণ রাখা যায় তার জন্যে।
তবু এক নিশ্চিত কর্তব্যের খাতিরে আজকের এই পুণ্যদিনে মনে করিয়ে দিতে চাই মাতৃভাষা বাংলার জন্যে বঙ্গের একটি অঞ্চলের বাঙালিদের প্রথম ও সুদীর্ঘ লড়াইএর কাহিনী শুধুমাত্র ভাষার অধিকারের জন্যে। এই জেলার নাম মানভূম, যেখানে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্যে বাঙালিদের আন্দোলন শুরু হয় ১৯১২ সালের ১লা এপ্রিল আর সুদীর্ঘ ৪৪ বছর পরে তার আংশিক সফলতায় আন্দোলন শেষ হয় ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর। এর ইতিহাস তাহলে খুলে বলা যাক।
১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে সুবা-বাংলার দেওয়ানী পায়। জরিপের পর ১৭৬৭ থেকে খাজনা আদায় শুরু হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার চারটি রাজ্য শিখরভূম, মানভূম, বরাহভূম আর ধলভূম (ও সামন্তভূমের কিছু অংশ) মিলে ছিল মানভূম রাজ্য যার সরকার নিয়ন্ত্রিত হত কামারপুকুর-সংলগ্ন মান্দারণ থেকে, তবে রাজ্যের অধিকাংশই পঞ্চকোট রাজার অধীন ছিল। ১৭৬৫ পর্যন্ত পঞ্চকোটরাজ খাজনা দিতেন দিল্লীশ্বরকে। এই রাজ্যের জনজাতি আদিবাসী সম্প্রদায় কিন্তু ‘কোম্পানী’ নামের এই বিদেশী মালিকানাকে মেনে নিতে পারল না, খাজনা দিতে অস্বীকার করল। এই নিয়ে বিরোধ শুরু হল এক দীর্ঘকালব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের যা ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ নামে প্রসিদ্ধ। বরাহভূমের রাজা বিবেকনারায়ণের প্রচ্ছন্ন মদতে ১৭৬৭ থেকে ১৮৩২ পর্যন্ত চলে এই বিদ্রোহ, কোম্পানী অঞ্চলগুলিকে ভাঙাগড়া করে ১৮০৫ সালে জঙ্গলমহল জেলা গঠন করেও তা থামাতে পারে না। চুয়াড় বিদ্রোহের শেষপর্বে ১৮৩২ সালে নেতা বরাভূমের রাজবংশজাত গঙ্গানারায়ন সিংএর পরাজয় ও মৃত্যু হয়। এই বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে ১৮৩৩ সালে গঠিত হয় মানভূম জেলা বর্তমান পুরুলিয়া, ধানবাদ আর সিংভূমের সরাইকেলা অঞ্চলের মোট ৭৮৯৬ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে।
তবে মানভূমের জন্যে আরও বড় শাস্তি অপেক্ষা করছিল। ১৮৮৯ সালে কোম্পানী জেলাটিকে ভেঙে টুকরো করে মাত্র ৪১১২ বর্গমাইলে সীমিত করে দেয়। প্রথম জনগণনার হিসাব অনুযায়ী ১৯১১ সালে এই অঞ্চলে যখন ৭১% জনসংখ্যা বাঙালি ও বাকি সাঁওতাল, কুর্মি ও বিহারি, সেই সময়, অর্থাৎ ১৯১২ সালে পঞ্চম জর্জের নির্দেশে ভারতে চালু হল মহারাণীর রাজত্ব, রাজধানী স্থানান্তরিত হল দিল্লি, বাংলার দুই ভাগ হল, বঙ্গ ও বিহার-উড়িষ্যা আর বঙ্গভাষী জেলা মানভূমকে অন্তর্ভুক্ত করা হল বিহার-উড়িষ্যার, ব্রিটিশ রাজশক্তি বিদ্রোহী মানভূমকে চুড়ান্ত শাস্তি দিল। মাতৃভাষা যাদের বাংলা, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, দলিল, চিঠিপত্র সবকিছুই যাদের বঙ্গভূমিজ তারা কেন বিহার-উড়িষ্যায় যাবে তার কোন উত্তর পাওয়া গেল না। বিদ্রোহী মানভূমকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে চরম আত্মপ্রসাদ লাভ করল ব্রিটিশ সরকার।
(২)ভাষা আন্দোলন- পরাধীন ভারতবর্ষে।
১৯১২ খৃষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল থেকে মানভূমে শুরু হল সম্পূর্ণ নতুন ধরণের একটি আন্দোলন। এই আন্দোলন মাতৃভাষা বাংলার জন্যে, বঙ্গভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্যে। মানুষ এ পর্যন্ত আন্দোলন করেছে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-সুরক্ষা-সার্বভৌমিকতা- স্বাধীনতার জন্যে। ভারতের মানুষ এই প্রথম দেখলেন মাতৃভাষার মর্যাদার জন্যে, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে একটি ভূখণ্ডকে আন্দোলন করতে।
মানভূমকে বিহার-উড়িষ্যা থেকে বাংলাদেশে প্রত্যার্পণের দাবীতে আন্দোলন শুরু হয় পুরুলিয়া কোর্টের আইনজীবি রজনীকান্ত সরকার, শরৎচন্দ্র সেন প্রমুখদের নেতৃত্বে। তবে ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা হত্যাকাণ্ডের আঁচ লাগল মানভূমের জনমনে। ১৯২১ সালে পুরুলিয়ায় তৈরি হয় মানভূম জেলা কংগ্রেস কমিটি, মানভূমকেশরী শ্রীঅতুলচন্দ্র ঘোষ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পুরুলিয়ার ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর মতে, ‘‘প্রতিবাদের স্বর উঠলেও সে সময় স্বাধীনতা আন্দোলনই ছিল মুখ্য। তাই ভাষা আন্দোলন ততটা প্রচার পায়নি। তবে তলে তলে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি হচ্ছিল।’’
জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২০র নাগপুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ পুনর্গঠনের দাবী আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বিহারে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীত্ব লাভ করার পর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে 'মানভূম বিহারী সমিতি' নামক এক সংগঠন গড়ে ওঠে। তখন হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের যে-কৌশলগত অবস্থান,তার প্রতিরোধ-নির্মাণে পুরুলিয়ার ব্যারিস্টার পি.আর. দাসের সভাপতিত্বে তার পালটা মানভুম বাঙালি সমিতি গঠিত হয়। বিহার সরকার আদিবাসী ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় খুলতে শুরু করলে বাঙ্গালীরাও বাংলা স্কুল খুলতে তৎপর হয়ে পড়েন। এই সময় সতীশচন্দ্র সিংহ রাঁচি, পালামৌ, সিংভূম ও মানভূম জেলা নিয়ে ছোটনাগপুর নামক এক নতুন প্রদেশ গঠন বা বাংলার সঙ্গে পুনরায় সংযুক্তির প্রস্তাব করেন।
জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২০র নাগপুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ পুনর্গঠনের দাবী আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বিহারে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীত্ব লাভ করার পর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে 'মানভূম বিহারী সমিতি' নামক এক সংগঠন গড়ে ওঠে। তখন হিন্দি ভাষা আগ্রাসনের যে-কৌশলগত অবস্থান,তার প্রতিরোধ-নির্মাণে পুরুলিয়ার ব্যারিস্টার পি.আর. দাসের সভাপতিত্বে তার পালটা মানভুম বাঙালি সমিতি গঠিত হয়। বিহার সরকার আদিবাসী ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় খুলতে শুরু করলে বাঙ্গালীরাও বাংলা স্কুল খুলতে তৎপর হয়ে পড়েন। এই সময় সতীশচন্দ্র সিংহ রাঁচি, পালামৌ, সিংভূম ও মানভূম জেলা নিয়ে ছোটনাগপুর নামক এক নতুন প্রদেশ গঠন বা বাংলার সঙ্গে পুনরায় সংযুক্তির প্রস্তাব করেন।
১৯১২ থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত সময় মানভূম জেলার ইতিহাসে বাঙালি জাতির আত্মাবলুপ্তি ও অবক্ষয়ের ইতিহাস। কয়েকটি নাম শুধু মনে আসে যাঁরা হিন্দী-বলয়ের মতলব সম্যকভাবে বুঝতে পেরে বঙ্গভুক্তির আন্দোলন জিইয়ে রাখেন, কিন্তু বিহার কংগ্রেস থেকে শুধু আশ্বাস দেওয়া হয়- স্বাধীনতার সংগ্রাম আগে। ভারত স্বাধীন হলেই মানভূম বাংলাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এই আন্দোলনের সূত্রে যে নামগুলি প্রথমেই উঠে আসে তাঁরা হলেন মানভুমকেশরী অতুলচন্দ্র ঘোষ এবং মানভুম-গান্ধী ঋষি নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত- ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের ইতিহাসে মানভূমের থেকে যাঁদের অবদান সীমাহীন। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে অতুলবাবু ওকালতি জীবনের খ্যাতি-প্রতিভা অকাতরে বিসর্জন দিয়ে ঋষি নিবারণচন্দ্রের সঙ্গে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও বহুবার স্বদেশি আন্দোলনের ব্রতে কারাবরণ করেন। যে সংগঠন মানভূমের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই লোকসেবক সঙ্ঘের বর্তমান সচিব সুশীল মাহাতো জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই অখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি করাচি অধিবেশনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন করা হবে। অগত্যা ভারতের স্বাধীনতা পাওয়া পর্যন্ত মানভূমের ভাষা ও বাংলায় অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটি সঙ্গত কারণেই ঝুলে থাকে বা ঝুলিয়ে রাখা হয়।
(৩)ভাষা আন্দোলন- স্বাধীন ভারতবর্ষে।
গত নভেম্বরে ৬৩তম বছরে পা দিল সাবেক মানভূম থেকে বিচ্ছিন্ন পুরুলিয়া জেলা।
"শুন বিহারী ভাই, তোরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাই,
এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষায় রাজ্য চাই।।"
স্বাধীনতা উত্তরকালে সাবেক মানভূমের থিম সঙ ছিল এই ঝুমুরটি। এটি লিখেছিলেন পুরুলিয়ার তৎকালীন সাংসদ তথা গায়ক-কবি ভজহরি মাহাতো।
এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষায় রাজ্য চাই।।"
স্বাধীনতা উত্তরকালে সাবেক মানভূমের থিম সঙ ছিল এই ঝুমুরটি। এটি লিখেছিলেন পুরুলিয়ার তৎকালীন সাংসদ তথা গায়ক-কবি ভজহরি মাহাতো।
সাতচল্লিশে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শুরু হল মানভূমের ভাষাসংক্রান্ত দ্বিতীয় আন্দোলন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই অখিল ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন করা হবে। স্বাধীনতার পরে সেই বিষয়টিকে সামনে রেখে শুরু হয় দ্বিতীয় আন্দোলন। এই অঞ্চল বাংলা ভাষাভাষী হলেও বিহারের হিন্দির আগ্রাসনের শিকার হচ্ছিলেন এই এলাকার মানুষজন। যেসব দাবিকে ঘিরে মানভূম ভাষা-আন্দোলন দানা বাঁধে সেগুলো হল বাংলা ভাষায় কথা বলা, বাংলা ভাষায় লেখা, স্কুল-কলেজে হিন্দি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় পড়াশুনার ব্যবস্থা করা।
স্বাধীনতার আগে লড়াই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে। ভারতের পক্ষে অসীম লজ্জার বিষয় সেই একই দাবীতে লড়াই চালু থাকল স্বাধীন ভারতের দেশীয় সরকারের বিরুদ্ধেও। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ ভারতের ইতিহাসের একটি লজ্জাজনক অধ্যায়, এই সময়ে আরও একটি নতুন ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে স্বাধীন ভারতবর্ষ। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯১২ সালে, সেই অর্থে এ আন্দোলন একশো বছরেরও বেশি পুরনো, অথচ, সে তথ্য ভুলতে বসেছেন অনেকেই। সে কথা মনে করিয়ে দিতে নেই কোনও সরকারি উদ্যোগ। উপেক্ষার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে শহরের এক কোণে আধো অন্ধকারে কোনও রকমে নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রেখেছে ভাষা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত শিল্পাশ্রমও।
বিহার সরকারের অরাজকতার বিরুদ্ধে ১১ই ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের বীজ অঙ্কুরিত হল ছাত্র ধর্মঘট দিয়ে। ফল স্বরূপ আন্দোলনকারীদের ওপর নানারকম নিপীড়ন-নির্যাতন চালানো হতে থাকে। পুলিশ একজন টুসু গায়ক ১০ বছরের অন্ধ বালক বাবুলালকে গ্রেপ্তার করে ভাগলপুর জেলে পাঠায়।
মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অপ্রতিরোধ্য । জন নেত্রী লাবন্যপ্রভা দেবীকে পুলিশ ও রাজনৈতিক গুণ্ডারা চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে, পরে করে অকথ্য নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানী ।
শবরনেত্রী রেবতী ভট্টাচার্যকে পিটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মৃত প্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় বিহারি পুলিশ ।
বরাবাজার স্কুলে শ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তকে গুম করা হয় ।
১৩ বছরের কিশোরদ্বয় সুধন্য মাহাতো ও হরিপদ মাহাতোকে টুসু সত্যাগ্রহী হওয়ার জন্য শুধু গ্রেপ্তারই নয় , বাপ-দাদার সম্পত্তি মায় গরু-মোষ-ঢেঁকিও ক্রোক করা হয় ।
প্রতিবাদ ঝরে পড়ে টুসু গানে - " সুধন্যার ঢেঁকি / দারোগার বউ ধান কুটে / সবাই দেখি ।"
মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল অপ্রতিরোধ্য । জন নেত্রী লাবন্যপ্রভা দেবীকে পুলিশ ও রাজনৈতিক গুণ্ডারা চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে, পরে করে অকথ্য নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানী ।
শবরনেত্রী রেবতী ভট্টাচার্যকে পিটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মৃত প্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় বিহারি পুলিশ ।
বরাবাজার স্কুলে শ্রদ্ধেয় স্বাধীনতা সংগ্রামী বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তকে গুম করা হয় ।
১৩ বছরের কিশোরদ্বয় সুধন্য মাহাতো ও হরিপদ মাহাতোকে টুসু সত্যাগ্রহী হওয়ার জন্য শুধু গ্রেপ্তারই নয় , বাপ-দাদার সম্পত্তি মায় গরু-মোষ-ঢেঁকিও ক্রোক করা হয় ।
প্রতিবাদ ঝরে পড়ে টুসু গানে - " সুধন্যার ঢেঁকি / দারোগার বউ ধান কুটে / সবাই দেখি ।"
তাই ক্রমেই প্রতিবাদ দানা বাঁধতে শুরু করে। সুশীলবাবুর কথায়, ‘‘১৯৫৩ সালে অন্ধ্রপ্রদেশে শ্রীপট্টি রামালু একই ভাবে ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠনের দাবিতে টানা ৫২ দিন অনশনে মারা যান। রামালুর মৃত্যুর পরে মানভূমের আন্দোলন আরও গতি পায়।’’ কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হল States Reorganization Commission গঠন করতে। কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দেওয়া স্মারকলিপি ও মানভূম ভাষা আন্দোলনের যৌথ চাপে ১৯৫৬ সালে মানভূমকে তিন টুকরো করে বাংলা অধ্যুসিত ১৬ টি থানা অঞ্চলে জুড়ে দিল পশ্চিমবঙ্গের সাথে - বিহার সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ 'পোড়ামাটি নীতি' অবলম্বনে জন্ম নিল পুরুলিয়া জেলা । সাল ১৯৫৬ ,১লা নভেম্বর।
ইতিহাস গবেষক দিলীপবাবুর ধরিয়ে দিচ্ছেন, রামালুর মৃত্যুর পরেই কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কথা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। জানানো হয় যে, ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠন হবে। এই ঘোষণার পরে কমিশন পুরুলিয়ায় এসে বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য নেয়। সেই পর্বে লোকসেবক সঙ্ঘ ১৪ ট্যাঙ্ক নথি কমিশনের সদস্যদের কাছে উপস্থিত করেছিলেন। সেই নথির মধ্যে বাংলায় লেখা চিঠিপত্র, পুঁথি, জমির দলিল এমনকি পঞ্জিকাও ছিল।
বিপুল নথি দেখে কমিশনের প্রতিনিধিগন নিশ্চিত হন যে, এই এলাকার মানুষজন বাংলা ভাষাই ব্যবহার করেন। অন্য দিকে, অন্ধ্রপ্রদেশ যখন নতুন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল তখন সেই রাজ্যে উৎসব পালিত হয়। তাতে মানভূম থেকে ভাষা আন্দোলনের অনেক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত-সহ অনেকেই সেখানে গিয়েছিলেন।
তত দিনে মানভূমকে বাংলায় অন্তর্ভূক্ত করার দাবিতে আন্দোলন দুর্বার হয়েছে গোটা মানভূমেই। পুরুলিয়া থেকে কলকাতা পদযাত্রা, বিভিন্ন জায়গায় আইন অমান্য-সহ নানা আন্দোলনে উত্তাল হয় মানভূম।
কমিশনের প্রতিনিধিগন বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষ্যগ্রহণের পরে ঠিক করেন সাবেক মানভূমের ৩১টি থানার মধ্যে ১৯টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া গঠন করা হবে। এই ১৯টি থানাই ছিল বাংলা ভাষাভাষী এলাকা। পরে অবশ্য ১৪টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠিত হয়। ক্রমশ মেলে দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
তত দিনে মানভূমকে বাংলায় অন্তর্ভূক্ত করার দাবিতে আন্দোলন দুর্বার হয়েছে গোটা মানভূমেই। পুরুলিয়া থেকে কলকাতা পদযাত্রা, বিভিন্ন জায়গায় আইন অমান্য-সহ নানা আন্দোলনে উত্তাল হয় মানভূম।
কমিশনের প্রতিনিধিগন বিভিন্ন জায়গায় সাক্ষ্যগ্রহণের পরে ঠিক করেন সাবেক মানভূমের ৩১টি থানার মধ্যে ১৯টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া গঠন করা হবে। এই ১৯টি থানাই ছিল বাংলা ভাষাভাষী এলাকা। পরে অবশ্য ১৪টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠিত হয়। ক্রমশ মেলে দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
(৪) উপসংহার- বিতর্ক।
‘‘সে কথা আর কারই বা মনে রয়েছে’’— আক্ষেপ করছিলেন জেলার আর এক ইতিহাস গবেষক সুভাষ রায়। তাঁর মতে, ‘‘চার দিকে এত অনুষ্ঠান হচ্ছে, অথচ পুরুলিয়ার এই গৌরবময় ইতিহাস চর্চার উদ্যোগ কোথায়?’’ এটা অত্যন্ত যন্ত্রণার, মনে করেন লোকসেবক সঙ্ঘের সচিব সুশীল মাহাতো। তিনি মনে করেন, ‘‘এই উপেক্ষা বা অবহেলা আগেও দেখেছে মানভূমের মানুষ। এখনও দেখছেন। বলতে পারেন ইচ্ছাকৃত ভাবেই ভুলে থাকা হচ্ছে।’’
সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অবশ্য এই আন্দোলনের ইতিহাস অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। রেজিষ্ট্রার নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুরুলিয়ার জন্মদিবস স্মরণে রাখতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করছে। তবুও বলব এই গৌরবময় ইতিহাসের যতটা জনপ্রিয়তা পাওয়ার দরকার ছিল ততটা হয়নি।’’
চর্চার অভাবে যা হওয়ার হয়েছেও তাই। এই প্রজন্মের প্রতিনিধি পুরুলিয়া শহরের বহু বাসিন্দাও খোলাখুলিই মানেন তাঁদের অজ্ঞতার কথা যে পুরুলিয়ার জন্মদিনের কোনও ইতিহাস রয়েছে।
তা হলে?
তা হলে?
মানভূম কলেজের অধ্যাপক প্রদীপ মণ্ডল বা বান্দোয়ানের ঋষি নিবারণচন্দ্র বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক অমিয় চক্রবর্তীর প্রস্তাব, ‘‘বিষয়টিকে স্কুলপাঠ্য করা প্রয়োজন। তবেই তো নতুন প্রজন্ম মানভূমের এই গৌরবময় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে!’’
আর বিতর্ক প্রসঙ্গে জানাই, ১৯৪৮ সালের ৩০শে এপ্রিল থেকে ৫ই মে মানভূম কংগ্রেসের বান্দোয়ান অধিবেশনে মানভূম সভাপতি ভাষাগত অত্যাচার নিয়ে আলোচনা করলেন, নিষ্ফল হল সে আলোচনা। অথচ কোন মন্ত্রবলে (!) তার একমাসের মধ্যেই পুরুলিয়ার শিল্পাশ্রমে একটি বৈঠকে ‘মানভূমের ভাষা বাংলা’- এই প্রস্তাব ৪৩-৫৫ ভোটে পরাস্ত হল। অতুলবাবু কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে মানভূমের বঙ্গে অন্তর্ভুক্তির দাবী নিয়ে ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’ স্থাপন করেন। অগত্যা ব্রিটিশরা যা করেনি, স্বাধীন ভারতের সরকার এই বর্ষীয়ান স্বাধীনতা-সংগ্রামী নেতাকে (৭৩ বৎসর) গ্রেফতার করে ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে, তারপর চক্রান্ত করে শীতের রাত্রে খোলা ট্রাকে চাপিয়ে হাজারীবাগের জেলে পাঠায়, এটা জেনেও যে তিনি তখন প্লুরিসিতে ভুগছিলেন, ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে লড়াইয়ে ফিরে আসেন। এরপর রাষ্ট্রপতি ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁকে রাজ্যপাল পদের প্রস্তাব দেন, শর্ত- যদি তিনি এই আন্দোলন পরিত্যাগ করেন। বলা বাহুল্য ইনি সে ফাঁদে পা দেননি। তারপরের বিতর্ক হল ‘শ্রীকৃষ্ণ সিংহ কমিশন’, যার আমন্ত্রণে তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ধানবাদ অঞ্চলের কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করে নিশ্চিত হন যে মানভূমের ধানবাদ মহকুমা বিহারীপ্রধানই বটে। বস্তুতঃ, শহরাঞ্চলে বিহারির সংখ্যা বেশি হলেও ধানবাদের গ্রামাঞ্চলের ৭০% এখনও বাঙালি, বাকি কুর্মি ও আদিবাসী। ডাঃ রায়ের মত বিচক্ষণ ব্যক্তি কি করে ঠকে গেলেন তা বিতর্কের বিষয়। এর ফলে কয়লা-প্রধান ধানবাদ মহকুমা পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা হয়ে গেল, তাদের কপালে ভাষাগত দুর্ভোগ জারি রইল। আর মাত্র ২৪০৭ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে বাংলায় সংযোজিত হল নতুন জেলা পুরুলিয়া।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার- দিলীপকুমার গোস্বামী, সরিতা আহমেদের ব্লগ, বিভিন্ন ওয়েবসাইট)
No comments:
Post a Comment